
ছবি সংগৃহীত
তালেবান (Taliban) আফগানিস্তানের ক্ষমতা গ্রহণের পর নারীদের জীবনযাত্রায় একের পর এক কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। পার্কে যাওয়া, জিমে প্রবেশ, রেস্টুরেন্টে খাওয়া এমনকি বেশিরভাগ পেশায় কাজ করাও নিষিদ্ধ হয়ে যায়। তবে সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা আসে যখন মেয়েদের জন্য প্রাথমিক শিক্ষার পর শিক্ষা গ্রহণ পুরোপুরি নিষিদ্ধ করে দেয় তারা।
এই বাস্তবতায় অনেক আফগান নারী বাধ্য হয়ে বিকল্প খুঁজে নিয়েছেন অনলাইনে। এমনই একজন সোদাবা (Sodaba)। তিনি খুঁজে পান একটি বিনামূল্যে কম্পিউটার কোডিং কোর্স, যা পড়ানো হয় তার মাতৃভাষা দারিতে (Dari)। কোর্সটি করাচ্ছেন গ্রিসে (Greece) অবস্থানরত এক আফগান শরণার্থী।
সোদাবা বলেন, “আমি বিশ্বাস করি, একজন মানুষ পরিস্থিতির কাছে হার মানার জন্য জন্মায় না। বরং যে যেভাবে পারে, স্বপ্নের পথে এগিয়ে যাওয়াই উচিত।” তিনি এখন শেখছেন প্রোগ্রামিং (Programming) ও ওয়েবসাইট তৈরির কাজ।
এই কোর্সটির আয়োজন করেছে আফগান গিকস (Afghan Geeks) নামের একটি প্রতিষ্ঠান, যেটি গড়ে তুলেছেন মরতাজা জাফারি (Murtaza Jafari)। তিনি কিশোর বয়সে তুরস্ক (Turkey) থেকে একটি নৌকায় করে গ্রিসে পালিয়ে যান এবং আশ্রয় শিবিরে থেকে এক শিক্ষককে পাশে পেয়ে শেখেন কম্পিউটার কোডিং।
জাফারি বলেন, “আমি কম্পিউটার কীভাবে চালাতে হয়, সেটাও জানতাম না। ইংরেজি জানতাম না, গ্রিক (Greek) ভাষাও না। কিন্তু একসঙ্গে তিনটা জিনিস শিখতে শুরু করেছিলাম — ভাষা, কম্পিউটার, আর কোডিং।”
কিছু মাসের মধ্যেই তিনি কোডিং সার্টিফিকেট অর্জন করেন, এবং পরে শুরু করেন Afghan Geeks।
"যা পেয়েছি, তা ফিরিয়ে দিতে চাই"
২০২৪ সালের ডিসেম্বর থেকে তিনি নারীদের জন্য অনলাইনে কোর্স চালু করেন। এখন তার কোর্সে তিনটি স্তরে (শুরু, মধ্যম, উন্নত) ২৮ জন ছাত্রী পড়ছেন। শুধু শেখানো নয়, জাফারি তাদের অনলাইন ইন্টার্নশিপ (Internship) ও ফ্রিল্যান্সিংয়ের (Freelancing) দিকেও উৎসাহ দিচ্ছেন।
যারা ভালো পারদর্শিতা দেখায়, তাদের Afghan Geeks টিমে কাজের সুযোগ দেওয়া হয় — যেখানে তারা ওয়েবসাইট ও চ্যাটবট (Chatbot) তৈরি করে। বর্তমানে তার ক্লায়েন্ট আছেন আফগানিস্তান, যুক্তরাষ্ট্র (USA), যুক্তরাজ্য (UK) ও ইউরোপ (Europe) থেকে।
জাফারি বলেন, “ক্লায়েন্টরা খুশি কারণ তারা জানেন, তাদের কাজের অর্থ একটি মহৎ উদ্যোগে ব্যয় হচ্ছে — আফগান নারীদের সহযোগিতায়। এজন্যই তারা আবার আবার আমাদের কাছেই ফিরে আসেন।”
"তাদের মুখ কখনও দেখিনি"
জাফারি আরও জানান, “আমি কখনোই তাদের ভিডিও চালাতে বলিনি, ছবি চাইনি। কারণ আমি তাদের সংস্কৃতি, নিরাপত্তা এবং পছন্দের প্রতি সম্মান জানাই।”
আরেক নারী উদ্যোগে ৪ হাজার ছাত্রী
তালেবানের নিষেধাজ্ঞার পর অনেক তরুণী যেমন হতাশ হয়ে পড়েছিলেন, তেমনি কেউ কেউ নিজেই হয়ে উঠেছেন অন্যদের অনুপ্রেরণা। ২০ বছর বয়সী জুহাল (Zuhal), যার নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন থেমে যায়, তিনিও এমন একজন।
তিনি এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের সঙ্গে মিলে গড়ে তুলেছেন ভিশন অনলাইন ইউনিভার্সিটি (Vision Online University) — নারীদের জন্য একটি ভার্চুয়াল শিক্ষা প্ল্যাটফর্ম। শুরু করেছিলেন মাত্র পাঁচজন নিয়ে, এখন সেখানে ১৫০ জন শিক্ষক ও প্রশাসক এবং ৪,০০০-এর বেশি ছাত্রী পড়াশোনা করছেন।
জুহাল বলেন, “আমরা কেউই কোনো বেতন নেই। কোনো আর্থিক সহায়তাও নেই। আমাদের একটাই লক্ষ্য — মেয়েদের বিনামূল্যে শিক্ষার সুযোগ দেওয়া এবং দেশে গবেষণার পরিবেশ তৈরি করা।”
এই ভার্চুয়াল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয় মনোবিজ্ঞান, বিদেশি ভাষা, কুরআন অধ্যয়ন, নার্সিং, পাবলিক স্পিকিংসহ (Public Speaking) বিভিন্ন বিষয়ের উপর কোর্স। আর সবকিছুই চলছে স্বেচ্ছাশ্রমে।
নিজেও এখন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইউনিভার্সিটি অব দ্য পিপল (University of the People) থেকে কম্পিউটার সায়েন্সে পড়াশোনা করছেন জুহাল। ইন্টারনেট খরচ জোগাড় করাও তার জন্য কঠিন। তারপরও থেমে যাননি।
তিনি বলেন, “আমার যদি লক্ষ্য না থাকত, আমি এত কষ্ট সহ্য করতে পারতাম না। আমি জানি, আমি থেমে গেলে আবার হাজার হাজার মেয়ে হতাশ হয়ে পড়বে।”
শেষ কথা:
তালেবানের নিষেধাজ্ঞা নারীদের বাইরে বের হওয়ার পথ বন্ধ করে দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু প্রযুক্তি আজ তাদের নতুন করে স্বপ্ন দেখাচ্ছে। মরতাজা জাফারি ও জুহালের মতো তরুণদের প্রচেষ্টায় নতুন এক বিপ্লব ঘটছে — অনলাইনের মাধ্যমে নারীরা আবার ফিরে পাচ্ছেন জ্ঞান, আত্মবিশ্বাস ও জীবনের মানে। আরব নিউজ
ইউ