ছবি: কভার ফটো
একদা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ অনুবাদকে বলেছিলেন ‘মরা বাছুরের মূর্তি’।' যদিও তাঁর বিভিন্ন গ্রন্থ ও কাব্যগ্রন্থ থেকে নেয়া গান ও কবিতার সংকলন 'গীতাঞ্জলি' বা 'সঙ্ অফারিংস' নিজের করা ইংরেজি অনুবাদ, পড়ে আপ্লুত হয়েছিলেন ইয়েটস এবং রোদেনস্টাইন। সেই অনূদিত কাব্যগ্রন্থ নোবেল পুরস্কার পায়। কেউ কেউ বলেন অনুবাদ মানে দুধের স্বাদ ঘোলো মেটানো। অনুবাদের ওপর আমার কিন্তু এগাধ আস্থা। বিশ্ব সাহিত্য তো আছেই, ভারতের আঞ্চলিক ভাষা তামিল তেলেগু মালয়ালাম কন্নড় ইত্যাদি কঠিন ভাষা যে এত সমৃদ্ধ সে তো জেনেছি অনুবাদ পড়ে। বৌধায়ন মুখোপাধ্যায়ের অনুবাদ করা শ্রেষ্ঠ আন্তজার্তিক গল্পসম্ভারের প্রতিটি গল্পও উৎকর্ষ মানের।
আজকের আলোচনায় প্রথম গল্পটি নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত ইহুদি লেখক আইজাক সিঙারের আর একটি সাড়া জানানো সৃষ্টি 'কাফ্কার বন্ধু': পোল্যান্ডের এক হাসিদ পরিবারে জন্ম জ্যাকসকোহন ছিলেন ইডিশ থিয়েটারের অভিনেতা। সেই সোনালি দিন আর না থাকলেও এবং লেস্নো স্ট্রিটের কোনো এক ভাড়া বাড়ির চিলেকোঠায় বাস করলেও ফ্রানৎস কাফ্কার বন্ধু পরিচয় দিয়ে এবং তাঁর সম্বন্ধে নানা গল্প বলে আর গর্ব করে দিন কাটত। লেখকের সঙ্গে সন্ধাবেলা ক্লাবঘরে দেখা হলেই এমন ভাব দেখাতেন যেন তিনি কোনো খ্যাতনামা ইউরোপীয় তারকা কিন্তু ফেরার সময় তাঁকে একটা লটি ধার না দিলে দিনগুজরান চলত না।
জ্যাকস্ গল্প করেন ১৯১১ সাল পর্যন্ত কে চিনত কাফ্কাকে? প্রাগ নাটক মঞ্চের পেছনে কাফ্কা দেখা করতে এলে জ্যাকস্ উপলব্ধি করলেন তিনি একজন প্রতিভাধরের সান্নিধ্য পেয়েছেন এবং বড়াই করে লেখককে শোনাচ্ছেন: 'বেড়াল যেমন গন্ধ নাকে টেনে ইঁদুরের উপস্থিতি ঠাহর করে আমিও সেই জাতীয় গন্ধ পেলাম।' লেখককে দেখাতেন তাঁকে লেখা কাফ্কাসহ অন্যান্য খ্যাতনামা ব্যক্তিদের চিঠি যেমন জেকব ওয়াসারমান, স্তেফান জ্যুইগ, রোঁমা রোঁলা, মার্টিন বিউবার প্রমুখ। বলতেন 'নাটকে আমি যেসব খুঁত দেখতে পেতাম কাফ্কা তা খুঁজে পেতেন সাহিত্যে এবং সেই সূত্রে আমরা দুজনে একত্র ও ঘনিষ্ঠ হয়েছিলাম।' কিন্তু জ্যাকসের অভিযোগ না বুঝে কাফ্কা যেমন ইডিশ থিয়েটারের প্রশংসা করতেন তেমনি প্রকৃত না জেনে মাদাম চ্যসিকের মতো এক খেলো অভিনেত্রীর প্রেমে পাগল ছিলেন। 'অবশ্য কে যে কার সঙ্গে খ্যালে! এটা ঠিক আমরা ভাগ্যকে সঙ্গী করে দাবা খেলি। ভাগ্য একটা চাল দেয়, আমরা একটা দিই। তিন দানে সে আমাদের কিস্তিমাৎ করতে চায়। আমরা চেষ্টা করি রুখতে।'
একবার এক কাউন্টপত্নী যিনি এখন বিধবা, জ্যাকসের কাছে একরাত কাটান যখন তার বর্তমান বর্বর প্রেমিক যে সিংহ পোষে তাঁকে তাড়া করে। কাউন্টপত্নী বরাবরের জন্য থেকে যেতে চাইলে জ্যাকসের মনে পড়ে তাঁদের ধর্মগ্রন্থ 'ট্যালমাডে' লেখা আছ অলৌকিক ঘটনা প্রতিদিন ঘটেনা। এই অভিজ্ঞতার কথা পেড়ে বলতেন: কাফ্কা ভালবাসার কাঙাল অথচ ভালবাসার কাছ থেকে পালাতেন। যেমন ওটো ঊইনিঙ্গারও ছিলেন পাগল ও প্রতিভার চূড়ান্ত। যিনি বলতেন ভগবান ছারপোকা সৃষ্টি করেননি। তাহলে কে ছারপোকা সৃষ্টি করেছেন এই নিয়ে ছিল অনেকের ভাবনা।
গ্রানাট নামে এক অভিনেতার বাড়িতে রাতভোর হচ্ছিল পার্টি ও নাচ। অংশগ্রহণে ছিলেন নিজের স্ত্রী, বান্ধবী অথবা ভাড়া করা বেশ্যা। অতিথিরা ছিলেন লেখক অধ্যাপক দার্শনিক এবং সনাতন আঁতেল। আলোচনায় এল যৌনতা নিয়ে সপেনহ্যয়ার বা নীটশে কী বলেছিলেন। সেখানে ছিলেন আর এক আড্ডাধারী বামবার্গ যিনি নাচ শিখেছেন ‘এনট্রপি অব রিজন’এর লেখক ড. মিজকিনের প্রভাবে। দেখা গেল বামবার্গ নাচছেন একদা কাফ্কার প্রেমিকা মাদাম চ্যসিকের হাত ধরে। আক্ষেপের সঙ্গে লেখককে জ্যাকস্ বলছেন: আত্ম-নির্যাতনের চূড়ান্ত শিখরে দণ্ডায়মান এক মানবজীব কাফ্কা। কাফ্কা ইহুদি হতে চেয়েছিলেন কিন্তু জানতেন না কীভাবে! তিনি বাঁচতে চেয়েছিলেন কিন্তু সেটাও জানতেন না কী উপায়ে!
হঠাৎই বামবার্গ বললেন: 'জ্যাকস্ গতকাল আমি তোমার কাফ্কার ক্যাসেল পড়েছি ,খুবই আকর্ষণীয় কিন্তু রূপকগুলো সংক্ষিপ্ত হওয়া দরকার। ' উত্তর দেন জ্যাকস্: গুরুর কোনো নিয়ম মানার প্রয়োজন হয়না। পাল্টা বলেন বামবার্গ: 'কিছু কিছু নিয়ম গুরুকেও মানতে হয়। কোনো উপন্যাস 'ওয়ার এন্ড পিস' এর চেয়ে দীর্ঘ হওয়া উচিত নয়, যদিও ওয়ার এন্ড পিস বেশি বড়। বাইবেল যদি চোদ্দ খণ্ডে লেখা হত তাহলে তার ভেতরে যে বস্তু আছে তা সবাই ভুলে যেত। তখন জ্যাকসকোহনের উত্তর: 'ট্যালমাড ছত্রিশ খণ্ডের ,তা সত্ত্বেও ইহুদিরা ভোলেনি।' খানিক উত্তেজিত হয়ে বামবার্গ বলেন: 'ইহুদিরা বড্ড বেশি মনে রাখে সেটাই আমাদের দুর্ভাগ্য। দু হাজার বছর আগে আমরা পুণ্যভূমি থেকে বিতাড়িত হয়েছিলাম, আর আজ সেখানে আমরা ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করছি। পাগলামি ছাড়া আর কি! যদি আমাদের সাহিত্য শুধু পাগলামি প্রতিফলিত করত, খুব ভাল হত।'
ইউক্রেনের ওডেসায় জন্ম আইজাক বাবেল নিশ্চিহ্ন হন ১৯৪১ সালে সাইবেরিয়ার কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে থেকে টাইফাস রোগে হয়তো বা বন্দুকের গুলিতে। যৌবনে তিনি যেমন জারের সৈন্যদলে ছিলেন তেমনি বলশেভিকদের সঙ্গেও। হিংস্র কসাক ব্যান্ডের সঙ্গেও কাজ করেছেন অথচ স্বভাবে তিনি ছিলেন অহিংস ও কল্পনাপ্রবণ এক ইহুদি যুবক। কিন্তু সব সময় সেনাবাহিনীর অযৌক্তিক হিংসা ও নিষ্ঠুরতার সঙ্গে সমঝোতা করতে হয়েছে। তাঁকে বলা হয় রাশিয়ার হেমিংওয়ে। অভিজ্ঞতা সঞ্জাত তাঁর গল্প 'আমার প্রথম হাঁস।' সেনাবাহিনীর চাকরি পেয়েছেন লেখক। কর্মস্থলে যাওয়ার পথে একরাত কাটাতে হবে গ্রামে হিংস্র কসাকদের সঙ্গে। ডিভিসন কমান্ডার সার্ভিৎস্কির নির্দেশ মতো তাঁর বাক্সটা নামিয়ে রেখে ফিরে গেল কোয়ার্টার মাস্টার। এক ধূর্ত কসাক তাঁর বাক্সকে ছুড়ে ফেলে দিল গেটের বাইরে। উবু হয়ে কুড়োচ্ছিলেন ছড়িয়ে পড়া পান্ডুলিপি ও অন্যান্য জিনিস পত্র। যখন ইটের উনুনে এক মস্ত জালায় সেদ্ধ হচ্ছিল শুয়োরের মাংস। পেটে খুব খিদে, সেই অবস্থায় ট্রাঙ্কের ওপর মাথা রেখে পড়তে লাগলেন প্রাভদায় প্রকাশিত লেনিনের ভাষণ। এদিকে কসাক ছোকরারা তাঁর পা মাড়িয়ে, মস্করা করে জ্বালাতন করতে আছে। খিদে চেপে রাখতে না পেরে শেষে বাড়ির মালকিনকে কিছু খেতে দিতে বলায় তিনি অপারগ জানালেন। একটি তরোয়াল পড়ে ছিল নাগালের মধ্যেই। উঠোনে একটি জাঁদরেল হাঁস দেখতে পেয়ে তাকে বুট দিয়ে পিসে, তরোয়ালের ডগায় উঠিয়ে বাড়িউলিকে রাঁধতে বললেন। মনটা বিষাদে ভরে গেল যখন সস্তা দুলের মতো চাঁদ ঝুলছে আকাশে। রাতে স্বপ্ন দেখলেন উনুনে ফুটতে ফুটতে উথলে পড়ছে নিজেরই রক্তাক্ত হৃদয়।
উরুগুয়েতে জন্ম আর্জেন্টিনায় জীবন কাটান হোরাশিও কিরোগা বাস্তব পরাবাস্তব ও অভিনবের মিলনে আশ্চর্য এক গদ্যকার, অনুবাদকের মতে অনেকটা যেন বাংলা ভাষার কমলকুমার মজুমদার। স্থানীয় সমস্যা ও জীবনযাত্রা তাঁর লেখার মূল উপাদান। মৃত্যু চিন্তা, অসুস্থতা ও বিষাদ জীবনকে তাড়িয়ে বেড়ায়। পরিবারের অনেকের মতো তিনিও আত্মহত্যা করেন ১৯৩৭ সালে।
তাঁর আলোচ্য গল্প: 'মৃত মানুষ।' হাঁসুয়া দিয়ে কলাবাগানের গলিপথ পরিষ্কার করছিল যে মানুষটা ইচ্ছে হল বেড়া ডিঙিয়ে পাশের গ্রামা ঘাসের জমিতে দুদণ্ড জিরিয়ে নেবে কিন্তু ডিঙাতে গিয়ে বাকলে পা হড়কে পড়ে গেল কাত হয়ে এবং হাঁসুয়ার ডগা ঢুকে গেল পেটে। কলাবাগানের ফাঁক দিয়ে সে তার বাড়ি, ঢালু পথ, পেছনের রাস্তা যা নতুন বন্দরে গেছে সব কিছু দেখছে কাত হয়ে আসলে মানুষটা মারা যাচ্ছে। শুনতে পাচ্ছে শিস দিতে দিতে ঘোড়সওয়ার ছেলেটি রোজকার মতো ১১ টা ৩০ মিনিটে চলেছে নতুন বন্দরে। আর তার মাদি ঘোড়াটি হ্রেষাধ্বনি করছে তারকাঁটার বেড়ার পাশে। দুপুরে খাবার আনবে দুই ছেলে ও বউ। তার আগেই ঘোড়াটা সিদ্ধান্ত নেয় ভুলণ্ঠিত মানুষ ও খুঁটির মাঝখান দিয়ে পার হবে কারণ মানুষটার জিরানো শেষ হয়েছে...
শেষ লেখক সারা বিশ্বে পরিচিত ও জনপ্রিয় কলম্বিয়ার গাবরিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ। ১৯৭০ সালে দুনিয়াকে চমকে দিল তাঁর বাস্তব পরাবাস্তব নির্ভর উপন্যাস 'একশ বছরের নির্জনতা' যেন রক্ত দিয়ে ফোটানো ফুল। এখানে আলোচ্য গল্প: 'প্রেমের ওপারে মৃত্যু অমোঘ।'
রোসাল ডেল ভিরে নামক অলীক গ্রামে এসেছেন সেনেটার ওনেসিমো সাঞ্চেজ। চার বছর অন্তর আসেন নির্বাচনী প্রচারে। জার্মান স্ত্রী ও পাঁচ সন্তানের বাবা সাঞ্চেজ নিজে ছিলেন পরিবারের সবথেকে সুখী মানুষ। প্রতিটি জনসভায় গভীর ও শান্ত জলের স্বরে বক্তব্য রাখছেন: 'আমরা এখানে জমায়েত হয়েছি প্রকৃতিকে পরাজিত করতে। প্রতিকূল আবহাওয়ায় নিজ দেশে পরবাসী হয়ে থাকব না। আমরা মহান ও সুখী দেশবাসী হব।' গত বার বছরে এই প্রথমবার নেলসন ফারিনা সেনেটারের সঙ্গে দেখা করেননি কারণ প্রথম নির্বাচনী সভা থেকে নেলসন ফারিনা সেনেটারকে একটি ভুয়া পরিচয়পত্র জোগাড় করে দিতে অনুরোধ করে আসছেন যার সুবাদে আইনের আওতা থেকে নিষ্কৃতি পাবেন। শয়তান দ্বীপ থেকে ম্যাকাও পাখি বোঝাই জাহাজে পালিয়ে এসেছিলেন এই গ্রামে সস্ত্রীক নেলসন। তাঁদের কন্যা লরা ফারিনা। সেনেটার নিজেই পথ পরিক্রমায় বেরিয়ে দোলনার বিছানায় শুয়ে থাকা নেলসনকে জিজ্ঞেস করেন 'কেমন আছেন?' পাশেই ছিল মেয়ে আদিবাসী পোশাকে। তবু সেনেটার তাকে দেখলেন বিশ্বের সবচে সুন্দরী। রাতে সুন্দর পোশাকে নেলসন ফারিনা মেয়েকে পাঠিয়ে দিলেন সেনেটারের কাছে। ঘরে চলছিল গুরুত্বপূর্ণ লোকজন নিয়ে ঘরোয়া মিটিং। খালি হতেই লরা ঘরে ঢুকে দেখল প্রজাপতির মতো উড়ছে হাজার হাজার টাকার নোট! সেনেটার তাকে দেখে মন্তব্য করলেন নেহাতই শিশু, তখন লরা জানায় 'এই এপ্রিলে আমি ঊনিশে পড়ব।' লরার শার্টের বোতাম খুলে যে জায়গাটায় হাত দিতে চান সেখানে তালা দেয়া। চাবি আছে বাবার কাছে। লরা বলল চাবি আনার জন্য লোক পাঠাতে সঙ্গে অঙ্গীকার পত্র বাবার সমস্যার সমাধান হবে এই শর্তে। লোক না পাঠিয়ে বন্য পশুর গন্ধে ভরা লরার বাহুসন্ধিতে মুখ গুঁজে সেনেটার সন্ত্রাসময় এক জগতে আত্মসমর্পণ করলেন এবং ছ মাস এগার দিনের মাথায় একই অবস্থায় মারা গেলেন।
লরা ফারিনার সঙ্গে জনসাধারণ্যে প্রকাশিত কেলেঙ্কারির জন্য তিনি ইতিমধ্যেই লাঞ্ছিত ও ক্ষমতাচ্যৃত তবু মৃত্যুর সময় রাগে ও দু:খে কেঁদেছিলেন মেয়েটিকে ছেড়ে যেতে হচ্ছে সেই যন্ত্রণায়।
ইউ