
ছবি সংগৃহীত
লন্ডনের প্রাণবন্ত হল্যান্ড পার্কে এক নতুন বিপ্লবের জন্ম হয়েছে। এখানে ডজনখানেক নারী একত্রিত হয়েছিলেন কেবল একটি পিকনিকের জন্য নয়, বরং তাদের কাঁধে চাপানো এক অদৃশ্য বোঝা নিয়ে আলোচনা করতে, যা ‘বড় মেয়ের সিনড্রোম’ নামে পরিচিত। প্রবাসীদের পরিবারে বড় মেয়েদের ওপর যে অতিরিক্ত দায়িত্ব ও প্রত্যাশার চাপ থাকে, তা মোকাবিলা করার জন্য এই নারীরা একটি অভূতপূর্ব সংহতি তৈরি করেছেন। এই সিনড্রোমটি সম্প্রতি টিকটকের মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে পরিচিতি পেয়েছে, যেখানে বহু নারী তাদের শৈশব থেকে বয়ে চলা পারিবারিক দায়িত্বের ভার এবং এর মানসিক প্রভাব নিয়ে কথা বলছেন। এই আন্দোলন কেবল একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর সমস্যা নয়, বরং বিশ্বজুড়ে সেইসব নারীদের প্রতিচ্ছবি, যারা নীরবে তাদের পরিবারের জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে যাচ্ছেন।
এই সমস্যার মূলে রয়েছে ‘প্যারেন্টিফিকেশন’ – অর্থাৎ, অল্প বয়সে বড়দের মতো দায়িত্ব গ্রহণ করা। বিশ্বজুড়ে গবেষণায় দেখা গেছে, ৫ থেকে ১৪ বছর বয়সী মেয়ে শিশুরা ছেলেদের তুলনায় ৪০ শতাংশ বেশি সময় ধরে গৃহস্থালি কাজ করে। প্রবাসীদের পরিবারে এই চাপ আরও বেড়ে যায়, কারণ বড় মেয়েদের প্রায়শই অনুবাদক, অভিভাবক এবং পারিবারিক ব্যবস্থাপকের ভূমিকা পালন করতে হয়। এই চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও, এই নারীরা এখন তাদের অভিজ্ঞতাগুলোকে একটি সম্মিলিত শক্তির উৎস হিসেবে ব্যবহার করছেন। ‘হোম গার্লস ইউনাইট’ নামক একটি কমিউনিটি গ্রুপ এই নারীদের পাশে দাঁড়িয়েছে, যারা শুধু সমস্যার কথা বলছেন না, বরং একে একটি ক্ষমতায়নের মাধ্যমে পরিণত করছেন।
‘বড় মেয়েরা’ যে জন্য প্রগতির প্রতীক
এই প্রতিবেদনটি প্রমাণ করে যে, ‘বড় মেয়ের সিনড্রোম’ কোনো দুর্বলতা নয়, বরং তা নারীদের মধ্যে এক অনন্য শক্তি ও প্রজ্ঞার জন্ম দেয়। এই নারীরাই কীভাবে নিজেদের প্রগতিশীল সত্তা হিসেবে তুলে ধরছেন, তার কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক নিচে তুলে ধরা হলো:
-
সংহতি ও সহমর্মিতার শক্তি: ‘হোম গার্লস ইউনাইট’-এর মতো উদ্যোগগুলো প্রমাণ করে যে, নারীরা একে অপরের পাশে দাঁড়ালে কতটা শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে। বিভিন্ন দেশের, বিভিন্ন বয়সের নারীরা একত্রিত হয়ে তাদের ব্যক্তিগত সমস্যাগুলো ভাগ করে নিচ্ছেন এবং একে অপরকে মানসিক সমর্থন দিচ্ছেন। এটি প্রথাগত পারিবারিক কাঠামোর বাইরে গিয়ে একটি নতুন ‘সাপোর্ট সিস্টেম’ তৈরি করছে, যা নারীদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য অত্যন্ত জরুরি।
-
ক্ষমতায়ন ও সচেতনতা বৃদ্ধি: সামাজিক মাধ্যম, বিশেষ করে টিকটক, ‘বড় মেয়ের সিনড্রোম’ নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টিতে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এই প্ল্যাটফর্মে #EldestDaughterSyndrome হ্যাশট্যাগটি লক্ষ লক্ষ নারীর মধ্যে একাত্মতা তৈরি করেছে। তারা বুঝতে পেরেছেন যে তাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বিচ্ছিন্ন নয়, বরং এটি একটি বৈশ্বিক সমস্যা। এই সচেতনতা তাদের নিজেদের জন্য কথা বলতে, নিজেদের সীমানা নির্ধারণ করতে এবং নিজেদের মানসিক চাহিদাগুলো পূরণের দিকে মনোযোগী হতে সাহায্য করছে।
-
ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন এবং নেতৃত্বের বিকাশ: এই সিনড্রোমের কারণে নারীরা অল্প বয়সে যেসব দায়িত্ব পালন করেন, তা তাদের মধ্যে নেতৃত্ব, ব্যবস্থাপনা ও সমস্যা সমাধানের দক্ষতা তৈরি করে। তারা পরিবারের মধ্যে বিভিন্ন সংঘাতের মধ্যস্থতা করেন, ছোট ভাইবোনের দেখাশোনা করেন এবং আর্থিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভূমিকা রাখেন। এই অভিজ্ঞতাগুলো তাদের পেশাগত জীবনেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলে, যা তাদের আরও আত্মবিশ্বাসী ও সফল করে তোলে।
-
সাংস্কৃতিক বাধার বিরুদ্ধে লড়াই: অনেক ক্ষেত্রে, বড় মেয়েরা তাদের পরিবারের ঐতিহ্যবাহী মূল্যবোধ এবং নতুন সংস্কৃতির মধ্যে সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করেন। যেমন, আরব-আমেরিকান পরিবারের ওপর এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, বড় বোনেরা তাদের পরিবারকে নতুন সমাজের সঙ্গে মানিয়ে নিতে সাহায্য করেন। এই ভূমিকা পালন করতে গিয়ে তারা প্রায়শই নিজেদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও সাংস্কৃতিক প্রত্যাশার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে শেখেন, যা এক ধরনের নীরব বিপ্লব।
-
অর্থনৈতিক প্রগতিতে অবদান: শুধু মানসিক ও পারিবারিক ক্ষেত্রেই নয়, বড় মেয়েরা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। উদাহরণস্বরূপ, দক্ষিণ আফ্রিকায় এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, বড় বোনদের উপার্জন প্রায়শই ছোট ভাইবোনের শিক্ষা খরচ মেটাতে ব্যবহৃত হয়। একইভাবে, ফিলিপাইনের যেসব মায়েরা বিদেশে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করেন, তাদের বড় মেয়েরা ‘সারোগেট মাদার’ হিসেবে পরিবারের হাল ধরেন। এই নারীরা নীরবে তাদের পরিবারের অর্থনৈতিক ভিত্তি মজবুত করেন, যা একটি প্রগতিশীল সমাজের জন্য অপরিহার্য।
‘হোম গার্লস ইউনাইট’-এর সহ-পরিচালক সাহরা আবদুররেহমান-এর ভাষায়, “আমাদের লক্ষ্য হলো বড় মেয়েদের কেবল টিকে থাকার অবস্থা থেকে সত্যিকারের উন্নতি করার দিকে নিয়ে যাওয়া।” এই বার্তাটি কেবল যুক্তরাজ্যে নয়, সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে। এটি নারীদের শেখাচ্ছে যে, তাদের কাঁধে চাপানো বোঝা আসলে একটি শক্তির উৎস, যা দিয়ে তারা নিজেদের এবং সমাজের জন্য একটি উন্নত ভবিষ্যৎ গড়তে পারেন। মিডলইস্টআই
ইউ