
ফাইল ছবি
ঢাকা মেট্রোরেলকে বলা হয় ‘আধুনিক বাংলাদেশের পরিবহন বিপ্লব’। দ্রুততা, নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলার কারণে অল্প সময়েই এটি রাজধানীবাসীর অন্যতম ভরসা হয়ে উঠেছে। তবে সাম্প্রতিক একটি সিদ্ধান্ত যাত্রীদের মধ্যে বিতর্ক ও ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে।
কর্তৃপক্ষ এখন থেকে মেট্রোরেলের স্থায়ী (এমআরটি) পাসে ন্যূনতম ১০০ টাকা রিচার্জ করতে বলছে। আগে ২০ টাকাতেই যাত্রা শুরু করা যেত। কর্তৃপক্ষ বলছে এটি কেবল ‘অনুরোধ’, কিন্তু বাস্তবে অনেক স্টেশনে যাত্রীদের ‘বাধ্যতামূলকভাবে’ ১০০ টাকা দিতে হচ্ছে।
যাত্রীদের অভিজ্ঞতা: বাধ্যবাধকতায় ক্ষোভ
-
সচিবালয় স্টেশনে যাত্রী নাঈম মিয়া ২০ টাকা রিচার্জ করতে চাইলে কর্তব্যরত কর্মী তাকে ১০০ টাকা দিতে বাধ্য করেন।
-
নিয়মিত যাত্রী আসাদ আবেদীন জয় বলেন,
“প্রতিদিন যাতায়াত করি। হঠাৎ হাতে ১০০ টাকা না-ও থাকতে পারে। অথচ ওই দিন হয়তো মাত্র ১৫ টাকার প্রয়োজন। তখন কেন আমাকে ১০০ টাকা দিতে হবে?”
অভিযোগ আরও আছে—
-
১২০ টাকা দিলে কর্তৃপক্ষ ১০০ টাকা রিচার্জ করে বাকি ২০ টাকা ফেরত দিচ্ছে।
-
অনলাইনে রিচার্জের কোনো সুযোগ নেই।
-
কার্ড হারালে বা নষ্ট হলে সম্পূর্ণ ব্যালেন্স হারিয়ে যায়।
ফেসবুকভিত্তিক সংগঠন মেট্রোরেল প্যাসেঞ্জার্স কমিউনিটি–ঢাকা জানিয়েছে, এই বাধ্যবাধকতা ভোক্তা অধিকারের স্পষ্ট লঙ্ঘন।
কর্তৃপক্ষের যুক্তি: খুচরা ও ভিড়ের ঝামেলা
মেট্রোরেল কর্মীরা বলছেন—
-
২০ বা ৫০ টাকা রিচার্জ করলে যাত্রীরা বারবার কাউন্টারে ভিড় করেন।
-
এতে খুচরার ঝামেলা হয়, লাইনে ভিড় বাড়ে।
-
এজন্য এমডি যাত্রীদের ন্যূনতম ১০০ টাকা রিচার্জ করার ‘অনুরোধ’ করেছেন।
তাদের দাবি, নিয়মে ছোট অঙ্ক রিচার্জের সুযোগ আছে। কিন্তু বাস্তবে কর্মীদের অনেকেই এই অনুরোধকে ‘বাধ্যতামূলক’ করে তুলছেন।
অর্থনীতি–সমাজবিজ্ঞানীদের বিশ্লেষণ
বাংলাদেশের নগরবাসীর বড় অংশ নিম্ন বা মধ্যবিত্ত শ্রেণির। গড় মাসিক বেতন ১০–১৫ হাজার টাকা। গবেষকদের মতে—
১। আয় ও ব্যয় সংকট: প্রতিদিনের খরচ সামলাতে গিয়ে অনেকেই নগদ অর্থ সংকটে ভোগেন। তখন ২০–৫০ টাকা রিচার্জই প্রয়োজন মেটাতে যথেষ্ট।
২। মনোপলি আচরণ: বাধ্যতামূলক ১০০ টাকা রিচার্জ আসলে যাত্রীদের ওপর আর্থিক চাপ সৃষ্টি করছে। এটি গণপরিবহন সেবাকে ব্যয়বহুল করে তুলছে।
৩। ভোক্তা অধিকার লঙ্ঘন: যাত্রী যদি ভাড়া দেওয়ার মতো টাকা রাখেন, তবে তাকে জোর করে বেশি টাকা রিচার্জ করাতে বাধ্য করা অযৌক্তিক।
৪। ডিজিটাল ঘাটতি: অনলাইন বা মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) দিয়ে রিচার্জ চালু থাকলে ছোট রিচার্জের ঝামেলা এড়ানো যেত।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির মতামত
যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন—
-
মেট্রোরেল বোর্ডে যাত্রী প্রতিনিধি রাখা হয়নি। ফলে সিদ্ধান্ত হয় একতরফা।
-
শুধু রিচার্জ নয়, শৌচাগারের খরচ বাড়ানো ও সময়সূচি না মানার মতো নানা সমস্যা যাত্রীদের ক্ষুব্ধ করছে।
-
“অভিযোগ জানালেও কর্তৃপক্ষ সাড়া দেয় না, যাত্রীদের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি উদাসীন।”
সম্ভাব্য সমাধান
বিশেষজ্ঞ ও যাত্রী অধিকার সংগঠনগুলো বলছে—
-
ন্যূনতম রিচার্জ পুনর্বিবেচনা: যাত্রীদের হাতে থাকা অর্থ বিবেচনায় ২০ টাকা থেকে রিচার্জের সুযোগ ফিরিয়ে আনা উচিত।
-
অনলাইন রিচার্জ চালু করা: মোবাইল ব্যাংকিং, ক্রেডিট-ডেবিট কার্ড বা অ্যাপভিত্তিক রিচার্জ ব্যবস্থা চালু করলে খুচরার ঝামেলা কমবে।
-
কার্ড রিপ্লেসমেন্ট চালু করা: যাতে হারিয়ে গেলে যাত্রীরা অর্থ হারান না।
-
বোর্ডে যাত্রী প্রতিনিধি রাখা: নীতিনির্ধারণে যাত্রীদের মতামত প্রতিফলিত হবে।
-
স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি: কর্মীদের ‘ক্ষমতা প্রদর্শন’ বন্ধ করতে নিয়ম বাস্তবায়ন স্বচ্ছ হওয়া জরুরি।
উপসংহার
মেট্রোরেল বাংলাদেশের গণপরিবহনে এক অনন্য সংযোজন। কিন্তু এর সুফল ভোগ করতে হলে যাত্রীবান্ধব নীতি গ্রহণ অপরিহার্য। ন্যূনতম ২০ টাকা রিচার্জের সুযোগ ফিরিয়ে না আনলে এবং অনলাইন সুবিধা চালু না করলে এটি ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যেতে পারে।
মেট্রোরেল যদি সত্যিই ‘জনগণের পরিবহন’ হতে চায়, তবে যাত্রীদের আর্থসামাজিক বাস্তবতাকে অগ্রাধিকার দিতেই হবে।
ইউ