
ছবি: উইমেনআই২৪ ডটকম
শিশু বয়সেই যৌন পেশায় যুক্ত হন ৪৫ শতাংশ নারী। তাদের মধ্যে ১১ থেকে ১৪ বছর বয়সের মধ্যে এই পেশায় যুক্ত হন ১৮ দশমিক ৫ শতাংশ মেয়ে শিশু। এছাড়া ১৫ থেকে ১৭ বছর বয়সের ২৬ দশমিক ৫ শতাংশ মেয়ে এই পেশায় প্রবেশ করেন। অন্যদিকে, ৩৮ শতাংশ নারী ১৮ থেকে ২১ বছর এবং ১০ শতাংশ নারী ২২ থেকে ২৫ বছর বয়সে এই পেশায় আসেন।
১৬ সেপ্টেম্বর (মঙ্গলবার) রাজধানীর তেজগাঁওয়ে সমকালের সভাকক্ষে ‘যৌনকর্মীদের জীবনমান উন্নয়নে করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে আসে। ইউএন উইমেন’ এর আথিক সহায়তায় এবং 'সমকাল’ ও 'অপরাজেয় বাংলাদেশ’ যৌথভাবে আয়োজন করে। এই গবেষণা পরিচালনা করে অপরাজেয় বাংলাদেশ।
সংস্থাটি গত এক বছরে জামালপুরের একটি যৌন পল্লীর ২০০ জন যৌনকর্মী এবং ৫০ জন অংশীজনের ওপর এই গবেষণা করে। গবেষণায় আট জন যৌনকর্মী এবং চারজন সরকারী কর্মকর্তার গভীর সাক্ষাতকার নেওয়া হয়। ১০টি ফোকাস গ্রুপ আলোচনায় ৬০ জন যৌনকর্মী ও ৪০ জন সরকারি–বেসরকারি কর্মকর্তা অংশ নেন। এছাড়া জামালপুরের যৌনকর্মী ও অংশীজনদের সঙ্গে দুইটি করে পরামর্শ সভার আয়োজন করা হয়। এতে মোট ৮০ জন অংশ নেন। অন্যদিকে, ঢাকা যৌনকর্মী ফেডারেশনের সঙ্গে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়।
গবেষণার ফল উপস্থাপন করেন– অপরাজেয় বাংলাদেশের প্রজেক্ট কোঅর্ডিনেটর ফারজানা বাশার। যৌনকর্মীদের কর্মসংস্থান সম্পর্কে গবেষণায় বলা হয়, তাদের মধ্যে ৪৯ শতাংশ মাসে পাঁচ থেকে ১০ হাজার টাকা আয় করেন। ৩২ দশমিক ৫ শতাংশ নারী আয় করেন ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা। ১২ শতাংশ যৌনকর্মী ১৫ থেকে ২০ টাকা। ৯৩ দশমিক ৫ শতাংশের বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ নেই। মাত্র ১২ জন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ের সঙ্গে জড়িত।
স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার বিষয়ে বলা হয়, গত মাসে স্বাস্থ্যসেবা ১৬০ জন। মাত্র ২২ জন স্বাস্থ্যসেবা পেয়েছেন। স্বাস্থ্যসেবা না পাওয়াদের মধ্যে ৮৯ জন কোনো কারণ জানাননি। ৩৪ জন কারণ জানাতে অস্বস্তি বোধ করেছেন। ২৮ জন সেবাস্থান কোথায় তা জানতেন না। ১৫ জন টাকা অভাবের কথা বলেছেন। ২৮ জন সময়ের কিংবা সময় মিলেনি বলে জানিয়েছেন। দূরত্বের কারণে স্বাস্থ্যসেবা নিতে যাননি ছয় জন।
এই পেশায় সহিংসতা ও নির্যাতনের বিষয়ে গবেষণায় বলা হয়, ১৮১ জন শৈশবে যৌন নির্যাতনের শিকার হননি, তবে ১৫ জন শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছেন। উত্তর দেননি তিন জন। অন্যদিকে, এই পেশায় আসার একবার হলেও সহিংসতার শিকার হয়েছেন ১০৮ জন। কয়েকবার সহিংসতার মুখোমুখি হয়েছেন ২৭ জন। ১৬ জন বহুবার সহিংসতার শিকার হন। উত্তর দেননি ৪৯ জন। এছাড়া কয়েকবার জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ক স্থাপনের ঘটনা ঘটেছে ১৯০ জনের সঙ্গে। আটজনের সঙ্গে এই ঘটনা ঘটেছে বহুবার। এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি দুইজন। এতে বলা হয়, অংশগ্রহণকারী কর্মীদের মধ্যে কেউই সামাজিক নিরাপত্তা সুবিধা পাননি। কেবল সরকারি ত্রাণ পেয়েছেন ২০ জন। ৮৩ জন কম এবং ৬৮ জন খুব কম ত্রাণ পেয়েছেন। কখনোই পাননি ২৮ জন। তাদের প্রধান চাহিদা হিসেবে তারা জাতীয় পরিচয়পত্র, সহিংসতা থেকে সুরক্ষা, নিরাপদ আশ্রয়, শিশুদের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, জন্মনিবন্ধন, মানসিক সহায়তা, জীবন দক্ষতার প্রশিক্ষণ, কারিগরি প্রশিক্ষণ, প্রাথমিক শিক্ষা, বিকল্প কর্মসংস্থান, আর্থিক সহায়তা এবং শিশুদের জন্মনিবন্ধন বিষয় উল্লেখ করেছেন।
অপরাজেয় বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ওয়াহিদা বানুর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের সদস্য ডা. হালিদা হালুম আখতার, স্থানীয় সরকার বিভাগের পরিকল্পনা, পরিবীক্ষণ, মূল্যায়ন ও পরিদর্শন অনুবিভাগের মহাপরিচালক মো. মাহমুদুল হাসান, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পরিচালক (এমসিএইচ-সার্ভিসেস ইউনিট) ডা. মো. সুলতান আহম্মদ, সেন্টার ফর উইমেন অ্যান্ড চিলড্রেন স্টাডিজের (সিডব্লিউসিএস) প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ইশরাত শামীম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জেন্ডার এন্ড উইমেন স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক তানিয়া হক, অপরাজেয় বাংলাদেশের প্রোজেক্ট কোঅর্ডিনেটর জুলফিকার আলী, পাইঅ্যাক্ট বাংলাদেশের প্রোজেক্ট কোঅর্ডিনেটর মো. মুজিবুর রহমান, সিডিসিএসের নির্বাহী পরিচালক তামান্না রহমান, প্রাগ্রসরের নির্বাহী পরিচালক ফওজিয়া খন্দকার ইভা, ঢাকা আহসানিয়া মিশনের ড্যামের প্রোগ্রাম ম্যানেজার মো. কামরুজ্জামান, সেইভ দা চিলড্রেনের সিনিয়র প্রজেক্ট ম্যানেজার সেলিমা সুলতানা, পুলিশের ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের উপ পরিদর্শক খোদেজা খানম, মেট্রোপলিটন বার অ্যাসোসিয়েশনের আইনজীবী অ্যাডভোকেট ওসমান গনি, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের লিগ্যাল এইড উপপরিষদের লিগ্যাল অ্যাডভোকেসি ও লবি অ্যাডভোকেট দীপ্তি শিকদার, নারীপক্ষের সদস্য জাহানারা খাতুন, জামালপুর ব্রোথেলের কমিউনিটি লিডার মো. মফিজ, সর্বজয়ার প্রেসিডেন্ট জয়া শিকদার, সেক্স ওয়ার্কার নেটওয়ার্কের সদস্য আনিশা আক্তার নিতু এবং অপরাজেয় বাংলাদেশের সদস্য ফাতেমা প্রমুখ। সমাপনী বক্তব্য দেন সমকাল সম্পাদক শাহেদ মুহাম্মদ আলী।
অনুষ্ঠানে হালিদা হালুম আখতার বলেন, এসব নারী এদেশের নাগরিক, এদেশের মানুষ। তারা কী কাজ করেন– সেটা বড় কথা নয়। তাদের যে অধিকার আছে, সেটা তাদের দিতে হবে। যিনি এই অধিকার নিশ্চিত করবেন, তার মানসিকতারও পরিবর্তন করতে হবে। তা না হলে এই অধিকার নিশ্চিত করা যাবে না। এজন্য আমাদের সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
মাহমুদুল হাসান বলেন, এসব নারীদের নিয়ে গবেষণার পরিসর বাড়াতে হবে। বিস্তৃতভাবে এই গবেষণা করতে হবে। সরকারের সকল মন্ত্রণালয়কে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। এক্ষেত্রে মূল ভূমিকা নিতে হবে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়কে।
শাহেদ মুহাম্মদ আলী বলেন, আমাদের সবার দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। তাহলে আমরা যে জায়গায় যেতে চাই, সেই জায়গায় পৌঁছাতে পারবো।
অধ্যাপক ইশরাত শামীম বলেন, যৌনকর্মীদের পুনর্বাসন করতে চাইলে অন্যভাবে তা করতে হবে। তাদের সমাজের মূলধারায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তাদের নিজের এলাকা থেকে দূরে কোথাও নিয়ে পুনর্বাসন করতে হবে।
তানিয়া হক বলেন, এই নারীরা সমাজের একটা গোষ্ঠীকে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। তাদের থেকে তারা সুযোগটা ঠিকই নিচ্ছেন, কিন্তু সুবিধা দিচ্ছেন না। তাদের আইনি বৈধতা দিতে হবে। তা না হলে সামাজিক বৈধতা দেওয়া সম্ভব নয়।
সভাপতির বক্তব্যে ওয়াহিদা বানু বলেন, সারাদেশে এক লাখ ৪০ হাজার যৌনকর্মীকে পুনর্বাসন করা মোটেও কঠিন নয়। এক বছরের মধ্যেই এটা করা সম্ভব। যারা মর্যাদাপূর্ণ জীবন চান, তাদের তা দেওয়া সম্ভব।
ইউ