
ছবি: উইমেনআই২৪ ডটকম
জুলাই গণঅভ্যুত্থান এর একবছর পেরিয়ে গেলেও বৈষম্যহীন এবং পরিকল্পিত বাংলাদেশ গড়বার আকাঙ্খার অগ্রগতি এখনো সেভাবে পরিলক্ষিত হয়নি। অর্থনৈতিক সূচকে বেশ কিছুটা সাফল্য এসেছে। মানুষ এখন আগের চেয়ে স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করতে পারছে৷ বিপরীতে মানুষের যাপিত জীবনের সমস্যা সমাধানে সরকারের উদ্যোগ অনেকটাই সীমিত। অনেক সংস্কার কমিশন হলেও শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সংস্কার নিয়ে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। আমলাতন্ত্রের যথাযথ সংস্কার ও জনবান্ধব করবার উদ্যোগ স্তিমিত হয়ে গিয়েছে। তারপরও জুলাই গণঅভ্যুত্থান এ ছাত্র জনতার আত্মত্যাগকে যথাযথ স্মরণ করে বৈষম্যহীন ও পরিকল্পিত বাংলাদেশ গড়তে সবার ঐক্যবদ্ধ হবার কোন বিকল্প নেই।
২০ জুলাই (বুধবার) সকাল ১০ টায় বিআইপির আয়োজনে “জুলাই গণঅভ্যুত্থানঃ বৈষম্যহীন ও পরিকল্পিত বাংলাদেশ গড়বার প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি” শীর্ষক জুলাই সংলাপে বিশিষ্টজনেরা এ মন্তব্য করেন ।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান এর সভাপতিত্বে সংলাপে অংশ নেন শহীদ সাংবাদিক তাহির জামান প্রিয়ের মা ও জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক শামসি আরা জামান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. গোলাম রাব্বানী, সংবিধান সংস্কার কমিশনের সদস্য ফিরোজ আহমেদ, বুয়েট এর উপ উপাচার্য অধ্যাপক ড. আব্দুল হাসিব চৌধুরী, স্থপতি ফারহান শারমিন, পিআইবি মহাপরিচালক ফারুক ওয়াসিফ, বিআইপির সহ-সভাপতি, সৈয়দ শাহরিয়ার আমিন।
এছাড়াও সংলাপে অংশ নেন,
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড (টিবিএস) এর সাংবাদিক জাহিদুল ইসলাম,
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের শিক্ষার্থী মোঃ জুনায়েদ ইসলাম, পরিকল্পনাবিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থী সাব্বির আহমেদ লিয়ন প্রমুখ।
অধ্যাপক ড. গোলাম রাব্বানী জানান, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ছাত্রদের উপর গণহত্যা বন্ধ করতে তিনি একজন শিক্ষক হিসেবে নিজের দায়িত্ব পালন করবার চেষ্টা করেছেন। সেই সময় গবেষণার মাধ্যমে তিনি দেখেন, যেসব শিক্ষার্থীর জন্য আন্দোলন করেছিলেন পরে বিভিন্নভাবে তাদের অনেকেই জুলাই গনঅভ্যুত্থানে নিজের অবদান নিয়ে স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করছে। তিনি আরও বলেন, জুলাই আন্দোলনে আহত ও প্রতিবন্ধী হয়ে যাওয়া মানুষরা সরকারের যথাযথ মনোযোগ পায়নি।
ফিরোজ আহমেদ বলেন, রাষ্ট্রীয় আইন ভাঙা হলে তা দেশের জন্য ক্ষতিকর এবং সরকার এ বিষয়ে পদক্ষেপ না নিলে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাবে। তিনি আরও বলেন, পুলিশের দায়িত্বশীলতার অভাব, দুর্নীতি ও বিদেশি ঋণের অপব্যবহার প্রমাণ করে যে দেশে এখনো ফ্যাসিবাদের প্রভাব গভীর।
ফারুক ওয়াসিফ বলেন, এই অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আমরা শুধু সংস্কার চাই নি, চেয়েছিলাম ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার পরিবর্তন। এই সরকার তার প্রতিশ্রুতি পালন করতে সেভাবে সফল হয়নি, যার মূল কারন প্রতিদিন বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে বিপ্লব। বিপ্লব ঠেকানোর দায়ভার সরকারের পাশাপাশি আমাদের নিজেদের নিতে হবে।
অধ্যাপক ড. আব্দুল হাসিব চৌধুরী বলেন, মানুষের মনস্তত্ত্ব ও জমিন বিগত সরকারের বিরুদ্ধে চলে যায় এবং তার ফলশ্রুতিতেই জুলাই আন্দোলন হয়েছে। তিনি জানান, আমাদের দেশে অনেক গণঅভ্যুত্থান হয়েছে কিন্তু রাজনৈতিক গণঅভ্যুত্থান হয় নি। যার ফলে, দেশে অনার্জিত আয়ের ফলে সৃষ্ট বৈষম্য উচ্ছেদ করা যায় নি। লিখন শিকদার, তার বক্তব্যের মাধ্যমে পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জুলাইয়ের দিনগুলির স্মৃতিচারণ করেন।
তিনি বলেন, আমরা আন্দোলন করেছি বৈষম্যকে সমুলে উৎপাটন করার জন্য। কিন্তু বছর ঘুরে আমরা যখন আবার দেখি নতুন করে বৈষম্যের বীজ বপন চলছে তা আমাদের ব্যাথিত করে।
স্থপতি ফারহান শারমিন বলেন, জুলাই আন্দোলনের পর,সরকারি হাসপাতালের ৮০ থেকে ৯০ ভাগ আহত ব্যক্তি ছিলেন যারা অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের সন্তান, কিন্তু পরবর্তীতে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে পুনর্বাসন ও চিকিৎসার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেয়া হয় নি। আহতদের তালিকা ভুক্তিতেও দেখা গিয়েছে দীর্ঘসুত্রীতা, যা অত্যন্ত দুঃখজনক।
সৈয়দ শাহরিয়ার আমিন তার সমাপনী বক্তব্যে বলেন, ২০২৪ এর জুলাই আগস্টে যা হয়েছে তা পুরো জাতির বিবেককে নাড়া দিয়ে গেছে। আমাদের দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজব্যাবস্থা থেকে শুরু করে প্রতিটি ক্ষেত্রে বৈষম্য এখনো বিদ্যমান। সরকারি নানা দপ্তরে এখনও স্যার না বলার অপরাধে তুলকালাম কান্ড বেধে যায়। নিরপেক্ষ ভাবে ইতিহাস লেখা খুব কঠিন একটা কাজ, কেননা লেখকের ব্যাক্তিগত চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গির উপর ভিত্তি করে ইতিহাস বিভিন্ন দিকে মোড় নিতে পারে। আমরা যদি ইতিহাস ও ঘটনাপ্রবাহকে নৈমিত্তিক ভাবে বিশ্লেষন করতে পারি, সেটাই হবে আমাদের প্রাপ্তি, সেটাই হবে আমাদের অর্জন।
অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র, সুবিধাবাদী ব্যবসায়ী এবং নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমের আঁতাতের কারণেই জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র জনতার আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন করা সম্ভবপর হয়নি। সকলের জন্য মানসম্মত আবাসন, নাগরিক সুবিধাদি, দেশের বিভিন্ন এলাকার সুষম উন্নয়ন নিশ্চিত করতে এখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখা যায়নি। ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) সহ বিভিন্ন নীতি পরিকল্পনা প্রণয়নে আগের মতই ব্যবসায়ী গোষ্ঠীদের স্বার্থ রক্ষায় রাষ্ট্রকে তৎপর দেখা যাচ্ছে। এর বিপরীতে রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য সাম্য ও ন্যায্যতাভিত্তিক, দুর্নীতিমুক্ত, শোষণহীন, জবাবদিহিতামূলক এবং জ্ঞানভিত্তিক পরিকল্পিত ও টেকসই বাংলাদেশ পুনর্গঠনকে প্রাধিকার দিতে হবে। জুলাই গণঅভ্যুত্থান এ জন আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে গোষ্ঠীস্বার্থের বিপরীতে জনস্বার্থ এবং টেকসই উন্নয়ন ও পরিবেশ সুরক্ষাকে গুরুত্ব দিতে হবে।
মো. জুনায়েদ ইসলাম জুলাই গণঅভ্যুত্থানে তার অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। তিনি জানান, তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল ও তাদের সহযোগী ছাত্র সংগঠনের কারণে দেশের বিভিন্ন স্থানের মতো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও হামলার শিকার হয়েছিলেন। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সাধারণ মানুষের যে প্রত্যাশা ছিল স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের সুযোগ, নিজের অধিকার ফিরে পাওয়া এবং একটি নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা তা বাস্তবায়নে সবাই সম্মিলিতভাবে কাজ করবেন।
সাব্বির আহমেদ লিয়ন বলেন, যিনি জুলাই আন্দোলনে অংশগ্রহণের কারণে নির্যাতনের শিকার হয়ে কারাবরণ করেন। তিনি বলেন, জুলাই আন্দোলনে সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ তাকে বৈষম্যের বিরুদ্ধে এই সংগ্রামে শামিল হওয়ার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। তিনি আশা প্রকাশ করেন, তার মতোই বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ যে বৈষম্যহীন বাংলাদেশের প্রত্যাশায় ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন, সেই সাম্য ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়তে সবাই অব্যাহতভাবে কাজ করবেন।
তিনি জানান, ১৯ জুলাই শহিদ প্রিয়র মৃত্যুর পরদিন থেকেই পরিবারকে মিথ্যা মামলা, হুমকি ও বাসায় হামলার মাধ্যমে হয়রানির শিকার হতে হয়। পরবর্তীতে এ হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে পরিবার ঢাকার নিউমার্কেট থানা ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা দায়ের করে। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বিচারপ্রক্রিয়ার ধীরগতিতে শহীদ পরিবারগুলো গভীরভাবে হতাশ। তিনি আশা প্রকাশ করেন, ন্যায্যতা, দুর্নীতিমুক্তি, শোষণমুক্তি, জবাবদিহিতা এবং জ্ঞানভিত্তিক পরিকল্পনার ভিত্তিতে একটি টেকসই বাংলাদেশ গড়ে তোলার সংগ্রামে বিআইপি ভবিষ্যতে সক্রিয়ভাবে পাশে থাকবে।
জাহিদুল ইসলাম বলেন, পেশাজীবীদের ফ্যাসিবাদ এখনো কাটেনি, যা আমরা দেখতে পাচ্ছি ড্যাপ সংস্কার উদ্যোগে। সেখানে মূলত ভবনের উচ্চতার দিকেই জোর দেওয়া হচ্ছে, অথচ শহরের বাসযোগ্যতা, সকলের জন্য নাগরিক সুযোগ-সুবিধাদি নিশ্চিত করার জন্য দৃশ্যমান উদ্যোগ নেই।
ইউ