
ফাইল ছবি
‘একদিন রূপালি গিটার ফেলে চলে যাবো দূরে...’ আইয়ুব বাচ্চু তাঁর গানের এই কথাগুলোকেই যেন সত্যি করে দিয়েছেন। ১৮ অক্টোবর, বাংলাদেশের ব্যান্ড সঙ্গীতের কিংবদন্তি শিল্পী, গিটার জাদুকর ও সুরকার আইয়ুব বাচ্চুর প্রয়াণ দিবস। তাঁর আকস্মিক চলে যাওয়া (২০১৮ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে) বাংলা সঙ্গীতের একটি অপূরণীয় ক্ষতি হলেও, তাঁর সৃষ্টি আজও শ্রোতাদের হৃদয়ে জীবন্ত।
সঙ্গীত জীবনের শুরু ও 'এলআরবি'র প্রতিষ্ঠা
আইয়ুব বাচ্চু ১৯৬২ সালের ১৬ আগস্ট চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর সঙ্গীত জীবনের শুরুটা ছিল সত্তরের দশকের শেষভাগে:
-
১৯৭৮ সালে ব্যান্ড 'ফিলিংস'-এর মাধ্যমে পেশাদার যাত্রা শুরু।
-
১৯৮০ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত তিনি দেশের অন্যতম সেরা ব্যান্ড 'সোলস'-এর লিড গিটারিস্ট হিসেবে কাজ করেন।
-
১৯৯১ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন তাঁর স্বপ্নের ব্যান্ড 'লাভ রানস ব্লাইন্ড' (এলআরবি), যার মাধ্যমে তিনি ব্যক্তিগতভাবে ও ব্যান্ড দলনেতা হিসেবে আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।
গিটারের জাদুকর: রক এন রোলের প্রাণপুরুষ
আইয়ুব বাচ্চু তাঁর গিটারের পারদর্শিতার জন্য ছিলেন আন্তর্জাতিক মানের প্রশংসিত শিল্পী। তাঁর 'রূপালি গিটার' তাঁর নামের সমার্থক হয়ে উঠেছিল। তাঁর হাত ধরে বাংলা ব্যান্ড সঙ্গীতে ব্লুজ (Blues) এবং রক এন রোল (Rock 'n' Roll) ধারা পেয়েছে এক নতুন মাত্রা। তাঁর বাদনের নিজস্ব ঢং তাঁকে দেশের অন্যতম সেরা লিড গিটারিস্টের মর্যাদা দিয়েছে।
সুরকার হিসেবে ৮০’র দশকে চলচ্চিত্রে প্রবেশ: 'মনে কর তুমি আমি চলে গেছি'
গিটারিস্ট হিসেবে তুমুল ব্যস্ততার মধ্যেও আইয়ুব বাচ্চু তাঁর সুর প্রতিভাকে প্রসারিত করেন। আশির দশকের শেষ দিক থেকেই তিনি চলচ্চিত্রের গানে সুরারোপের মাধ্যমে তাঁর সঙ্গীতপ্রতিভার আরেকটি দিক উন্মোচন করেন।
-
জনপ্রিয় সিনেমার গান: আইয়ুব বাচ্চু সুরারোপিত জনপ্রিয় সিনেমার গানগুলোর মধ্যে রয়েছে 'মনে কর তুমি আমি চলে গেছি'। এটিসহ ৮০-এর দশকের শেষ দিকে তিনি আরও কিছু চলচ্চিত্রের গানে সুরারোপ করেছিলেন। তাঁর সুরারোপিত গানগুলি মূলধারার দর্শকদের কাছেও ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং বাংলা চলচ্চিত্রের সঙ্গীতকে নতুন মেজাজ দিতে সাহায্য করে।
-
অন্যান্য শিল্পীদের কণ্ঠে সুর: তাঁর সুরারোপে আসিফ আকবর, কুমার বিশ্বজিৎ, টিপু (ওয়ারফেজ), হাসান (আর্ক) সহ বহু জনপ্রিয় ব্যান্ড ও মূলধারার শিল্পী কণ্ঠ দিয়েছেন, যা তাঁদের সঙ্গীত জীবনকে প্রভাবিত করেছে।
জনপ্রিয়তার ব্যাপ্তি: দুই বাংলার সেতু
আইয়ুব বাচ্চুর জনপ্রিয়তা শুধু বাংলাদেশে সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ এবং ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বাংলা রক মিউজিকের এক অন্যতম পরিচিত মুখ। ৯০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে কলকাতায় তাঁর গান ব্যাপক সমাদৃত হয়। তাঁর সফল কনসার্টগুলো দুই বাংলার শ্রোতাদের মধ্যে এক সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধন তৈরি করেছিল।
অন্য শিল্পীর চোখে আইয়ুব বাচ্চু
তাঁর প্রয়াণের পর বাংলা সঙ্গীতের অন্যান্য শিল্পীরা তাঁকে যেভাবে শ্রদ্ধা জানান:
-
ফজলুর রহমান বাবু (অভিনেতা ও গায়ক): "বাচ্চু ভাই শুধু একজন শিল্পী ছিলেন না, তিনি ছিলেন আমাদের সঙ্গীতের এক বিশাল বটবৃক্ষ। তাঁর গিটারের শব্দ যেন বাংলা গানকে এক নতুন পরিচয় দিয়েছিল।"
-
আসিফ আকবর (সংগীতশিল্পী): "তাঁর চলে যাওয়াটা একটা শূন্যতা তৈরি করেছে, যা পূরণ হওয়ার নয়। তিনি এমন একজন মানুষ ছিলেন, যিনি নিজের গিটারের সুর দিয়ে আমাদের প্রজন্মের স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছেন।"
-
জেমস (সংগীতশিল্পী): "বাচ্চু ভাই ছিলেন আমার কাছে গিটারের গুরু। একসাথে কত মঞ্চে গেয়েছি। তাঁর মতো ডেডিকেটেড আর্টিস্ট খুব কমই দেখা যায়। তাঁর রূপালি গিটার চিরদিন বেজে যাবে।"
তাঁর কালজয়ী সৃষ্টিসমূহ
আইয়ুব বাচ্চুর জনপ্রিয় গানের তালিকা দীর্ঘ হলেও, তাঁর কয়েকটি কালজয়ী গান আজও শ্রোতাদের মুখে মুখে ফেরে:
গানের শিরোনাম | মন্তব্য |
সেই তুমি | প্রেমের গানে তাঁর অন্যতম সেরা সৃষ্টি। |
চলো বদলে যাই | সর্বকালের অন্যতম জনপ্রিয় এই গানটি বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা পেয়েছে। |
কষ্ট | তাঁর একক অ্যালবামের সবচেয়ে আবেগঘন ও জনপ্রিয় গান। |
একদিন ঘুম ভাঙা শহরে | তাঁর সেরা মন খারাপের গানের মধ্যে অন্যতম। |
হাসতে দেখ গাইতে দেখ | তাঁর জীবনের এক প্রতিচ্ছবি স্বরূপ গান। |
আইয়ুব বাচ্চু হয়তো রূপালি গিটার ফেলে চলে গেছেন, কিন্তু তাঁর সুর, তাঁর গিটারের জাদুকরী শব্দ এবং তাঁর গানগুলো বাংলা ব্যান্ড সঙ্গীতের ইতিহাসে চিরকাল এক সোনালী অধ্যায় হয়ে থাকবে।
ইউ