
ছবি সংগৃহীত
আজ রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির ভ্লাদিমিরোভিচ পুতিনের জন্মদিন। ১৯৫২ সালের ৭ অক্টোবর তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের লেলিনগ্রাদে (বর্তমান সেন্ট পিটার্সবার্গ) এক সাধারণ পরিবারে তাঁর জন্ম। শতাব্দীর মোড়লিপনা এবং ক্রেমলিনের দীর্ঘদিনের নেতৃত্বে থাকা এই প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বের জীবন যেমন রহস্যে মোড়া, তেমনি রাজনৈতিক উত্থান বিস্ময়কর। ক্ষমতা, কৌশল ও রাশিয়ার ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারের সংকল্পের প্রতীক পুতিনের জীবন ও রাজনৈতিক বলয় নিয়ে আজকের এই বিশেষ প্রতিবেদন।
সাধারণ পরিবারে বাল্যকাল: ইঁদুরের সাথে লড়াই থেকে ইস্পাত দৃঢ়তা
পুতিনের শৈশব শুরু হয়েছিল চরম দারিদ্র্য ও প্রতিকূলতার মাঝে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জনাকীর্ণ একটি যৌথ ফ্ল্যাটে তাঁর বাবা-মা কোনোমতে বেঁচে যান। তাঁর বড় ভাই জন্মের আগেই মারা গিয়েছিলেন। পুতিন তাঁর আত্মজীবনীতে স্মৃতিচারণ করে বলেছেন, তাঁদের ফ্ল্যাটে একটি মাত্র বাথরুম ও রান্নাঘর ব্যবহার করতে হতো, আর ইঁদুর ও তেলাপোকার সঙ্গেই কাটাতে হতো জীবন।
-
অনুপ্রেরণামূলক বার্তা: পুতিনের স্মৃতিকথায় তাঁর ইস্পাত-দৃঢ় ব্যক্তিত্বের প্রথম বীজ খুঁজে পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন, বালক বয়সে তাঁকে সিঁড়িতে ধেড়ে ইঁদুরের সঙ্গে লড়াই করতে হতো। ছোট ও রোগা-পাতলা হওয়ার কারণে তাঁকে মার খেতে হতো না, তাই শক্তিশালী হওয়াটা তাঁর কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তাঁর পরিবারে কর্তব্য, দেশপ্রেম ও আনুগত্যের দৃঢ় মূল্যবোধ ছিল, যা তাঁকে এই চ্যালেঞ্জিং জীবন থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করেছে। এই স্মৃতিচারণ এক অনুপ্রেরণামূলক বার্তা দেয় যে, জীবন যত কঠিনই হোক না কেন, সাহস ও দৃঢ় প্রতিজ্ঞা একজন মানুষকে সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে দিতে পারে।
রাজনৈতিক উত্থান: কেজিবি থেকে ক্রেমলিন
আইন বিভাগে পড়াশোনা শেষ করেই পুতিন সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবি-তে যোগ দেন। গুপ্তচরবৃত্তির কৌশলগত অভিজ্ঞতা তাঁকে পরবর্তী রাজনৈতিক জীবনে গভীরভাবে প্রভাবিত করে।
-
ক্ষমতায় আগমন: ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর তিনি লেনিনগ্রাদের স্থানীয় সরকারে কাজ শুরু করেন। ১৯৯৯ সালের ডিসেম্বরে প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলৎসিন অপ্রত্যাশিতভাবে পদত্যাগ করলে, পুতিনকে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত করা হয়।
-
রাশিয়ার পুনরুত্থান: ২০০০ সালের নির্বাচনে বিপুল জনপ্রিয়তায় বিজয়ী হওয়ার পর থেকে পুতিনের শাসনকাল শুরু হয়। তিনি ভঙ্গুর রাশিয়ার নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দেন। তেলের মূল্যবৃদ্ধির সুবিধা নিয়ে তিনি রাশিয়ার অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করতে সক্ষম হন। ২০০০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্রেমলিনের নেতৃত্বে থাকা পুতিনকে ১৯৫৩ সালে স্ট্যালিনের মৃত্যুর পর থেকে রাশিয়ার সবচেয়ে দীর্ঘকালীন শীর্ষ নেতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
বৈশ্বিক ব্যক্তিত্ব ও কূটনৈতিক বলয়
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে পুতিন তাঁর দৃঢ়চেতা ও তীক্ষ্ণ কৌশলগত বুদ্ধিমত্তার জন্য পরিচিত। পশ্চিমা বিশ্বের চোখে তিনি আগ্রাসী ও স্বৈরাচারী হিসেবে সমালোচিত হলেও, অনেক দেশ ও জনগণের কাছে তিনি রাশিয়ার হারানো গৌরব পুনরুদ্ধারের প্রতীক।
-
পশ্চিমা প্রতিপক্ষ: ন্যাটোর সম্প্রসারণ ও পশ্চিমা হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে তাঁর কঠোর অবস্থান প্রায়শই রাশিয়াকে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার মুখে ফেলেছে (যেমন- ইউক্রেনে সামরিক অভিযান ও ক্রিমিয়া দখল)।
-
বহু-মেরুকেন্দ্রিক বিশ্ব: পুতিন আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাশিয়ার প্রভাব বাড়ানোর নীতি গ্রহণ করেছেন। তাঁর রাজনৈতিক বলয় এখন চীন, উত্তর কোরিয়া, ইরান, ভারত ও তুরস্কের মতো শক্তিশালী দেশগুলো পর্যন্ত বিস্তৃত।
-
চীন ও উত্তর কোরিয়া: রাশিয়া ও চীন উভয়েই পশ্চিমাদের চাপ বজায় রাখতে কৌটিল্যের নীতি অনুসরণ করছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। অন্যদিকে, উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন পুতিনকে তাঁর 'ঘনিষ্ঠতম বন্ধু' হিসেবে অভিহিত করেছেন, যা সামরিক ও কৌশলগত দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
-
ভারত ও তুরস্ক: এই দেশগুলো রাশিয়ার জ্বালানির প্রধান ক্রেতা এবং মস্কোর সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বজায় রেখেছে।
-
মুসলিম বিশ্ব: সিরিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের ইস্যুতে রাশিয়ার জোরালো ভূমিকা মুসলিম উম্মার সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।
-
জন্মদিন উদযাপনের ব্যক্তিগত দর্শন
পুতিন তাঁর জন্মদিন নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলা পছন্দ করেন না। বিগত বছরগুলোতে তিনি তাঁর জন্মদিন প্রেসিডেন্ট ভবনে কর্মক্ষেত্রেই উদযাপন করেছেন। নিজের জন্মদিন সম্পর্কে একবার তিনি বলেছিলেন:
"এটি আমার জন্মদিন, এটি কোনো জাতীয় ছুটির দিন নয়। এই অনুষ্ঠানের গুরুত্বকে অতিরঞ্জিত করা আমার কাছে অবান্তর বলে মনে হয়।"
এই দৃষ্টিভঙ্গি তাঁর রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ জনগণের মধ্যে একটি সাধারণ ও দায়িত্বশীল নেতার ভাবমূর্তি তৈরি করতে সাহায্য করেছে। যদিও তাঁর রাজনৈতিক জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ বিশ্বজুড়ে সংবাদপত্রের শিরোনাম তৈরি করে, তবুও ব্যক্তিগত জীবনে তিনি অপেক্ষাকৃত গোপনীয়তা বজায় রাখেন। তাঁর দুই মেয়ে মারিয়া ভোরন্তসোভা ও ক্যাটরিনা তিখোনোভা পর্দার আড়ালে থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তাদের জনসম্মুখে আনা হয়েছে।
ইউ