ঢাকা, বাংলাদেশ

রোববার, , ১১ মে ২০২৫

English

সাহিত্য

সত‍্যজিৎ রায় : আমার স্মৃতিতে

মলয়চন্দন মুখোপাধ‍্যায়

প্রকাশিত: ১৫:০৬, ৩ মে ২০২৩

সত‍্যজিৎ রায় : আমার স্মৃতিতে

ফাইল ছবি

আমার দেখা প্রথম সিনেমা সত‍্যজিৎ রায়ের ' পথের পাঁচালী '। সম্ভবত 1958/59 সালে। তখন পাড়ায় পাড়ায় মাঠে ঘেরাও দিয়ে সাত বা দশদিন ধরে সিনেমা দেখানো হতো। মাঠে দেখানো হতো বলে কলকাতার সম্ভ্রান্ত সিনেমাহল মেট্রোকে মনে রেখে রসিকজনেরা একে বলতেন ' মেঠো হল '। টিকিটের হার ছিল ঊনিশ পয়সা। ঊনিশ কেন? ওর বেশি দাম হলে সরকারকে ট‍্যাক্স দিতে হতো। ট‍্যাক্স ফাঁকি দেবার যথোপযুক্ত ব‍্যবস্থাও রাখা হতো। আট আনা , অর্থাৎ এখনকার পঞ্চাশ পয়সার ' গেস্ট কার্ড ' ছিল। সেসব কার্ডে টিকিটের দাম লেখা থাকতো না। যেসব ক্লাবের তরফ থেকে সিনেমার এই প্রদর্শনী , তাদের তো যথোচিত লাভ থাকা চাই , নইলে মুনাফার টাকায় ক্লাবে ব‍্যায়ামাগার , লাইব্রেরি ব‍্যান্ড পার্টি, ফুটবল ও ক্রিকেট - সরঞ্জাম কেনার পয়সা আসবে কোথ্থেকে?ঊনিশ পয়সার দর্শকরা , নিতান্ত কচিকাঁচারা বসতো মাঠে চট বিছানো অংশে। আট আনার দর্শকদের জন‍্য ছিল চেয়ার। চেয়ারে না বসে মুরুব্বি ও বয়স্থা মহিলাদের পক্ষে নিপাট চটে বসে সিনেমা দেখা সম্ভব - ও ছিল না আসলে।

সে যাই হোক , আমার তখন আট - ন বছর বয়স। সিনেমা দেখার , তার রসাস্বাদনের বিন্দুমাত্র অভিজ্ঞতা বা বোধবুদ্ধি জন্মায় নি তখন। দূরদর্শনের আগমন ঘটতে ঢের দেরি। আমার সেজদা ছোট ভাইটিকে নিয়ে গিয়েছিল বলে যাওয়া ও দেখা। গেটে ভয়াবহ ভীড় আর দম বন্ধ হয়ে আসার মতো পরিস্থিতি , এছাড়া মনে আছে কাশবনের মধ‍্য দিয়ে ট্রেন যাচ্ছে , ব‍্যস। আরো দুটি ছবি দেখা কপালে জুটেছিল সেবার। ' বাবলা ' আর ' দেবদাস '। সুচিত্রা - দিলীপকুমারের দেবদাস। পরে একাধিকবার ছবিটি দেখতে গিয়ে অধীর অপেক্ষা করতাম , শিক্ষককে চুনের ভিতর ফেলে দেবার দৃশ‍্যটি কখন আসবে। ওই দৃশ‍্যটাই মনে ছিল বলে।

সত‍্যজিৎ রায় নিয়ে লিখতে বসে উপক্রমনিকা হিশেবে একথা লিখলাম এ কারণেই , এই বিশ্বখ‍্যাত পরিচালক ,.আমার সজ্ঞানে না হোক অবচেতনে ঢুকে গিয়েছিলেন ঐ বয়সেই। সত‍্যজিৎ রায়কে দেখেছি অনেকবার , তাঁর সঙ্গে কথা বলার - ও সৌভাগ্য হয়েছে বেশ কয়েকবার। সে - সম্পর্কে লেখার আগে তাঁকে একটু একটু করে জানলাম বুঝলাম চিনলাম কীভাবে , সেটা জানানো যাক।

' পথের পাঁচালী ' দেখার পর সত‍্যজিতের নামমহিমার দু - তিনটি ঘটনা স্মৃতিধার্য হয়ে আছে আমার। ১৯৬১- তে রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আয়োজনে রবীন্দ্রজয়ন্তী পালিত হবে , তার কার্ড আমার মেজদা দেখালো। সেখানে রবীন্দ্রনাথের ছবি। পোর্ট্রেট। একদিকে কবির দাড়িসহ মুখ , বিপরীতে কেশরাশিকে একটি পাখির আদল দেওয়া। ছবিটি আমাকে এতোটাই মুগ্ধ করেছিল যে আমি বহুবার ছবিটি আঁকতাম। সে - বছরেই সম্ভবত মুক্তি পায় ' তিনকন‍্যা '। ছবিটির বিজ্ঞাপন টাঙানো দেখতাম আমাদের স্কুলের দেয়ালে।

পরের স্মৃতি ১৯৬২/৬৩ - র। ভারত - চীন যুদ্ধে আর্থিক সাহায‍্যদানে এগিয়ে এসেছিলেন কলকাতা ও বম্বের ( অধুনা মুম্বাই ) চলচ্চিত্র জগতের বিখ‍্যাতজনেরা। কলকাতার ইডেন উদ‍্যানে বম্বে ও কলকাতার চলচ্চিত্রবুধজনদের মধ‍্যে একটি ক্রিকেট ম‍্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। পরদিন কাগজে তার যে ছবি বেরিয়েছিল, সেখানে ক্রিকেটখেলার পোষাকে ব‍্যাট - হাতে সত‍্যজিতের ছবি আমাকে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট করে, কেননা ঐ বয়সে ক্রিকেটের প্রতি আমার ভালোবাসা গভীর হয়ে উঠেছিল। ক্রিকেট খেলতাম , ধারাবিবরণী শুনতাম। পরে জেনেছি , সত‍্যজিতের পরিবারের সঙ্গে ক্রিকেট কতোটা ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল।
পরের ঘটনা ১৯৬৪ - র। আমার দুই দাদা আর এক মাসতুতো ভাই সত‍্যজিৎ রায়ের ' নায়ক ' নিয়ে তুমুল বাকবিতণ্ডায় মত্ত। নাবালক আমি কৌতূহল নিয়ে শুনছি , যদিও মূল বিষয়টা ধরতে পারছি না। এমন সময় আমার মাসতুতো ভাই আমাকে এক ধমক , বড়োদের আড্ডায় নাক গলানো কেন? তখন আমার বয়স যদিও চোদ্দ , তবু অপমান বোধ হলো ওদের আসর ছেড়ে চলে আসার সময়। আর তৎক্ষণাৎ প্রতিজ্ঞা করলাম , কী আছে সত‍্যজিতের ছবিটিতে? আমাকে দেখতেই হবে। ক্লাস এইটের আমি পরদিন - ই চলে গেলাম গড়িয়ার পদ্মশ্রীতে।ছবিটবি না দেখলেও সেই বয়সে আনন্দবাজার ও দেশ - এ রীতিমতো সিনেমাসংক্রান্ত খবরাখবর পড়তাম। ছবি দেখা , ওই বয়সে , আমাদের সময় , অভিভাবকদের এড়িয়ে , বেশ দুরূহ ছিল। আরো বিপদাশঙ্কা , হলে যদি পাড়ার কোনো বয়স্ক লোকের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় ! তিনি তো আমার নৈতিক অধ: পতন আমার অভিভাবকদের না বলে ছাড়বেন না!

দেখলাম। বুঝলাম সামান‍্যই। তবে অনুভব করলাম , এক মহৎ শিল্পের সঙ্গে সাক্ষাৎ পরিচয় ঘটলো। সত‍্যজিৎ হৃদয়ে গ্রথিত হলেন। এজন‍্য ধন‍্যবাদ প্রাপ‍্য আমার সেই মাসতুতো দাদার , যাঁর ধমক না খেলে এভারেস্টদর্শন পিছিয়ে থাকতো বহুদিন।

ভূমিকা ছিল ' সন্দেশ ' -এরও। ১৯৬১ থেকে ওটা আবার বেরোতে শুরু করে। গোড়ায় উপেন্দ্রকিশোর ও পরে সুকুমার রায় বের করতেন। শুরু হয়েছিল ১৯১৩ থেকে। মাঝখানে বন্ধ ছিল বহুদিন। ছোড়দা কিনে আনতো। প্রচ্ছদের অভিনবত্ব , লেখক এবং লেখার বৈচিত্র্য মুগ্ধ করতো। মনে আছে , পাখি নিয়ে লিখতেন অজয় হোম। ' মালশ্রীর পঞ্চতন্ত্র , ' - গৌরী ধর্মপাল। ছোটদের লেখালেখির সুযোগ ছিল ' হাত পাকাবার আসর ' - এ। কয়েকবার পাঠিয়েছিলাম লেখা , ছাপা হয়নি যদিও। আর থাকতো ধাঁধা। সম্পাদনায় সত‍্যজিৎ ছাড়াও লীলা মজুমদার এবং নলিনী দাশ। এ '- পত্রিকাটির মাধ‍্যমেই প্রথম সত‍্যজিৎ রায়ের লেখার সঙ্গে পরিচিত হই। যেদিন পত্রিকাটিতে প্রথম শঙ্কুকাহিনী পড়লাম , - ' ব‍্যোমযাত্রীর ডায়েরী ' , অভূতপূর্ব আনন্দ পেয়েছিলাম। তাছাড়া তাঁর ফেলুদা কাহিনী , একের পর এক ছোটগল্প আনন্দের জোয়ারে ভাসিয়ে নিয়ে যেতো। পত্রিকায় তাঁর করা প্রচ্ছদ আর অলঙ্করণগুলিও ছিল তুলনারহিত। পরে অবাক হয়েছি ভেবে , ফেলুদা মূলত কিশোরপাঠ‍্য গোয়েন্দাকাহিনী হলেও বয়স্কপাঠ‍্য শারদীয় ' দেশ ' - এ কী করে বছরের পর বছর স্থান পেতো ফেলুদার রহস‍্য এ‍্যাডভেঞ্চার?

সত‍্যজিৎ রায়কে প্রথম দেখলাম ' প্রতিদ্বন্দ্বী ' দেখতে গিয়ে। তখন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সেখানকার ফিল্ম ক্লাবে নিয়মিত দেশি - বিদেশি ছবি , - কুরোসাওয়া , বার্গম‍্যান , ত্রুফো , দভচেঙ্কো আইজেনস্টাইন দেখি। হলিউড ও কিছু কিছু বম্বের ছবি , টালিগঞ্জের। ' প্রতিদ্বন্দ্বী ' দেখতে গেলাম দক্ষিণ কলকাতার বিজলী হলে। সঙ্গে দুই দাদা।

ছবি শেষ হতে ব‍্যালকনি দিয়ে নামবো , দেখি বিশালদেহী সত‍্যজিৎ দাঁড়িয়ে , দর্শকদের প্রতিক্রিয়া জানছেন। অনেকে ছবি নিয়ে প্রশ্ন করছেন , উত্তর দিচ্ছেন তাঁর ওই গম্ভীর গলায়। সত‍্যজিৎকে প্রথম দেখা , স্বভাবতই একটু নার্ভাস। কিন্তু অচিরেই কাটিয়ে উঠলাম। ইচ্ছে হলো আমিও প্রশ্ন করি। মাথায় খুব দ্রুত এসে গেল প্রশ্নটা। নকশাল আন্দোলনের পরেকার ছবি। মূল উপন‍্যাসে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নকশালবাড়ির পটভূমি এনেছেন। ছবিতে সত‍্যজিৎ - ও। বস্তুত নকশালবাড়ি মৃণাল - ঋত্বিক - উৎপলেন্দু সহ অনেক পরিচালকের ছবিতেই নানান মাত্রায় এসেছে। সত‍্যজিতের ছবিটিতে নায়ক সিদ্ধার্থর ভাই বাড়ি ছেড়ে গ্রামে চলে যাচ্ছে আন্দোলনে যোগ দিতে। বড়োভাই যাত্রামুহূর্তে ছোটভাইকে চে গুয়েভারার ডায়েরি উপহার দিল। সে সময় নকশালবাড়ি করি না করি , আমাদের কাছে অবশ‍্যপাঠ‍্য ছিল মাও সে তুঙ - এর রেড বুক। ছবি দেখার সময় মনে হচ্ছিল , সিদ্ধার্থ ভাইকে মাও সে তুঙ দিল না কেন? সেই প্রশ্নটি - ই করে বসলাম সত‍্যজিৎকে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে , যেন জানতেন এই প্রশ্নটি - ই করবো তাঁকে , উত্তর দিলেন , ' বড়ো ভাই ছোটভাইকে উপহার দিয়েছে , তার কারণ আমি কী করে বলবো?' প্রত‍্যুৎপন্নমতিত্ব! আমি থ ! এই হলো তাঁকে প্রথম দেখা ও কথা বলার ইতিহাস। ' নায়ক '- পরবর্তী সব ছবি - ই দেখতাম রিলিজ করা মাত্র। একাধিকবার। তাঁকে দেখা এই প্রথম।

এর পর তাঁর সঙ্গে দেখা অভিনেতা - পরিচালক দিলীপ রায়ের পরিচালনায় ' অমৃতকুম্ভের সন্ধানে ' ছবির প্রিমিয়ার শো দেখতে গিয়ে। দক্ষিণ কলকাতার উজ্জ্বলা সিনেমাহলে। তিনি ও স্ত্রী বিজয়া রায় দুজনেই এসেছিলেন। এসেছিলেন বিখ‍্যাত অনেক অভিনেতা - অভিনেত্রী আর সমালোচক- সাহিত‍্যিকরা।

তাঁকে দেখলাম ছবি শেষ হওয়ার পর। ব‍্যালকনি থেকে নামছেন। আমিও। দুজনেই যখন মাঝপথে, তাঁর গতিরোধ করে ঢিপ করে এক প্রণাম। উনি ' না না, এটা পাবলিক প্লেস ' বলে আমাকে বাধা দিতে উদ‍্যত। আমি প্রণাম সেরে বললাম , সত‍্যজিৎ রায়কে যে - কোনো জায়গাতেই প্রণাম দেওয়া যায়। ' বলতেই তাঁর কথাটির তাৎপর্য টের পেলাম। জনসাধারণের সামনে একবার কেউ প্রণাম দিলে সঙ্গে সঙ্গে প্রণাম দেবার বন‍্যা বয়ে যেতে পারে, এই আশঙ্কা থেকেই সম্ভবত তাঁর ওই উক্তি।

যাই হোক , তাঁর সঙ্গে কথা বলার মোক্ষম সুযোগ মিললো। আর কথা বলার, কিছু জিগ‍্যেস করার জরুরিত্ব - ও ছিল। তা যে দৈবক্রমে ঐদিন - ই জুটবে আমার বরাতে , ঘূণাক্ষরেও ভাবতে পারি নি।

সময়টা ছিল দুর্গাপুজোর কাছাকাছি সময়ের। শারদীয় ' আনন্দমেলা ( না কি ' দেশ '? ফেলুদা , না শঙ্কুকাহিনী? সঠিকভাবে এখন মনে পড়ছে না। তবে যে - কোনো একটায় অবশ‍্যই) ' আর ' এক্ষণ ' পত্রিকায় ওঁর দুটি লেখা সদ‍্য পড়েছিলাম। ' এক্ষণ ' পত্রিকায় ওঁর লেখা নয় ঠিক , পিতা সুকুমার রায়ের সত্তরের ওপর পারিবারিক চিঠি , সঙ্গে সত‍্যজিতের কিছু মন্তব‍্য ছিল। বিলেত থেকে লেখা সুকুমার রায়ের চিঠিগুলি অন‍্য এক মানুষকে আমাদের সামনে হাজির করে , - প্রিন্টিং টেকনোলজির অগাধ পড়ুয়া , লন্ডনে বসে কলকাতা থেকে প্রকাশিত ' তত্ত্ববোধিনী ' পত্রিকাটি নিয়মিত পেতে উৎসুক , এমন মানুষ। চিঠিগুলি দ্রুত শেষ করে ভাবছিলাম , সুকুমার রায়ের লেখা চিঠি কি আরো আছে ? পড়লে মন্দ হতো না। যেমন বিলেতবাসের সময়তেই রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লেখা সুকুমারের একটি অতীব পাণ্ডিত্যপূর্ণ লেখা পড়ে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। রবীন্দ্রনাথ তখন বিলেতে। ১৯১২ সাল। অচিরেই নোবেল পাবেন। কিন্তু কে দেবে উত্তর?

উত্তরদাতা তো এখন আমার সামনেই , আশ্চর্যজনকভাবে। অতএব প্রশ্নটি শুধোলাম। বললেন , ' না , আর নেই। ওই চিঠিগুলোই সব।' সংক্ষিপ্ত উত্তর।

'এবারের লেখায় আপনি যে একটি ভুল করে বসে আছেন' , বললাম।
'ভুল? আমার লেখায়? কীরকম? কোথায় ভুল ? ' বেশ চিন্তিত , কৌতূহলী এবং সপ্রশ্ন তিনি। আমি জানি , মহৎ লোকের - ও , ওই যাকে বলে ' মুনিনাঞ্চ মতিভ্রম: ' হয় , ' To err is humane '. সজনীকান্ত দাস রবীন্দ্রনাথের লেখায় ভুল ধরেছিলেন। আমার হাতে এখন তুরুপের তাস।
'আপনি লেখেন নি , ' পৃথিবীর নিকটতম নক্ষত্র প্রক্সিমা সেন্টরি?' অত‍্যন্ত আত্মবিশ্বাস নিয়ে প্রশ্ন আমার।
' হ‍্যাঁ। সেটাই তো। তাতে ভুল কোথায়? '
' কেন , সূর্যটা কি তবে বাদ?'
মুহূর্তে বুঝতে পারলেন , ভুল হয়ে গেছে বিলকুল। অট্টহাসি। আর পাবলিকলি আমার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললেন ,' এগজাক্টলি। বই বেরোবার পর শুধরে দেবো'।

বেলা দ্বিপ্রহর। স্ত্রী তাড়া দিচ্ছেন। আর আমার সে - মুহূর্তে প্রশ্ন - ও ছিল না কিছুই। প্রশ্ন থাকবে কী? রাজ‍্যজয় তো হয়েই গেছে ,- সত‍্যজিতের লেখার ভুল ধরা!

এরপর দেখা বিখ‍্যাত আলোকসম্পাতশিল্পী তাপস সেনের নাকতলাস্থ বাড়িতে। উপলক্ষ্য তাপসপুত্র জয়ের বিয়ে। জয়ের স্ত্রী সুমিত্রা ছিল আমার বন্ধু দীপঙ্করের বোন। সেইসূত্রে নিমন্ত্রিত ছিলাম আমি।

সে - রাতটিও ছিল তারকাখচিত। কিন্তু আমার কাছে প্রকৃত নক্ষত্র হয়ে উঠলেন সত‍্যজিৎ। একান্তে বসেছিলেন। তাঁর সামনে কেউ আসছিল না। ভাবলাম , এই তো মওকা। গিয়ে যথারীতি প্রণাম দিয়ে তাঁর পাশের একটি চেয়ারে বসলাম।
প্রশ্ন তো হাজার। কী দিয়ে শুরু করি ? ভাবতেই জিজ্ঞাসা , ' আচ্ছা , মহাভারতের কাহিনী নিয়ে ছবি করবেন বলেছিলেন। কবে পাচ্ছি সেটা?'

'না, ক‍্যানসেল। মহাভারতের পাশা খেলার এপিসোডটা নিয়েই ছবি করবো ভেবেছিলাম। ' আসলে তাঁর ছবি করার সমান্তরালে ছবি তৈরি না করতে পারার - ও বেদনাতুর ইতিহাস আছে। ইচ্ছে ছিল ' দেবী চৌধুরাণী ' করার , সায়েন্স ফিকশন ' ই টি ' করার , বিভূতিভূষণের ' দ্রবময়ীর কাশীবাস ' , ' ইছামতী ' বানাবার , সেলিনা হোসেনের ' হাঙর নদী গ্রেনেড ' করার , ই. এম. ফরস্টারের ' A Passage to India ' সহ আরো কতো ছবি তৈরির ! নানাকারণেই হয়ে ওঠে না।

সত‍্যজিৎ আত্মজীবনী লেখেন নি। জানতে চাইলাম। কেন লিখছেন না? নিশ্চয়ই সাগরময় ঘোষ তাগাদা দিচ্ছেন?
' দিচ্ছেন না আবার! খুব দিচ্ছেন। আমি তো লিখেছি , ঐ যে- '
' যখন ছোট ছিলাম? সে তো বাচ্চাদের জন‍্য। আমরা চ‍্যাপলিনের আত্মজীবনী পেয়েছি , বার্গম‍্যানের ' Magic Lantern , কুরোসাওয়ার ' Something like an Autobiography , আর আপনারটা পাবো না?

নীরব রইলেন খানিক। ' বরং অন‍্য একটা লেখা লিখবার কথা ভাবছি। সিনেমার কলাকৌশলগত দিক নিয়ে একটা বই। সেটা খুব জরুরি।'

কিন্তু সে - বইও তাঁর কাছ থেকে পাইনি। তাঁর সঙ্গে এবারের সাক্ষাতের আগেই ' একেই বলে শ‍্যুটিং ' বেরিয়ে গেছে। ওখানে বিষয়টি নিয়ে যৎসামান‍্য আলোচনা থাকলেও বিস্তৃত আকারে নেই।

সেদিনকার কথাবার্তা ঐখানেই শেষ।খেতে বসলেন উনি। বসেছিলেন বুফেতে। আমার ভুল হয়েছিল সে - রাতে তাঁর খাদ‍্যসঙ্গী না হয়ে। তাঁর পছন্দের খাবার দেখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলাম!

অন্তিম সাক্ষাৎ সত‍্যজিতের বাড়ি বিশপ লেফ্রয় রোডে। আমার বন্ধু ফিরদাউস লন্ডন গেলে সত‍্যজিতের জন‍্য কিছু জিনিশ এ‍্যন্ড্রু রবিনসন ওর হাত দিয়ে সত‍্যজিৎকে পাঠিয়েছিলেন। রবিনসন , আমরা জানি , সত‍্যজিতের জীবনীকার ও ওঁর ছবির ওপর গবেষক। ফিরদাউস আমাকে নিয়ে গিয়েছিল।

দুপুর। ঐ সময়টাতেই যেতে বলেছিলেন , তাঁর সঙ্গে ফোনে যখন এপয়েন্টমেন্ট চাওয়া হয়। দীর্ঘদেহী মানুষটি নিজেই দরজা খুলে আহ্বান করলেন। সিংহকে তার গুহায় যতোটা চেনা যায় , অন‍্যত্র ততোটা নয় , তাঁকে দেখামাত্র উপলব্ধি করলাম। তাঁর বিস্তৃত কক্ষটিতে এনে বসালেন। বই , ছবি , বিশাল মাপের টেবিল , ছবি আঁকার সরঞ্জাম , ফাইলপত্তরে ঠাসা ঘর , দরাজ এক জানালা , কলকাতা শহরের সব আলো মনে হয় ওই জানালা দিয়ে তাঁর ঘরটিতেই ঢোকে।

জানতে চাইলেন ফিরদাউসের কাছে , কেন লন্ডন গেছিল ও। একটা তথ‍্যচিত্র করেছিল , তার প্রদর্শনী করতে। দেখলাম লেখায় ব‍্যস্ত ছিলেন। তাই উঠবো ভাবছিলাম। এদিকে বাইরে বৃষ্টি। বললেন , বৃষ্টিটা থামুক।

' কী লিখছেন?' ' আগামী পুজোসংখ‍্যার জন‍্য ফেলুদা। '। কাহিনী কী , জিগ‍্যেস করা ধৃষ্টতা। তাই নীরব রইলাম। অস্বস্তি হচ্ছিল খুব , আমাদের সামনে উনি লিখতে পারছিলেন না। এ অবস্থায় তাঁকে বিব্রত করা ঠিক নয় ভেবে উঠি উঠি করছিলাম। হঠাৎ বলে উঠলাম , আমি আপনার একটা ইন্টারভিউ নিতে চাই।

আমি কে , তাঁর সাক্ষাৎকার নেবার যোগ‍্যতা আছে কিনা , কে ছাপবে , এসব কিছুই তাঁর মাথায় ছিল না , যখন আমার আর্জি শুনেই বললেন ,' পুজো পর্যন্ত লেখালেখি ও অন‍্যান‍্য কাজে ব‍্যস্ত থাকবো। পুজোর পর ফোন করে একদিন চলে আসুন '।
আহাম্মক , আহাম্মক! আমার মতো আহাম্মক , হতভাগা আর বেকুব আর কে আছে? সেই ফোন করাটা আর হয়নি আমার দ্বারা। অতএব সাক্ষাৎকার নেওয়াও। আসলে সত‍্যিই কি আহাম্মকি? তার চেয়ে অন‍্য কিছু , যখন পুনর্বিবেচনা করি। ভয়। তাঁর সামনাসামনি বসার সাহসের অভাব। আগেকার মোলাকাতগুলো সব - ই ছিল দৈবাৎ। এবার যে পূর্বনির্ধারিত! সাহসে কুলোয় নি। এটাই ব‍্যাখ‍্যা।

এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতার কথা বলি এবার। এক - ই মঞ্চে ত্রিমূর্তি দর্শনের কথা , যা কলকাতার ইতিহাসে সত‍্যিই বিরলদৃষ্ট। স্থান কলকাতা র সরকারি প্রেক্ষাগৃহ নন্দন। উপলক্ষ‍্য বিখ‍্যাত ও বরেণ‍্য , আন্তর্জাতিক খ‍্যাতিসম্পন্ন নৃত‍্যশিল্পী উদয়শঙ্কর - নির্মিত ' কল্পনা ' ছবিটির বিশেষ প্রদর্শনী।ছবিটি দেখানোর আগে যে তিনজন স্বনামধন‍্য ব‍্যক্তি ছবিটি নিয়ে বলবেন , তাঁরা হলেন রবিশঙ্কর , শম্ভু মিত্র এবং সত‍্যজিৎ রায়। এই তিনজনকে এক মঞ্চে কখনো এর আগে দেখা গিয়েছে বলে জানিনা। রবিশঙ্করের অগ্রজ উদয়শঙ্কর। সে হিশেবে তাঁর উপস্থিতি এবং একদিকে সত‍্যজিতের ' পথের পাঁচালী' - সহ একাধিক ছবির সঙ্গীত পরিচালক হওয়ার সূত্রে সত‍্যজিতের উপস্থিতি স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু শম্ভ মিত্র? নিশ্চয়ই আয়োজকেরা বিবেচনা করেছিলেন। আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম তিনজনের - ই বাক্ বৈদগ্ধ‍্যে। তিনজনেই ইংরেজিতে বলেছিলেন। সত‍্যজিতের সাহেবী ইংরেজি উচ্চারণ শুনেছি অনেক , - নানান সাক্ষাৎকার , ' রবীন্দ্রনাথ ' তথ‍্যচিত্রে তাঁর নেপথ‍্য ভাষ‍‍্য , আকাশবাণীতে বিটোফেন নিয়ে দীর্ঘ সঞ্চালনায়। তাছাড়া ' Our Films Their Films ' এর ইংরেজি আবিষ্ট করেছে আমাকে। রবিশঙ্করের ইংরেজিও শুনেছি। তবে শম্ভু মিত্র যে এমন কুশলী বক্তা , ইংরেজি ভাষায় তাঁর অনর্গল বলার প্রতিভা , ওই প্রথম জানলাম। সে ছিল এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা।

সত‍্যজিতের সঙ্গে জীবনে শেষ দেখা কলকাতা আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ‍্যালে। এবং তার স্মরণীয়তা ও মাধুর্য অশেষ। যদিও সেদিন তাঁর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়নি। ঘটনাটা আদ‍্যন্ত মজার। পেশ করা যাক।

সেবার ফেস্টিভ‍্যালটি আয়োজিত হয়েছিল নবনির্মিত নজরুলমঞ্চে।সাধারণত সরকারি অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণপত্র পাই। সেবার যেকোনো কারণে হোক পাই নি। উদ্বোধনের দিন কী মনে হলো , গেলাম নজরুলমঞ্চে। প্রবেশপথের বাইরে বাংলা আকাদেমীর সচিব অনুনয়দার সঙ্গে দেখা। আমাকে দেখেই তিরস্কার , স্ত্রী নেই কেন সঙ্গে? বললাম , আমন্ত্রণপত্রই তো পাই নি , স্ত্রীকে নিয়ে আসবো কোন্ ভরসায়? বিস্মিত হলেন। তখন তো মোবাইল আসেনি। পোস্টের গণ্ডগোলে হয়তো ---! ঢুকবো কী করে? একটু অপেক্ষা করতে বললেন। খানিক বাদে গাড়ি থেকে নামলেন আজকের প্রধান অতিথি , কি না সত‍্যজিৎ রায়। অনুনয়দা অভ‍্যর্থনা করে তাঁকে মঞ্চের পেছনে গ্রীনরুমে নিয়ে বসিয়ে ফিরে এসে আমার হাতে একটা কার্ড দিয়ে বললেন , যাও , ঢুকে পড়ো। এগোতে এগোতে দেখি , কার্ডের ওপরে সত‍্যজিৎ রায়ের নাম লেখা! গেটে টিকিট দেখাচ্ছি যাকে , একবার আমার দিকে , আরেকবার কার্ডটির দিকে , ফের আমার দিকে চেয়ে কী ভাবলেন আমি জানার আগেই এক সুবেশা তরুণীকে ইঙ্গিত করলেন আমাকে নির্দিষ্ট চেয়ার পর্যন্ত পৌঁছে দিতে। ওটা ছিল ভি ভি আই পি - দের চত্বর , সত্বর উপলব্ধি করলাম , যখন আমার চেয়ার নির্দেশিত হলো শত্রুঘ্ন সিনহার পাশে। চারদিকে মাধবী গৌতম ঘোষ অপর্ণা সৌমিত্র ফুটে আছেন , তাঁদের মধ‍্যে আমি! শত্রুঘ্ন বারবার তাকাচ্ছেন আমার দিকে। কে ইনি? নিজের মনেই হয়তো আওড়াচ্ছিলেন , বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি! মঞ্চে সত‍্যজিৎ প্রদীপ জ্বালছেন , থালিগার্ল দেবশ্রী রায়। পিঠে হেলান দিয়ে বসলাম , যেখানে সত‍্যজিতের নামটি কাগজে সাঁটা।ফটোগ্রাফারদের ক‍্যামেরার পর ক‍্যামেরার ঝলসানি। দূরদর্শন লাইভ দেখাচ্ছে।গলদঘর্ম অবস্থা।

সেদিন বাড়ি ফেরার পথে পরিচিতজনের অভিনন্দনে বিব্রত। শত্রুঘ্নের পাশে বসে , সন্ধ‍্যা রায় , সাবিত্রী- - -!সে এক অভিজ্ঞতা।

এবার তাঁকে অন্তিম দর্শনের কথা। মৃত‍্যুর পর। তাঁকে এনে শায়িত রাখা হয়েছে ' নন্দন' - এ ঢোকার মুখে। তাঁকে দেখতে মানুষের ঢল , গণনাতীত মানুষ , ধৈর্য ধরে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে শেষ শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন। এই সুদর্শন মানুষটির মুখ কী কুৎসিত ও জরাগ্রস্ত , তাকানো যায় না। আসলে জীবনভর মাত্রাতিরিক্ত পরিশ্রম , বার্ধক‍্যে একের পর এক মারাত্মক রোগের আক্রমণ কাবু ও কাহিল করে দিয়েছিল তাঁকে। তাছাড়া প্রথমে সিগারেট , পরে পাইপ ও অবশেষে চুরুট , এই ক্রমান্বয়িক ক্ষতিকর নেশার - ও তো প্রতিফল আছে ! বাইপাস অপারেশন হয়েছিল ক - বছর আগে। কিছুদিন আগেই তাঁর আজীবন কাজের স্বীকৃতি হিশেবে অস্কারে ভূষিত করা হলো তাঁকে। পেলেন ভারত সরকারের সর্বোচ্চ সম্মান ' ভারতরত্ন' , তা- ও জীবনের অন্তিমলগ্নে। এছাড়া দাদাসাহেব ফালকে , ফরাসি সরকার - প্রদত্ত লিজিয়ন অফ অনার , শান্তিনিকেতন থেকে ' দেশিকোত্তম ' , ফিলিপাইনের ' রামোন ম‍্যাগসেসে ' তো কবেই পেয়েছিলেন। 1992- এর 23- শে এপ্রিল সব চাওয়া - পাওয়ার ঊর্ধে চলে গেলেন তিনি , স্ত্রী বিজয়া , পুত্র সন্দীপ , পুত্রবধূ ললিতা ও পৌত্র সৌরদীপকে রেখে।

ইউ

সোমবার ৬ বিভাগে বৃষ্টির আভাস, কমবে গরম

রাজধানীতে স্বস্তির বৃষ্টি

বাইশারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আ. মালেক আর নেই

নবাবগঞ্জে ফ্যান লাগাতে গিয়ে যুবকের মৃত্যু 

‘নতুন সংবিধান প্রণয়ন করতে অনেক সময় লাগবে’

সাবেক রাষ্ট্রপতির বিদেশ গমন, তদন্তে উচ্চপর্যায়ের কমিটি

বেনাপোল পৌর জামায়াতের কর্মী সম্মেলন

কোনো দলকে নিষিদ্ধ করলেই নিষিদ্ধ হয়ে যায় না: কাদের সিদ্দিকী

দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়, ঢাকায় ৩৯.৯ ডিগ্রি

দেশে বজ্রপাতে একদিনে ১০ প্রাণহানি

ভুটানকে বিধ্বস্ত করে সেমিফাইনালে বাংলাদেশ

মিথ্যা সংবাদের প্রতিবাদ পিরোজপুরে জেলা বিএনপির সদস্য সচিবের

সন্ত্রাসবিরোধী অধ্যাদেশে সংগঠন নিষিদ্ধের বিধানযুক্ত

শেয়ারবাজার উন্নয়নে প্রধান উপদেষ্টার পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা

লঞ্চে দুই তরুণীকে মারধর: ২৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা