ফাইল ছবি
ঢালিউডের কিংবদন্তী নায়ক সালমান শাহর রহস্যজনক মৃত্যু (৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৬) ২৯ বছর পর এক নতুন আইনি মোড় নিয়েছে। আদালতের নির্দেশে অবশেষে অপমৃত্যু মামলাটি হত্যা মামলা হিসেবে রুজু হয়েছে। ঘটনাটি প্রায় তিন দশক আগের হওয়ায়, প্রত্যক্ষ প্রমাণের পাশাপাশি অভিযুক্তদের মনস্তাত্ত্বিক আচরণ, পারিপার্শ্বিক প্রমাণ এবং আলামতের অসঙ্গতি বিশ্লেষণ করা তদন্তকারীদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এই প্রতিবেদন অপরাধ বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিকোণ থেকে সেই জটিল রহস্যের গভীরে আলোকপাত করছে।
১. রিজভী আহমেদ ফরহাদের জবানবন্দি ও নীরব করার কৌশল
মামলার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে রিজভী আহমেদ ওরফে ফরহাদের (১১ নম্বর আসামি) সেই বিতর্কিত জবানবন্দি, যেখানে তিনি এটি একটি চুক্তিভিত্তিক হত্যাকাণ্ড বলে দাবি করেছিলেন। তবে, বিদেশে পাড়ি জমানোর পর তার বক্তব্য প্রত্যাহার ঘটনাটিকে আরও রহস্যময় করেছে।
অপরাধ বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ ও তদন্তের দিশা:
বিশেষজ্ঞদের মতে, ২৯ বছর আগে সংঘটিত একটি হত্যাকাণ্ডের প্রধান সাক্ষীর বক্তব্য প্রত্যাহার করার পেছনে ক্ষমতা এবং ভয়ভীতির প্রভাবই প্রধান। তদন্তকারীরা এই সত্যটিকে অন্যভাবে বিবেচনা করতে পারেন:
-
ক্ষমতার অপব্যবহার: রিজভীর বক্তব্য প্রত্যাহার প্রমাণ করে যে, অভিযুক্ত বা তাদের পেছনের প্রভাবশালী মহল আইনি প্রক্রিয়াকে দীর্ঘকাল ধরে নিজেদের অনুকূলে রাখতে সক্ষম। রিজভীকে সুরক্ষা এবং জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিনিময়ে বক্তব্য প্রত্যাহারে বাধ্য করা হয়েছে কি না—সেটিই তদন্তের প্রধান দিক হওয়া উচিত।
-
সাক্ষ্য সুরক্ষা: তদন্তকারীদের উচিত হবে রিজভী এবং মামলার অন্য বিতর্কিত সাক্ষীদের (যেমন রুবি) আচরণ এবং নিরাপত্তা ঝুঁকি বিশ্লেষণ করে তাদের বক্তব্য প্রত্যাহারের পেছনের আসল কারণটি উদঘাটন করা।
২. লাশের প্রতি নির্লিপ্ততা: সন্দেহভাজনদের মানসিক বিচ্ছিন্নতা
সালমান শাহর মা ও মামার আক্ষেপ—স্ত্রী সামিরা হক, কথিত ঘনিষ্ঠ বন্ধু ডন বা চলচ্চিত্রের সহকর্মীরা কেউই মরদেহের সাথে বা শেষকৃত্যে ছিলেন না।
অপরাধ বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ ও তদন্তের দিশা:
অপরাধ মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, হত্যার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের মধ্যে ঘটনার পরে লাশের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলার একটি সাধারণ প্রবণতা দেখা যায়।
-
গভীর অপরাধবোধের লক্ষণ: লাশের কাছে না থাকার অর্থ হলো গভীর অপরাধবোধ থেকে উদ্ভূত প্রমাণ এড়ানোর চেষ্টা। এটি কেবল শারীরিক প্রমাণ এড়ানো নয়, বরং আবেগের মুখোশ খুলে যাওয়ার ভয় এড়ানো—যা ঠান্ডা মাথার মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ।
-
ডনের মিথ্যা 'বন্ধুত্ব': ডনের মতো অভিযুক্ত যখন নিজেকে 'ঘনিষ্ঠ বন্ধু' দাবি করেও লাশের প্রতি নির্লিপ্ত থাকেন, এবং পাশাপাশি নীলা চৌধুরীর চরিত্র হননের মাধ্যমে মূল অভিযোগ থেকে দৃষ্টি সরানোর চেষ্টা করেন, তখন তা মনস্তাত্ত্বিক কারসাজি (Manipulation) এবং ষড়যন্ত্রে সংশ্লিষ্টতার ইঙ্গিত দেয়। তদন্তকারীদের উচিত, ডন কার নির্দেশে এই 'টাস্কভিত্তিক' বক্তব্য দিয়েছেন—তা খুঁজে বের করা।
৩. ফরেনসিক অসঙ্গতি ও ঠান্ডা মাথার ষড়যন্ত্রের প্রমাণ
দীর্ঘদিন ধরে মামলাটিকে 'আত্মহত্যা' বলে চালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা হলেও, ফরেনসিক আলামতগুলো এবং পারিপার্শ্বিক প্রমাণগুলো পরিকল্পিত হত্যার দিকে ইঙ্গিত দেয়:
-
অস্বাভাবিক শারীরিক আলামত: চূড়ান্ত শুনানিতে উল্লেখ করা বুকের বাম পাশে কালো দাগ, অস্বাভাবিকভাবে মল ও বীর্য নির্গত হওয়া—এগুলো আত্মহত্যার তত্ত্বকে দুর্বল করে।
-
রহস্যময় সরঞ্জাম: নিহতের ঘর থেকে সিরিঞ্জ এবং স্ত্রীর ব্যাগ থেকে ক্লোরোফর্ম ওষুধ উদ্ধার হওয়া রিজভীর জবানবন্দির সঙ্গে মিলে যায় এবং তা পূর্বপরিকল্পিত হত্যার (Organized Crime) ইঙ্গিত দেয়।
-
জুটি ভাঙার কারণ: সালমানের ম্যানেজার মুনসুর আলীর বক্তব্য অনুসারে, সামিরার সন্দেহজনিত পারিবারিক কলহের বিষয়টিকেই তারা 'আত্মহত্যার কারণ' হিসেবে প্রচার করেছে।
তদন্তের বিশ্লেষণমূলক নির্দেশনা:
-
বিশেষজ্ঞ প্যানেল গঠন: পূর্ববর্তী পোস্টমর্টেম ও ফরেনসিক রিপোর্টগুলো দেশী-বিদেশী বিশেষজ্ঞ প্যানেলের মাধ্যমে স্বাধীন ফরেনসিক প্যাথলজি রিভিউ করা।
-
ক্লোরোফর্মের উৎস: সামিরার ব্যাগে ক্লোরোফর্ম থাকার বিষয়টি সন্দেহজনক। এর প্রেসক্রিপশন বা উৎসের সন্ধানে স্থানীয় ঔষধালয় বা সংশ্লিষ্টদের নতুন করে জিজ্ঞাসাবাদ করা আবশ্যক।
৪. ঠান্ডা মাথায় আভিজাত্য বজায় রাখার মনস্তত্ত্ব
দীর্ঘ ২৯ বছর ধরে অভিযুক্ত ও সন্দেহভাজনদের (সামিরা, ডন) সমাজে স্বাভাবিক জীবন যাপনের কৌশল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এর পেছনে নিম্নোক্ত মনস্তাত্ত্বিক কৌশলগুলো কাজ করেছে:
১. নার্সিসিজম ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা: এই ধরনের ব্যক্তিরা অনুশোচনার অভাব এবং দম্ভ নিয়ে চলেন। তারা বিশ্বাস করে, তাদের সামাজিক অবস্থান ও প্রভাব ব্যবহার করে বিচারকে প্রভাবিত করা সম্ভব।
২. গ্যাসলাইটিং ও ভিকটিম ব্লেমিং: মূল অভিযোগ থেকে মনোযোগ সরাতে তারা বারবার গ্যাসলাইটিং এবং ভিকটিম ব্লেমিং কৌশল ব্যবহার করেছে।
৩. সংগঠিত অপরাধীর আচরণ: হত্যা মামলা রুজু হওয়ার পরপরই অভিযুক্তদের লাপাত্তা হওয়া ইঙ্গিত দেয় যে, তারা আইনের হাত থেকে বাঁচতে সুসংগঠিতভাবে পলায়ন বা আত্মগোপন-এর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
উপসংহার ও প্রত্যাশিত দিশা:
সালমান শাহ হত্যা মামলা বর্তমানে এক চূড়ান্ত সত্য উন্মোচনের সন্ধিক্ষণে। লাশের প্রতি নির্লিপ্ততা, রিজভীর অবস্থান পরিবর্তন, ফরেনসিক আলামত এবং সন্দেহভাজনদের ঠান্ডা মাথার মনস্তত্ত্ব—এই প্রতিটি উপাদানই এক গভীর ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত দেয়। তদন্তকারী সংস্থাগুলোর উচিত হবে পুরোনো তথ্য এবং অপরাধ বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণকে কাজে লাগিয়ে, প্রভাবশালী মহলের চাপ উপেক্ষা করে এবং প্রতিটি সাক্ষীর মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করে এই দীর্ঘ ২৯ বছরের রহস্যের জট চিরতরে খুলে দেওয়া।
ইউ





