
ছবি: প্রতীকী
এইমাত্র জাহিদ স্যারের বাসা থেকে এলাম। উনি মফস্বল শহরের ইংরেজির অধ্যাপক। বেশ নাম ডাক। আমার মনটা ফুরফুর করছে। আজ আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিন, খুশির দিন। জাহিদ স্যারকে জড়িয়ে ধরে হাউ মাও করে কান্নাকাটি করে জানালাম বিদেশ চলে যাচ্ছি।
সিভিল এভিয়েশন এ আমার এক নিকটাত্মীয় কে ধরে টাকা পয়সা ঘুষ টুস দিয়ে বহু কষ্টে করোনার কারণে বিদেশি নাগরিকদের নেয়ার ফ্লাইটে একটা খালি সিটে দুবাই পর্যন্ত যাওয়ার ব্যাবস্থা করেছি। আর হয়তো দেখা হবে না।এটাই হয়তো শেষ দেখা।
স্যারের বাসায় গতকালই কেনা তিন কেজি দামি মিষ্টি স্যারের তিন ছেলে আর উনার বউ কে নিজের হাতে প্যাকেট খুলে খেতে দিলাম, নিজেও খেলাম।বাচ্চাদের কোলে নিয়ে আদর করলাম। নিখুঁত অভিনও আমার চোখে পানির ধারা (আঙুলে মাখা গ্লিসারিন চোখে লাগিয়ে নিলে পানি না এসে পারে?)।
স্যার বললেন খেয়ে যাও। আমি বিনয়ের সাথে বললাম স্যার মাফ করবেন, একটু আগে মেঝ খালার বাসা থেকে দাওয়াত খেয়েই আপনার বাসায় এসেছি।
শায়লা (স্যারের বউ) আমাকে জীবনে প্রথম ওর বাসায় দেখে একটু অবাক হলেও আমার অভিনয় ধরতে পারা ওর পক্ষে অসম্ভব।ও বা স্যার একটুও সন্দেহ করেনি।নিজের অভিনয় দক্ষতায় নিজেকে লিওনার্দো দা ক্যাপ্রিও মনে হচ্ছে। আমার বিশ বছর ধরে করা প্ল্যান আজ শতভাগ সফল।
(আপনারা হয়তো ভাবছেন এতে গল্পের কি আছে? আর এটা তো অভিনয়ে র ই বা কি দরকার? এইটা আর নুতন কি? তাইনা? আছে মশাই আছে। কারণ শুনলে বুঝবেন কেন কিসের জন্য আমার এই গল্প লেখা? কি কারণে আমার জীবনের আজ সবচেয়ে খুশির দিন । সেটা বলবো গল্পের পরের অংশে)
ফাস্ট ইয়ারে শায়লার সাথে পরিচয়।ভালো লাগতো ওর শান্ত কিন্তু উচ্ছ্বল আচরণ।একদিন সাহস করে বলেই বসলাম, শায়লা তোমাকে আমার খুব ভালো লাগে।
আমাকে অবাক করে দিয়ে ও বললো,সেটা আমি অনেক আগেই বুঝেছি। তা মুখ ফুটতে এতদিন লাগলো মশায়ের?
আমি লজ্জায় চুপ হয়ে গেলাম।
এইভাবে কেটে যায় ফার্স্ট ইয়ার।আমাদের প্রেম ভালোবাসা না, পছন্দ অপছন্দের আলাপ হতো। কলেজে আমরা প্রায় সময়ই একসাথে লাইব্রেরিতে পড়তাম।দুজনারই স্বপ্ন কলেজ শেষে ইউনিভার্সিটি, এরপর সরকারি চাকরি, এরপর পরিবারকে বলে বিয়ে থা। বিষয়টা সম্ভবত শায়লার ফ্যামিলির কানে গিয়েছিল।
হটাৎ একদিন শায়লা মুখ কালো করে আমাকে বললো, এই এদিকে এসো, তোমার সাথে একটা জরুরি কথা আছে।
আমি অবাক হয়ে বললাম, কি কথা?
ও যা বললো শুনে আমার মাথায় চুরচুর করে আকাশ ভেঙে পড়লো। ওর পরিবার নাকি বিয়ে ঠিক করেছে। ছেলে ইংরেজির সুদর্শন লেকচারার।
শায়লা বললো, তুমি কি করতে চাও?
আমি বললাম, শায়লা চলো পালিয়ে বিয়ে করে ফেলি।
শায়লা মাথা নাড়লো, বললো সেটা সম্ভব না । ফ্যামিলির মূখে চুন কালি দিতে পারবো না। তুমি বরং তোমার গার্জিয়ান কে আমাদের বাড়ি পাঠাও। দু-পক্ষই না হয় একটু অপেক্ষা করি দুজনার পড়া শেষে চাকুরী পর্যন্ত।
আমি বিমর্ষ মনে বিষয়টা বাবা মায়ের কাছে খুলে বললাম। বলার একপর্যায়ে কেঁদেও ফেললাম। আব্বা গম্ভীর হয়ে বসে রইলেন। মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন দেখি তোর আব্বু চিন্তা করে কি বলেন।
পরদিন সকালে আব্বা ঘুম থেকে উঠে খুব উৎফুল্ল ভাবে আমাকে ডাকলেন। বললেন কোন চিন্তা করিস না বেটা,আমি আর তোর মা শায়লাদের বাসায় প্রস্তাব নিয়ে যাচ্ছি। আব্বা অনেক মিষ্টি কিনে আনলেন, আর মা নুতন শাড়ি পরে আব্বাকে নিয়ে চলে গেলেন।
আমি দোয়া দরুদ পড়ছি আর আল্লাহ কে ডাকছি। অনেকটাই আশাবাদী ছিলাম কারণ আমাদের আর্থিক অবস্থা শায়লাদের মতই না, বরং একটু ভালোও বলতে পারেন। তা ছাড়া আমি বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান।সুদর্শন ভদ্র ছেলে। এছাড়া শায়লা বলেছে ওর বাবা মা খুব নরম মনের মানুষ।
সন্ধ্যায় বাবা মা ফিরে এলেন, মুখ কালো। আমি আমার ঘরে বসে রইলাম, মা এসে বললেন না রে বাবা হলো না। ওরা পাকা কথা দিয়ে ফেলেছে। তুই অন্য কোনো মেয়েকে পছন্দ করে আমাদের বলিস আমরা সেটাই মেনে নেব।আমার মন খুব খারাপ হয়ে গেল। এমনটি তো হবার কথা ছিল না।
সারারাত কাঁদলাম।পরদিন কলেজে গেলাম শায়লা আসেনি, ওর বান্ধবীকে বলেছে বাসা থেকে আর কলেজে আসতে দেবে না। যদি পারি, মাগুরায় ওই কলেজে যেয়ে পাত্র প্রফেসরকে আমাদের বিষয়টা বলে যেন অনুরোধ করি বিয়ে না করতে।
বন্ধুদের মধ্যে সোহাগ সবচেয়ে ঘনিষ্ট, ওকে বললাম। ও বললো চল কালকেই যাব।
পরদিন স্যারের কলেজে গেলাম। সালাম দিয়ে বললাম স্যার, একটু প্রাইভেট কথা বলবো। উনি আমাদের একটা খালি ক্লাস রুমে নিয়ে বললেন কি বলবে বলো?
আমি সব কথা খুলে বললাম। আমাদের পছন্দ যে পবিত্র সেটাও বললাম। উনি সব শুনে একটু মুচকি হাসি দিলেন। আমাকে বললেন আমার ভাই যে এসপি এটা কি তুমি জানো?
আমি বললাম জি না স্যার। স্যারের পা ধরে বসলাম, বললাম স্যার আপনার দয়া চাই, আপনি মেয়ে পক্ষকে না করে দিবেন। স্যার আমার নাম ঠিকানা লিখে নিলেন। বললেন আচ্ছা ওদের সাথে কথা বলে দেখি। আমি আশায় বুক বেঁধে বাসায় ফিরে এলাম।
সেইদিন রাত তখন প্রায় দুইটা। দরজায় ভীষণ জোরে শব্দ। আব্বা অবাক হয়ে দরজা খুললেন। দরজার সামনে অনেক পুলিশ। একজন দারোগা আব্বাকে বললেন, এসপি সাহেব ডেকেছেন। আপনাকে আমাদের সাথে যেতেই হবে।আব্বার কোনো আপত্তি না শুনে একরকম জোর করেই গাড়িতে তুলে আব্বাকে নিয়ে গেল। আমি হতবাক।
পরদিন সকালে স্থানীয় সরকার দলীয় কমিশনার সাহেব কে নিয়ে থানায় গেলাম। ওসি সাহেব বললেন এই ধরনের কোন লোক কে কাল রাতে থানায় আনা হয় নাই। সারাদিন ডিবি, আর সব অফিসে ঢুঁ মারলাম। কমিশনার সাহেব এসপি অফিসে খোঁজ নিলেন। কেউ আব্বার খোঁজ জানে না।
আব্বার খোঁজ মিললো তিন দিন পরে। নাশকতার মামলায় উনাকে জেলে রাখা হয়েছে। পরিচিত উকিলের কাছে ছুটে গেলাম। উনি বললেন যুক্তি তর্ক দিয়ে জামিন হবে না। অন্য উপায় খুঁজতে হবে। তবে খরচ হবে অনেক আর সময় লাগবে। জমি বেঁচে অনেক টাকা পয়সা খরচের পরে তিন মাসের মাথায় আব্বার জামিন হলো।
আব্বা জেল থেকে এসেই খুব অসুস্থ হয়ে গেলেন। মাস খানেকের মাথায় স্ট্রোক করে আব্বা মারা গেলেন। আমি নিজেকে অপরাধী ভাবতে শুরু করলাম। এক আধটু নেশা করতে শুরু করলাম। মা সারাদিন চুপ করে থাকেন আর মুখ লুকিয়ে কাঁদেন। আমাদের সুখের সংসার একটা বিষাদের নদীতে পরিণত হয়ে গেল। আমি আর মা তখন সেই নদীর বিষাদের পানিতে হাবু ডুবু খেতে লাগলাম।
আমি ফাইনাল পরীক্ষায় ফেল করলাম। মা মারা গেলেন বাবার মতই।একদিন সকালে কাজের বুয়ার চিৎকার খালাম্মা আর নাই গো ও আল্লা আল্লারে, আল্লাগো..
আমি একা হয়ে গেলাম।ভীষণ রকম একা আর অসহায়।
স্যারের উপর খুব রাগ হলো ভাবলাম , কেন উনি এইসব করালেন? পরদিন স্যারের কলেজে গেলাম। স্যার আমাকে দেখে অমায়িক হাসি দিলেন।আমি বললাম স্যার আপনি এসপির ভাই বলেই আমাদের সংসারটা কি শেষ করে দিলেন?
স্যার বললেন তুমি এখন যাও, অন্যদিন এসো কথা বলবো।
আমি চলে এলাম। শেষ রাতে পুলিশ এসে আমাকে চোখ আর হাত বেঁধে নিয়ে গেল। কোথায় নিলো কিছুই বুঝতে পারলাম না। এর পর শুরু হলো মার আর গালি গালাজ।অজ্ঞান হওয়ার আগে অবাক হয়ে শুধু মার খেয়েই গেলাম। জ্ঞান ফিরলে মনে হলো আমি ব্যাথায় মরে যাব। সারা শরীরে অসহ্য ব্যাথা। একটু পরে আবার মার। এইভাবে কয় দিন গেছে জানি না। চোখ বাঁধা থাকায় রাত দিন বোঝার উপায় ছিল না।কি খেতে দিত জানি না, শুধু ব্যথা আর বেঁচে আছি সেটাই বুঝতাম।
চলবে.....