ঢাকা, বাংলাদেশ

রোববার, , ১৮ মে ২০২৫

English

মতামত

স্বশিক্ষিত এক মায়ের কথা

 মোঃ মাহমুদ হাসান:

প্রকাশিত: ১০:২৬, ১২ মে ২০২৪

স্বশিক্ষিত এক মায়ের কথা

সংগৃহীত ছবি

মা মাধুর্য, ভালোবাসা, বন্ধন, নাড়ির টান এমন কতো শতশত বিশেষণে শব্দটি মহিমান্বিত হয়, তার ইয়ত্তা নেই। মায়েদের নিয়ে যেমন গর্ব, আনন্দ আর ভালোবাসার গল্প আছে, তেমনি মা’দের শোষিত, বঞ্চিত হওয়ার হাজারো গল্পের শেষ নেই। সন্তান জন্মদান, লালন পালন, গৃহস্থালি কাজকর্ম, আতিথেয়তা এর সবকিছুর দায় অনাদিকাল থেকেই মায়েরা বহন করে এসেছে। গ্রাম নির্ভর বাংলাদেশ, কৃষিই যার ভিত্তি। সেই গ্রামীন সমাজের মায়েদের জীবনটা যেন আরো কঠোর, নিষ্ঠুরতায় ভরা। খেটে যাওয়ার জন্যই যেন মায়েদের জন্ম। সুবেহ সাদিক থেকে মধ্য রজনী, খাটুনির যেন শেষ নেই।


 মাঠের ধান বাড়িতে এনে কৃষক যখন দায়িত্ব শেষ করে, কৃষাণী মায়ের দায়িত্বের বোঝা আরও বেড়ে যায়। এ মায়েদের যেন কোন অধিকার থাকতে নেই! গ্রামীণ কৃষি অর্থনীতিতে অসামান্য অবদান রেখেও অর্থ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা নেই। রাত দিন হাড় ভাঙ্গা খাটুনি খেটেও অবকাশের অধিকার নেই। শিক্ষা!! এ যেন শুধু ছেলে সন্তানদেরই প্রাপ্য! বছর বছর সন্তান জন্ম না দিলে মা যেন অবলা। সামাজিক অন্ধকারের এমনই একটি নিষ্ঠুরতম সময়ে দেশ বিভাগের প্রাক্কালে আমার মায়ের জন্ম। শুনেছি কোলের শিশু থাকা অবস্থায় বাবাকে হারিয়েছেন। চারপাশে যখন হিন্দু জমিদারদের রাজত্ব, আমার নানা তখনকার মুসলিম গ্রামীণ সমাজের বেশ প্রভাবশালী মানুষ। জ্ঞান, গরিমা, বুদ্ধি দীপ্তি ও সাহসে যথেষ্ট প্রজ্ঞাবান। দূরদর্শী ও শিক্ষানুরাগী হওয়ার কারণে, শতাধিক বছর পূর্বে নিজস্ব উদ্যোগে এলাকায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছিলেন। সেই সময় থেকেই সমাজের অন্ধকার দূর করতে সচেষ্ট ছিলেন। এমন বাবার সন্তান হয়েও, আমার মায়ের উচ্চ শিক্ষা কেন হয়নি? 


শিশুকালে দেখেছি, মা একজন মনোযোগী পাঠক। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খবরের কাগজ পড়া তাঁর নিত্য দিনের অভ্যাস। তাই শিক্ষক বাবা ছিলেন পত্রিকার নিয়মিত গ্রাহক। দিনের কাগজ দিনে পাওয়া যেতো না। ঢাকার ছাপানো কাগজের বাসি খবর, আমার পল্লীতে ছিলো তাজা খবর। মা কে দেখে দেখে প্রাথমিকের আগেই আমরাও পাঠ্য বইয়ের পাশাপাশি খবরের কাগজ পড়তে শুরু করি। দৈনিক খবর, আর সংবাদ পত্রিকা তাঁর খুবই প্রিয় ছিল। কোন কোন দিন হকার ‘সংবাদ’ পত্রিকার বদলে ‘দৈনিক বাংলা’ দিয়ে যেতো। বাবা, মা দু'জনের কেউ এ পত্রিকায় প্রশান্তি পেতো না। এ নিয়ে সংবাদপত্রের এজেন্ট সুখলালকে মাঝে মাঝেই গালমন্দ শুনতে হতো। খবরের কাগজ হাতে নিয়েই মা সম্পাদকীয় আর উপ-সম্পাদকীয় অতি মনোযোগের সাথে পাঠ করতেন। এ দু'টি কলাম পড়েই পত্রিকাটি কোন ধারার, তিনি সহজেই তা বুঝে নিতেন। মিজানুর রহমান মিজান, আহমদুল কবির, এম আর আকাতার মুকুল আর এবিএম মুসার লিখা পড়ে আত্মতৃপ্তি পেতেন। যখন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পড়ি, তখন থেকে বাবা-মা দুজনের দর্শন সম্পর্কে বুঝতে আর বাকি থাকে না। সম্পাদকীয় আর উপ-সম্পাদকীয় কলামে, মা আসলে বঙ্গবন্ধুকে খুঁজে বেড়াতেন। ৭৫ এর পর, কোন লেখক সাংবাদিক শেখ মুজিবুর রহমানের নামের আগে বঙ্গবন্ধু লিখতেন না। এ বি এম মুসা সহ গুটি কয়েক সাংবাদিক, লেখক ছিলেন তার ব্যতিক্রম। সম্ভবত, এভাবে মাকে অনুসরণ করেই একদিন আমিও বঙ্গবন্ধুর অনুসারী হয়ে উঠি। 


পত্রিকা পড়ে পড়ে দেশের কোথায় কি হচ্ছে, এর সবই থাকতো মায়ের নকদর্পণে। আমার কাছে মনে হতো, তিনি যেন একটি তথ্য ভান্ডার। এক সময়ে এ খবরের কাগজ, তাঁর জন্য ভীষণ দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠতো। এরশাদের আমল, শিক্ষাঙ্গনে অস্ত্রের ঝনঝনানি। স্বৈরাচারের দোসরদের আগ্রাসনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে টালমাটাল অবস্থা। শিবিরের দুর্গ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, প্রতিদিনই পত্রিকার শিরোনাম হয়। সেই সময়ে আমার অগ্রজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। এভাবে খবরের কাগজ পড়ে পড়েই জামাত-শিবির আর স্বৈরাচারের প্রতি মায়ের প্রচন্ড ঘৃণা বোধ জন্ম নেয়। 


১৯৮৮ সালে বৃন্দাবন সরকারি কলেজের সাবেক ভিপি, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, আওয়ামীলীগ নেতা ও সম্ভ্রান্ত বংশের মানুষ মতলব উদ্দিন মোঃ চৌধুরী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ৭৫ এ বঙ্গবন্ধু নিহত হলে অতি শোকে তিনি সংসারবিহীন মানুষ হয়ে উঠেছিলেন। আমার শিক্ষক পিতার অতি ঘনিষ্ঠ জন মতলুব চৌধুরী তখন প্রায়শই আমাদের বাড়িতে আসা-যাওয়া ও রাত্রি যাপন করতেন। তৎকালীন সরকার ইউনিয়ন পরিষদে নারী সদস্য অন্তর্ভুক্তির বিধান করলে, মতলব চৌধুরী সহ অনেক সমাজপতিদের আগ্রহে মা স্থানীয় সরকারের দায়িত্ব পালন শুরু করেন। সংসারের নানা টানাপোড়েন সত্ত্বেও একনাগাড়ে দশ বছর দায়িত্ব পালন করে, একজন একনিষ্ঠ সমাজকর্মী হয়ে ওঠেন। পরবর্তীতে উপজেলা পরিষদ চালু হলে সরকার মনোনীত প্রতিনিধি হিসেবে আরো পাঁচ বছর দায়িত্ব পালন করেন। সেই সময়ে এরশাদ ভেকেশনে প্রায়ই বিশ্ববিদ্যালয় অনিবার্য কারণে বন্ধ হয়ে যেতো। তখন প্রায়শই মায়ের সঙ্গে উপজেলা পরিষদে যাওয়া হতো। সেই সময়ে আমার সার্টিফিকেট বিহীন মায়ের ভূমিকা দেখে, তখন আমি বিস্ময়ে হতবাক হতাম। 


এক যুগেরও বেশি মা আমার যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী। নিউইয়র্কের অভিজাত এলাকায় বসবাস করেন। সময় সুযোগে দেশ-বিদেশে ঘুরতেও যান। বয়স আশির কৌটায়, এখনো তিনি একজন সৃজনশীল নিয়মিত পাঠক। হাতের কাছে যা পান, তা নিয়েই পড়তে বসেন। নিয়মিত পত্রিকা পড়া হয় না বলে, এক সময় বেশ অভিমান করতেন। কুশল জানতে স্বজনদের কেউ ফোন করলেই, একটি বাংলা পত্রিকা নিয়ে আসতে বলতেন। ইন্টারনেটের বদান্যতায় সেই সংকটটি এখন আর নেই। ইউক্রেন, ফিলিস্তিন বাংলাদেশ আর ভারতের সব তাজা খবরেই মা আমার সমৃদ্ধ থাকে। আমার লেখালেখির সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা আমার মা। মায়ের অগ্রজ অধ্যাপক ডক্টর আশরাফ উদ্দিন আহমেদ একজন লেখক, গবেষক ও খ্যাতিমান সমাজবিজ্ঞানী। সেই মানুষটিরও নিত্য দিনের অনুপ্রেরণা আমার স্বশিক্ষিত মা। মরহুম ডক্টর আলাউদ্দিন, বঙ্গবন্ধুর একান্ত সচিব ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ডঃ মোঃ ফরাসউদ্দীন মতো ভাইদের কারণে, তাঁর হৃদয়ে যে এক অন্যরকম গর্বের অনুভূতি কাজ করে, সন্তান হিসেবে সেটি বুঝতেও আমাদের কোন অসুবিধা হয় না। 


নয় ভাই বোনের মধ্যে আমার মা কনিষ্ঠতম। ভাইয়েরা দেশ সেরা খ্যাতি অর্জন করেছেন। পিতার আরাধ্য স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন। পান্ডিত্য আর সততা দিয়ে সমাজের দৃষ্টান্ত হয়েছেন। ভাইদের মতো আমার মা সহ তাঁর বোনরাও সেই একই রকম মেধাবী ছিলেন। দেশ ও সমাজ সম্পর্কে আমার মায়ের যে পান্ডিত্য আছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী অনেকেই তার জ্ঞান দেখে ঈর্ষান্বিত হবেন। আজ তার ভ্রাতৃদ্বয়কে দেশের মানুষ যেভাবে চেনেন, আমার মায়ের পরিচিতিও হয়তো তাঁর কাছাকাছি হতে পারতো। না পাঠক, আমার মায়ের কাছে কখনো কোন হতাশার গল্প শুনিনি। না পাওয়ার কোন বেদনায় ব্যথিত হতেও দেখিনি। তবে বুঝতে পারি, মায়ের শৈশবে সমাজটা ছিল গোঁড়ামির। পুরুষদের আধিপত্যে নারী ছিল অধিকারবিহীন। চরম বৈষম্যের শিকার হয়ে মা আমার স্বশিক্ষিত হলেও, মেধা, বিচক্ষণতা,সমাজের প্রতি দায়বোধ আর বুদ্ধিদীপ্ত মানসিকতায় তিনিই আমাদের জীবনের সেরা আদর্শ।। 


সততার শিক্ষা সেটি যেমন মায়ের উত্তরাধিকার, মানুষকে হৃদয় দিয়ে ভালবাসার শিক্ষা, সেটিও মা থেকে প্রাপ্ত। দোস্ত ও অসহায় মানুষ দেখলে হৃদয়ে যে আবেগটা জেগে ওঠে, সেটিও রক্তের উত্তরাধিকার। সাম্প্রদায়িকতাবাদের প্রতি যে ঘৃণাবোধের জাগরণ, সেটিও মায়ের দর্শন থেকেই প্রাপ্ত। বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ আর মুক্তিযুদ্ধের প্রতি যে অকৃত্রিম শর্তহীন ভালোবাসা, সেটিও মায়ের আদর্শেরই ব্যপ্তি। শুধু মা দিবসে নয়, অনন্তকালেই মা তুমি আমাদের প্রেরণা, ভালোবাসা আর নির্ভরতার শেষ ঠিকানা।। 


লেখক: উন্নয়ন গবেষক ও সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষক 



 

//এল//

সৌদি পৌঁছেছেন ৪৯১০৩ হজযাত্রী, আরও একজনের মৃত্যু

আন্তর্জাতিক ইকোট্যুরিজম সোসাইটি পর্তুগালের সভাপতি হলেন ডালটন জহির

ডেঙ্গুতে একজনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ৭৯

ভারত-পাকিস্তান নিয়ে নতুন পরিকল্পনায় পরমাণু শক্তিধর দুই দেশ

অফিসার পদে চাকরি দেবে সীমান্ত ব্যাংক

মতিঝিলে ভবনে লাগা আগুন নিয়ন্ত্রণে

রাজধানীতে সভা-সমাবেশ নিয়ে ডিএমপির নতুন নির্দেশনা

নারীর জীবনমান: সুস্থতা, স্বাধীনতা ও সম্মানের সমন্বয় জরুরি

বেনাপোলে সাড়ে ৬০ লক্ষ টাকার ভায়াগ্রা পাউডার জব্দ

বিয়ের আটদিনের মাথায় আখাউড়া  স্বামীকে খুন, স্ত্রী আটক

‘নির্বাচন কমিশন কখন তফসিল ঘোষণা করবে জনগণ জানতে চায়’

পদত্যাগ করলেন ইয়েমেনের প্রধানমন্ত্রী

শেষ হল টগুমগুর দুই দিনব্যাপী মা দিবসের মেলা

মতিঝিলে ভবনে আগুন, নিয়ন্ত্রণে ৪ ইউনিট

তুরস্ক-পাকিস্তান সম্পর্ক আরো জোরালো