
সোহেল রানা :
‘আমার ৭৭ বছরের জীবনে কলমাকান্দায় এক রাতে এমন ভয়াবহ বন্যা হতে কখনো দেখিনি”, এমনটাই বলছিলেন নেত্রকোনার কলমাকান্দা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল খালেক।
আর পাগলা গ্রামের বাসিন্দা ৮৫ বছর বয়সী রতি বিশ্বাসের দাবি, ‘আমার এত বছর বয়সে এমন বন্যা আর কখনো দেখিনি।’
স্থানীয় অন্যান্য বর্ষীয়ান লোকজনের মতে, এমন দুর্বিষহ অবস্থা ১৯৮৮ সালের বন্যার সময়ও দেখা যায়নি। বন্যা আগের সব রেকর্ড ভেঙেছে দিয়েছে। অব্যাহত ভারী বৃষ্টি ও উজান থেকে আসা পাহাড়ি ঢলে এই উপজেলার ৯২ শতাংশ এলাকা এখন পানির নিচে পড়ে আছে।
বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের খবরে এরকমই বলা হচ্ছে। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় অঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। সুনামগঞ্জ, সিলেট ও নেত্রকোনার বিভিন্ন উপজেলায় ৩০ লাখেরও বেশি মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।
তবে আশঙ্কার কথা হলো, সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলার সীমান্তবর্তী মেঘালয়ের পার্বত্য অঞ্চলে বৃষ্টিপাত বেড়ে যাওয়ায় আগামী কয়েক দিনের মধ্যে এ অঞ্চলে চলমান বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতির সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিয়েছে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় আবহাওয়া পূর্বাভাস মডেলগুলো।
দুর্গম এলাকায় যারা আটকে পড়েছেন তাদেরকে উদ্ধারে শনিবার থেকে সেনাবাহিনী, নৌ বাহিনী, কোস্টগার্ড, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে উদ্ধার অভিযান চালাচ্ছেন। উনাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতেই হয়। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানো এইসব অকুতভয় সৈনিকদের প্রতি সম্মান জানাই।
আমাদের দেশে এই ধরনের বিপর্যয় প্রায়ই দেখা যায়। এই ধরণের ঘটনা ঘটলেই প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি আর প্রানহানী লক্ষ্য করা যায়। কেউ বলে গজব, আবার কেউ বলে প্রকৃতির নির্মম প্রতিশোধ। কিন্তু প্রকৃতি কি এমনি এমনিই প্রতিশোধ নেয়? নাকি তার পেছলে যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকে?
স্বভাবতই এই ধড়নের প্রশ্ন থেকেই যায়। তাহলে এ ধরণের বিপর্যয়ের পেছনে আসল কারণগুলি কি? এই দূর্যোগ কি শুধুমাত্র প্রাকৃতিক নাকি এর কিছু দায় মানুষের ওপরেও বর্তায়? এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞরাই বা কি বলছেন?
হাওর অঞ্চল জুড়ে বর্তমান যে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তা কেবল বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেশি হওয়ার কারণে নয়, অনেকেই এই বৃষ্টিপাতকে ইতিহাসের সর্বোচ্চও বলছেন। প্রকৃতপক্ষে, বন্যা পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে এই কারণে যে, উঁচু দিয়ে প্রবাহিত পানি নিম্নাঞ্চলে আটকে গেছে।
তবে আমরা জানি যে, বাংলাদেশে ২০০৪, ১৯৯৮ এবং ১৯৮৮ সালে এর চাইতেও বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছিল। কিন্তু সেই বছরগুলোতে দেশের অবস্থা এতোটা খারাপ ছিল না। তাহলে এখন, মানে ২০২২ সালে এতোটা খারাপ কেন?
বিশেষজ্ঞদের মতে, এর আসল কারণ হলো, মানুষের কারণে চেরাপুঞ্জি (মেঘালয়, ভারত) থেকে ভৈরব (বাংলাদেশ) পর্যন্ত তীব্র বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের জন্য যে ১২৪ কিলোমিটার পথ ছিল, তা ধ্বংস হয়ে যাওয়া।
“বন্যা এতটা তীব্রতা পাওয়ার কারণ, পানি নামতে বাধা পাচ্ছে। হাওরে নানা অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। নদী নাব্যতা হারিয়েছে। এতে পানি দ্রুত সরতে পারছে না”, বলছিলেন, সাইফুল ইসলাম, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) বন্যা ও পানি ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক।
এখানে বলে রাখা দরকার, মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জি বিশ্বের সবচেয়ে বৃষ্টিপ্রবণ এলাকা। চেরাপুঞ্জি ও আসামের গুয়াহাটি- এই দুই এলাকার ভাটি এলাকা হিসেবে বাংলাদেশের সিলেট ও কুড়িগ্রামে পানি নামে। অন্যদিকে পদ্মার মূল নদী গঙ্গার উজানে ভারী বৃষ্টিও হয় বাংলাদেশে।
যুক্তরাষ্ট্রের ম্যারিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্রের পর্যবেক্ষণ বলা হয়, গত ১৭ জুন সকাল ছয়টায় সুনামগঞ্জ জেলা পরিষদের সামনে সুরমা নদীতে সেকেন্ডে ১২ হাজার ঘনমিটার পানি প্রবাহিত হচ্ছিল। পানির উচ্চতা বিপদসীমার প্রায় ১ মিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।
স্বাধীনতার পর আর কখনো এই এলাকায় এত উঁচু দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়নি। (১৮ জুন, প্রথম আলো)।
সিলেট বিভাগের সুরমা, কুশিয়ারা, গোয়াইনসহ বেশির ভাগ নদ-নদীতে পলি পড়ে অনেক এলাকা ভরাট হয়ে গেছে। । তবে আমরা হাওর এলাকায় সড়ক যোগাযোগ সহ নানান অবকাঠামো তৈরি করেছি, যা পানি নিষ্কাশনের পথকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে। ফলে পানি দ্রুত সরে যেতে পারছে না।
এতে বৃষ্টির পানির ঢল দ্রুত বসতি ও শহর এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে।
একটা উদাহরণ দেয়া যাকঃ “অল ওয়েদার রোড”, স্থানীয়রা যেটাকে 'আবুরা' সড়ক নামে ডাকে। এই রোডটি তিনটি হাওর উপজেলা: ইটনা, মিঠামইন এবং অষ্টগ্রামকে সংযুক্ত করেছে। এটি ২০২০ সালের অক্টোবরে নির্মিত হয়েছিল। সিলেট ও সুনামগঞ্জ ডুবে গেলে নিকলি, বাজিতপুর ও কুলিয়ারচরসহ পশ্চিমাঞ্চলের (সড়কের) মধ্য দিয়ে বন্যার পানি নিষ্কাশন বন্ধ হয়ে যায়। এমন ঘটনা আগে কখনও ঘটেনি।
এখন আর বুঝতে কোন অসুবিধাই রইলো না যে, কীভাবে মানবসৃষ্ট কারণ এই এলাকার প্রাকৃতিক জল প্রবাহ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের চারপাশে চলমান আকস্মিক বন্যার জন্য এই রাস্তাটিই দায়ী।
সিলেট অঞ্চলের উপনদী ও শাখানদীগুলো বহু বছর ধরে ড্রেজিং করা হয়নি। কিন্তু তাই বলে শুধুমাত্র এই উঁচু নদীর তলদেশ সিলেটের আবাসিক এলাকায় ৭-৮ ফুট উঁচু পানির স্তর তৈরি করে জলোচ্ছ্বাসের সৃষ্টি করতে পারতো না।
২৯ কিলোমিটার বিশিষ্ট আবুরা সড়কটি উত্তর-পূর্ব দিকে শত শত একর জমির উপর বিশাল জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করেছে। যখন উত্তর-পূর্ব ভূমি প্লাবিত হয়, তখন আবুরা সড়কটির অবস্থানের কারণে কেবলমাত্র ৮০০ মিটার প্রশস্ত কালভার্টের মধ্য দিয়ে জল নিষ্কাশিত হয়। এছাড়াও, সুরমা-কুশিয়ারা-কালনি নদীর প্রবাহ আটকে থাকা জল নিষ্কাশন করতে ব্যর্থ হচ্ছে। কেননা, এই নদীগুলোর তীরবর্তী এলাকা মানুষের দখলে এখন।
সুতরাং, উত্তর-পূর্ব হাওর অঞ্চল জুড়ে বর্তমান বন্যা পরিস্থিতির বেশিরভাগই মানুষের কারণে সৃষ্টি হয়েছে।
পরিকল্পনামন্ত্রী সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছেন, হাওর অঞ্চলে নতুন রাস্তা তৈরি করবে না সরকার। স্বভবতই মানুষের মনে প্রশ্ন জাগে যে, সেই ২৯ কিলোমিটার রাস্তা নিয়ে সরকার কী করবে?
উত্তরটা আসলে প্রশ্নের মধ্যেই লুকায়িত- উদ্ভূত সমস্যা সমাধানে, রাস্তাটা অবশ্যই সরাতে হবে বা কাটতে হবে।
তাহলে, হাওর অঞ্চলের চারপাশে বন্যার জন্য স্বল্পমেয়াদী এবং মধ্যবর্তী সমাধান কি হতে পারে?
“মানুষের জীবন বাঁচানোই আশু সমাধান”, উপরের প্রশ্নের জবাবে বলছিলেন ফাউন্ডেশন ফর ডিজাস্টার ফোরামের সদস্য সচিব গওহর নঈম ওয়ারা।
সম্প্রতি স্থানীয় গণমাধ্যমের সাথে সাক্ষাতকারে তিনি আরও বলেন, “উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের চারপাশের পুরো নিষ্কাশন ব্যবস্থাটি পরবর্তী বর্ষার (২০২৩) আগেই পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে। এই পুনঃস্থাপনের কাজের মধ্যে থাকতে পারে- নদীর ড্রেজিং, বেড়িবাঁধ সুরক্ষা এবং এই কাজের সাথে সম্পৃক্ত আরও অন্যান্য কাজ। সরকারকেই নিশ্চিত করতে হবে যে, এই অঞ্চলটিতে আগামী বর্ষায় এবং পরবর্তী সময়ে যেন কোনভাবেই পানি আটকে না থাকে । ডেল্টা প্ল্যান-২১০০ বাস্তবায়নের জন্য আমাদের অপেক্ষা করা উচিত নয়”।
উইমেনআই২৪ডটকম//জ//২০-০৬-২০২২//১২.২১ এ এম