
ছবি সংগৃহীত
ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তায় পুলিশি দমননীতি এবং সরকারের মাত্রাতিরিক্ত ব্যয়ের বিরুদ্ধে চলমান বিক্ষোভে নতুন মাত্রা যোগ করেছেন শত শত নারী। হাতে ঝাড়ু নিয়ে, গোলাপি পোশাকে সজ্জিত হয়ে তারা বুধবার (৩ সেপ্টেম্বর) পার্লামেন্টের দিকে মিছিল করেছেন। এই নারীরা ‘ইন্দোনেশিয়ান উইমেনস অ্যালায়েন্স’ (IWA) এর সদস্য, যা ৯০টি নারী সংগঠন ও বিভিন্ন মানবাধিকার গোষ্ঠীর সমন্বয়ে গঠিত একটি রাজনৈতিক জোট। তাদের হাতে থাকা ঝাড়ু প্রতীকী অর্থে রাষ্ট্র ও পুলিশি নির্যাতনের ‘ময়লা’ দূর করার ইচ্ছার প্রতীক।
জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি এবং সংসদ সদস্যদের জন্য অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধার বিরুদ্ধে শুরু হওয়া এই বিক্ষোভ দ্বিতীয় সপ্তাহে গড়িয়েছে। বিক্ষোভের তীব্রতা আরও বাড়ে যখন এক তরুণ মোটরসাইকেল ট্যাক্সিচালক আফফান কুরনিয়াওয়ান পুলিশের গাড়ির নিচে চাপা পড়ে নিহত হন। এই ঘটনা জনগণের ক্ষোভকে আরও উসকে দেয়, এবং পুলিশি ব্যবস্থার সংস্কারের দাবি জোরালো হয়ে ওঠে।
প্রতিবাদের কারণ ও দাবিসমূহ
-
পুলিশি নির্যাতন ও বিচারহীনতা: বিক্ষোভের মূল কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো পুলিশি নির্যাতন এবং এর জবাবদিহিতার অভাব। আফফান কুরনিয়াওয়ানের মৃত্যুর পর জনগণ এর বিচার দাবি করে এবং পুলিশের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তোলে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ইন্দোনেশিয়া এবং জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয়ও এই ঘটনার স্বচ্ছ তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে।
-
সরকারি ব্যয় ও বৈষম্য: জীবনযাত্রার খরচ বেড়ে যাওয়া এবং একই সময়ে সংসদ সদস্যদের জন্য বিলাসবহুল সুযোগ-সুবিধার ঘোষণা জনগণের মধ্যে ক্ষোভের জন্ম দেয়। বিক্ষোভকারীরা বলছেন, সাধারণ মানুষ যখন অর্থনৈতিক সংকটে ভুগছে, তখন রাজনৈতিক অভিজাতরা অতিরিক্ত সুবিধা নিচ্ছেন। যদিও প্রেসিডেন্ট প্রাবোও সুবিয়ান্তো রাজনীতিবিদদের কিছু সুবিধা কমানোর ঘোষণা দিয়েছেন, তবে বিক্ষোভকারীরা এটিকে যথেষ্ট মনে করছেন না। তাদের মতে, এটি শুধু একটি প্রতীকী পদক্ষেপ, যা মূল সমস্যার সমাধান করবে না।
-
গণতান্ত্রিক অধিকার ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা: বিক্ষোভকারীরা স্লোগান এবং প্ল্যাকার্ডের মাধ্যমে ‘প্রতিবাদ কোনো অপরাধ নয়, বরং গণতান্ত্রিক অধিকার’—এই বার্তা ছড়িয়ে দিচ্ছেন। ন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস কমিশনের চেয়ারম্যান আনিস হিদায়াহ বলেছেন, জনগণের মত প্রকাশের জন্য পর্যাপ্ত জায়গা না থাকায় সহিংসতা বাড়ছে।
আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা ও প্রতীকী রং
ইন্দোনেশিয়ার ইতিহাসে নারীদের আন্দোলন নতুন নয়। ১৯৯৮ সালের সংস্কার আন্দোলনের সময়ও তারা সুহার্তোর স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। এবারের বিক্ষোভেও তারা তাদের ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছেন।
-
ঝাড়ু ও গোলাপি পোশাক: IWA-এর নারী সদস্যরা হাতে ঝাড়ু নিয়ে মিছিল করছেন, যা দিয়ে তারা ‘রাষ্ট্রের আবর্জনা, সামরিকবাদ ও পুলিশি দমননীতি’ ঝেড়ে ফেলার ইচ্ছা প্রকাশ করছেন। তাদের পরিহিত গোলাপি পোশাক সাহসিকতার প্রতীক।
-
সবুজ পোশাক: নিহত ট্যাক্সিচালক আফফানের রাইডশেয়ার কোম্পানির পোশাকের রং ছিল সবুজ। তার প্রতি সংহতি প্রকাশ করে কিছু বিক্ষোভকারী সবুজ পোশাক পরে বিক্ষোভে অংশ নিচ্ছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই রংগুলোকে ‘হিরো গ্রিন’ এবং ‘ব্রেভ পিঙ্ক’ নামে অভিহিত করা হচ্ছে।
প্রেসিডেন্টের চীন সফর ও অন্যান্য প্রতিক্রিয়া
বিক্ষোভের তীব্রতার মুখে প্রথমে প্রেসিডেন্ট প্রাবোও সুবিয়ান্তো তার চীন সফর বাতিলের ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে তাকে বেইজিংয়ে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে একটি ছবিতে দেখা গেছে। এই ঘটনায় চলমান সংকট আরও জটিল রূপ নিয়েছে।
ইন্দোনেশিয়ান লিগ্যাল এইড ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, আগস্টের শেষ দিকে শুরু হওয়া বিক্ষোভে অন্তত ১০ জন নিহত হয়েছেন, যাদের কয়েকজনের মৃত্যু পুলিশি সহিংসতায় হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়াও, ১০৪২ জনের বেশি মানুষকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
প্রাক্তন ছাত্রনেতা হেরিয়ান্তো বিবিসিকে বলেছেন, এই বিক্ষোভ কেবল একটি নির্দিষ্ট ইস্যু নিয়ে নয়, বরং এটি দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা অসমতা, সুশাসন এবং জবাবদিহিতার অভাবের প্রতিফলন। জনগণ শুধুমাত্র প্রতীকী পরিবর্তন নয়, বরং কৃষি, শিক্ষা এবং অর্থনৈতিক সুযোগের মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোতে গভীরতর সংস্কার দেখতে চায়। বিবিসি
ইউ