
চীনে যুদ্ধের প্রস্তুতি
যুক্তরাষ্ট্রের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসিকে চীনের হুমকির পরও তাইওয়ান সফর করায় অঞ্চলটিতে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। প্রতিক্রিয়া জানাতে তাইওয়ান ঘিরে থেকে আকাশ ও সমুদ্রে ছয় দিনের নজিরবিহীন সামরিক মহড়া চালাতে শুরু করেছে চীন। তাইওয়ান নিয়ে আমেরিকার উস্কানির বিরুদ্ধে এই মহড়াকে রীতিমতো যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে দেখতে শুরু করেছেন সামরিক বিশ্লেষকরা।
মহড়া থেকে যে কোনো সময় সংঘাতে রূপ নেয়ার শঙ্কা রয়েছে বলে সতর্ক করেছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। এরই মধ্যে বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টার দিকে তাইওয়ানের মাৎসু দ্বীপপুঞ্জের কাছে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে চীনের সামরিক বাহিনী। এই দ্বীপটির সঙ্গে চীনের উপকূল রয়েছে। অবশ্য কোথায় মহড়া চালাবে, সে ঘোষণা আগেই দিয়েছিল চীন। সে ঘোষণা অনুযায়ী নির্দিষ্ট এলাকায় গিয়ে আঘাত হেনেছে এসব ক্ষেপণাস্ত্র। অন্যদিকে পশ্চিম উপকূল থেকে চীনের বিমান তাড়াতে ফ্লেয়ার ছুড়েছে তাইওয়ানের সামরিক বাহিনী।
তাইওয়ান সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল চ্যাং জোন-সুং জানিয়েছেন, বুধবার গভীর রাতে কিনমেন দ্বীপপুঞ্জের কাছে দুটি চীনা ড্রোন দেখা গিয়েছিল এবং দুইবার এলাকায় প্রবেশ করেছিল।
তিনি বলেন, ‘আমরা অবিলম্বে সতর্কতা জারি করতে এবং তাদের তাড়িয়ে দিতে ফ্লেয়ার ছুড়ি। এতে তারা ঘুরে দাঁড়ায়। তারা আমাদের এলাকায় এসেছিল, আমরা তাদের আমাদের এলাকা থেকে তাড়িয়ে দিয়েছি। আমাদের একটি স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং পদ্ধতি আছে। তারা প্রবেশ করলে আমরা প্রতিক্রিয়া জানাব।’
এর আগে বুধবার ন্যান্সি পেলোসি তাইওয়ান সফর শেষ করার কিছুক্ষণ পরই দেশটির স্বঘোষিত আকাশ-প্রতিরক্ষা সীমার ভেতরে ঢুকে পড়ে ২৭টি চীনা যুদ্ধবিমান। তাইওয়ান সফরে গিয়ে বেজিংয়ের তিয়েনআনমেন স্কোয়ার এবং অধিকৃত তিব্বতে চীনা সেনার অত্যাচারের কথা বলেছেন পেলোসি। চীনকে অখুশি করেছে মার্কিন শীর্ষ নেত্রীর এই সফর উত্তেজনা বাড়িয়েছে নিঃসন্দেহে। ক্ষুব্ধ চীন তাইওয়ান প্রণালীকে ‘বিপজ্জনক অঞ্চল’ ঘোষণার পাশাপাশি মার্কিন দূতকে তলব করেছে।
তাইওয়ানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র বলা হয়েছে, চীনের বিমান, ড্রোন, দূরবর্তী কিনমেন দ্বীপের ওপর দিয়ে উড়েছিল। পরে তাদের দেশের সামরিক বাহিনী বিমানটিকে তাড়িয়ে দিতে অগ্নিশিখা ছুড়েছে। যে কোনো হামলা মোকাবিলায় তারা সতর্ক অবস্থানে রয়েছে বলে জানায়।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, চীন পেলোসির সফরের বিরুদ্ধে তাদের এই প্রতিবাদী মহড়া থেকে পুরোদস্তুর সংঘাতে জড়িয়ে পড়া এড়াতে চাইলেও পরিস্থিতি গুরুতর হয়ে ওঠার ঝুঁকি রয়েছে।
চীন বলেছে, সামরিক মহড়াটি বিশ্বের ব্যস্ততম জলপথের কয়েকটি স্থানে অনুষ্ঠিত হবে এবং মহড়াতে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সংঘর্ষ এড়াতে তাইওয়ান বিমান চলাচলের বিকল্প রুট খুঁজছে। প্রতিবেশী জাপান ও ফিলিপাইনের সঙ্গে বিকল্প রুটে বিমান চলাচলের জন্য আলোচনাও করেছে।
তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট সাই ইং-ওয়েন বলেন, তার দেশ বড় ধরনের সামরিক হুমকির মুখে রয়েছে। তবে তাইওয়ান পিছু হটবে না। তিনি বলেন, ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণ তাইওয়ান প্রণালির নিরাপত্তাকে বিশ্বব্যাপী মনোযোগের আরেকটি কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছে। এই দ্বীপের ওপর যে কোনো আগ্রাসন সমগ্র ইন্দোপ্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের নিরাপত্তার ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলবে।
চীন সরকারের কাছে তাইওয়ান ইস্যু অত্যন্ত সংবেদনশীল। তাইওয়ানের বেলায় তারা ‘এক চীন নীতি’ অনুসরণ করে। চীনের বৈদেশিক সম্পর্কের বিষয়টিও তাদের ‘এক চীন নীতির’ ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। যুক্তরাষ্ট্রের সরকারব্যবস্থায় তিন নম্বরে থাকা পেলোসির তাইওয়ান সফরকে চীন তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশি হস্তক্ষেপ এবং সর্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি বলে বিবেচনা করেছে। এক চীন' নীতির পক্ষে বাংলাদেশ সরকারও দৃঢ় অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেছে।
বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশ তাইওয়ানের পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে এবং সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে সর্বোচ্চ সংযম অবলম্বন করার আহ্বান জানাচ্ছে।
এদিকে পরিস্থিতি শান্ত করার প্রয়াসে জি৭ দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা (কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, জাপান, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র) একটি যৌথ বিবৃতি দিয়েছে। বিবৃতিতে তারা বলেছে, চীনের এমন কর্মকাণ্ডের অঞ্চলটিতে অস্থিতিশীলতার ঝুঁকি তৈরি করেছে।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, তাইওয়ান প্রণালিতে আক্রমণাত্মক সামরিক তৎপরতার অজুহাত হিসেবে সফরকে ব্যবহার করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। আমাদের দেশের আইনপ্রণেতাদের আন্তর্জাতিক ভ্রমণ করার স্বাভাবিক রুটিন ছিল এটি।
চীনের ইস্টার্ন থিয়েটার কমান্ডের বরাতে বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, বুধবার চীনের নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, রকেট ফোর্স, স্ট্রাটেজিক সাপোর্ট বাহিনী এবং জয়েন্ট লজিস্টিক সাপোর্ট ফোর্স তাইওয়ানের উত্তর, দক্ষিণ-পশ্চিম এবং দক্ষিণ-পূর্বে আকাশ ও সমুদ্রে মহড়ায় অংশ নিয়েছে।
মহড়ায় চীনের সেনাবাহিনী অবরোধ এবং নিয়ন্ত্রণের অনুশীলন ছাড়াও সমুদ্র ও ভূমি থেকে আক্রমণ চালানোর অনুশীলন করবে।
তাইওয়ান বলছে, সামরিক মহড়া চলাকালে ওই এলাকায় বিদেশি জাহাজ ও বিমান প্রবেশ না করাতে বলেছে বেইজিং। বিশ্ববাণিজ্যে তাইওয়ান ও এর আশপাশের জলসীমা গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য রুট। চীনের এমন পদক্ষেপকে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন।
এ বিষয়ে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র তথাকথিত ‘গণতন্ত্রের’ আড়ালে চীনের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনে জঘন্য কাজ করছে। তাইওয়ানের স্বাধীনতার নামে বিচ্ছিন্নতাবাদী বাহিনী যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সহায়তায় জাতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছে। কম্বোডিয়ায় অনুষ্ঠিত পূর্ব এশিয়া সহযোগিতা সংক্রান্ত বৈঠকে অংশ নিয়েছেন চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী। সেখানে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এসব কথা বলেন।
তিনি আরও বলেন, এক চীন নীতিকে কেউ বাধাগ্রস্ত করতে পারবে না। তাইওয়ান মাতৃভূমিতে ফিরে আসবে বলেও জানান তিনি।
চীনের ‘কৌশলগত’ মহড়ার মধ্যেই তাইওয়ানের দক্ষিণ-পূর্ব সমুদ্রের দিকে যাচ্ছে মার্কিন বাহিনীর রণতরী ইউএস রোনাল্ড রিগ্যান। বৃহস্পতিবার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর মুখপাত্র। রণতরীর উপস্থিতিতে অঞ্চলটিতে উত্তেজনা আরও বৃদ্ধির আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, রণতরী এবং এর স্ট্রাইক গ্রুপ মুক্ত ও স্বাধীন ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের সমর্থনে দক্ষিণ চীন সাগরে নির্ধারিত অপারেশনে যাচ্ছে। রোনাল্ড রিগ্যানের নেতৃত্বে থাকা কমান্ডার জর্জ এম উইকোফ বলেন, ‘এ অভিযান অঞ্চলটির নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা অর্জনে আমাদের প্রতিশ্রুতির বিষয়ে সহযোগিতা এবং মিত্রদের কাছে একটি সংকেত'।
//এল//