
ফাইল ছবি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যের এক অমর নাম। তিনি ছিলেন একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, নাট্যকার, সংগীতকার, প্রাবন্ধিক ও চিত্রশিল্পী। তাঁর সাহিত্য এত বৈচিত্র্যময়, এত গভীর এবং বিস্তৃত যে তাকে কেবল একজন কবি বা একজন লেখক বলে সীমাবদ্ধ করা যায় না। তিনি ছিলেন এক সম্পূর্ণ সাংস্কৃতিক সত্তা, যিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এক নতুন রূপ ও দিগন্তের সূচনা করেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যচর্চা শুরু হয়েছিল কবিতা দিয়ে, আর কবিতাই তাঁর আত্মার গভীরতম ভাষা হয়ে ওঠে। তাঁর ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যগ্রন্থের জন্য তিনি ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন, যা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক গৌরবময় অধ্যায় হয়ে আছে। তাঁর কবিতায় কখনো প্রেম, কখনো প্রকৃতি, কখনো ঈশ্বর, আবার কখনো মানুষের অন্তর্দ্বন্দ্ব উঠে এসেছে অনন্ত রূপে। কবিতার ছন্দে ছন্দে তিনি মানুষের মনের অন্ধকারে আলো জ্বালিয়েছেন।
কিন্তু রবীন্দ্রনাথ কেবল কবি হয়ে থাকেননি। তিনি উপন্যাস লিখেছেন, যেখানে সমাজ, রাজনীতি, নৈতিকতা এবং মানুষের জটিল মনোজগতের প্রতিফলন ঘটেছে। যেমন ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসে তিনি জাতীয়তাবাদের আবেগ ও নারীর আত্মপরিচয় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। ‘শেষের কবিতা’তে তিনি প্রেমের একটি পরিণত রূপ তুলে ধরেছেন, যেখানে সম্পর্কের মোহ নয়, বরং তার গভীরতা ও দায়বদ্ধতার দিকটি গুরুত্ব পায়। ‘গোরা’ উপন্যাসে তিনি জাত, ধর্ম, সমাজ ও আত্মপরিচয়ের চমৎকার প্রশ্ন উত্থাপন করেন।
রবীন্দ্রনাথ বাংলা ছোটগল্পের জনকও বলা যায়। তাঁর ছোটগল্পগুলো সংক্ষিপ্ত হলেও জীবনের গভীর মানে বহন করে। ‘কাবুলিওয়ালা’, ‘পোস্টমাস্টার’, ‘সমাপ্তি’, ‘অতিথি’-প্রতিটি গল্পেই মানুষের মনের সহজাত আবেগ ও সম্পর্কের সূক্ষ্মতা ফুটে ওঠে।
রবীন্দ্রসংগীত রবীন্দ্রনাথের আরেক অনন্য অবদান। প্রেম, বিরহ, দেশপ্রেম, ভক্তি-সবকিছুর জন্যই তিনি গান লিখেছেন। তাঁর গান শুধু সংগীত নয়, তা যেন এক ধ্যানের মতো, এক আত্মিক অনুভবের যাত্রা। বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’ এবং ভারতের জাতীয় সংগীত ‘জনগণমন’ তাঁরই রচনা। এতে তাঁর ভাবনার বিশ্বজনীনতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
বয়সের শেষভাগে তিনি ছবি আঁকাও শুরু করেন। তাঁর আঁকা চিত্রগুলো বেশিরভাগই বিমূর্ত ও গভীর ভাবনার প্রতিফলন। আর প্রবন্ধে তিনি শিক্ষা, ধর্ম, সভ্যতা ও মানবিকতার বিষয়ে নিজের চিন্তা প্রকাশ করেছেন, যা আজও সমান প্রাসঙ্গিক।
রবীন্দ্রনাথ ছিলেন এক বিশ্বমানব। তিনি শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠা করে একটি বিকল্প শিক্ষাব্যবস্থার স্বপ্ন দেখেছিলেন, যেখানে মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে সংলাপে বেড়ে উঠবে। তাঁর সাহিত্যে যেমন আছে বাংলার মাটি ও মানুষের গন্ধ, তেমনি আছে বিশ্বজনীন চেতনার স্পন্দন।
রবীন্দ্রনাথকে বোঝা মানে কেবল একজন সাহিত্যিককে জানা নয়, বরং একটি সময়, একটি সংস্কৃতি, একটি জীবনদর্শনকে জানা। তাঁর সাহিত্য আমাদের ভাবতে শেখায়, অনুভব করতে শেখায়, ভালোবাসতে শেখায়। তাই তিনি শুধু কবি নন, তিনি বাংলা মননের একটি ধ্রুবতারা। তাঁর সাহিত্য কোনো একক সময়ে আবদ্ধ নয়-তা চিরকালের, চিরমানবের।
ইউ