
ছবি: উইমেনআই২৪ ডটকম
প্রতিবন্ধিতা নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে গণমাধ্যমের সক্রিয় ভূমিকার প্রয়োজনীয়তা উপর গুরুত্ব দিয়েছেন বিশিষ্টজনেরা।
এছাড়া আসন্ন নির্বাচনে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর অঙ্গীকার ও পরিকল্পনা কী, সে বিষয়গুলো গণমাধ্যমকর্মীদের নজরে রাখার আহ্বান জানিয়েছেন বিশিষ্টজনেরা।
মঙ্গলবার (২ সেপ্টেম্বর) সকালে রাজধানীর ডেইলি স্টার মিলনায়তনে “গণমাধ্যমে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও প্রতিবন্ধিতার অন্তর্ভুক্তি: সম্পাদকীয় নীতি ও চর্চা” শীর্ষক এক সংলাপে বক্তারা এ আহ্বান জানান। ইউনেস্কো ঢাকা অফিসের সহযোগিতায় গণমাধ্যম ও যোগাযোগবিষয়ক উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান সমষ্টি আয়োজিত সংলাপে ইউনেস্কো প্রণীত গণমাধ্যমে প্রতিবন্ধী সমতা বিষয়ক ব্যবহারিক নির্দেশিকার ভিত্তিতে প্রতিবন্ধী অন্তর্ভুক্তিমূলক চর্চা এগিয়ে নেওয়ার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়।
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং তাঁদের নিয়ে প্রচলিত নেতিবাচক সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে একটি সামাজিক-সাংস্কৃতিক জাগরণ সৃষ্টির ওপর জোর দিয়ে তারা বলেন, প্রতিবন্ধিতা বিষয়ে গণমাধ্যম যত বেশি সংবেদনশীল ও সক্রিয় হবে, রাজনৈতিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও সামাজিক কাঠামোয় তত বেশি ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। এজন্য গণমাধ্যমের সম্পাদকীয় নীতি ও চর্চায় প্রতিবন্ধিতার অন্তর্ভুক্তি জরুরি।
ঢাকা ট্রিবিউনের সম্পাদক রিয়াজ আহমদের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশে ইউনেস্কোর প্রতিনিধি ড. সুজান ভাইজ। বিশেষ অতিথি ছিলেন জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক মুহম্মদ হিরুজ্জামান। সমষ্টি’র নির্বাহী পরিচালক মীর মাসরুরুজ্জামান ব্যবহারিক নির্দেশিকার বাংলা রূপান্তরের সারসংক্ষেপ উপস্থাপন করেন। এ-টু-আই প্রকল্পের জাতীয় পরামর্শক ভাস্কর ভট্টাচার্য গণমাধ্যম বিষয়বস্তুতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রবেশগম্যতা বিষয়ে আলোচনা করেন এবং অনলাইন কনটেন্ট প্রবেশগম্য করার কিছু ব্যবহারিক দিক তুলে ধরেন।
ড. সুজান ভাইজ বলেন, “ঐতিহাসিকভাবে প্রতিবন্ধিতাকে সমাজে অভিশাপ হিসেবে দেখা হয়েছে। গণমাধ্যম এ ধরনের ধারণা বদলাতে শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে পারে। যতদিন এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি থাকবে, ততদিন বৈষম্য ও বাধা থাকবে, তা ব্যক্তি পর্যায়ে হোক বা নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে।”
তিনি আরও বলেন, “সচেতনতা বৃদ্ধি অবশ্যই জরুরি, তবে শুধু সচেতনতা নয়, কার্যকর পদক্ষেপে যাওয়া এখন সময়ের দাবি। এ দায়িত্ব পালনে গণমাধ্যমকে অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে।”
মুহম্মদ হিরুজ্জামান বলেন, “আমরা সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মীদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে প্রতিবন্ধিতাবিষয়ক বিশেষ অধিবেশন অন্তর্ভুক্ত করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করব। যাতে তারা আরও সংবেদনশীলতা, দায়িত্বশীলতা এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে প্রতিবেদন করতে সক্ষম হন।”
ভাস্কর ভট্টাচার্য বলেন, “প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রবেশগম্যতা ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে গণমাধ্যমগুলোর বর্তমান পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে তাদের জন্য উদ্বুদ্ধকরণ ও সক্ষমতা উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ করা প্রয়োজন।
রিয়াজ আহমদ বলেন, “প্রতিবন্ধিতাবিষয়ক সম্পাদকীয় নীতি ও সংবাদকক্ষের কার্যপ্রণালিতে পরিবর্তন আনতে হলে শুধু সাংবাদিক নয়, সংবাদকক্ষের অন্যান্য কর্মী ও ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধিতেও আমাদের বিনিয়োগ করতে হবে। গণমাধ্যমের সংস্কৃতিতে টেকসই পরিবর্তন তখনই আসবে, যখন প্রতিষ্ঠানটির সবাই অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রতিবেদনের জ্ঞান, দক্ষতা ও অঙ্গীকার ধারণ করবে।”
মীর মাসরুরুজ্জামান বলেন, সম্প্রতি বাংলাদেশের কনটেন্টের ব্যবহার উপযোগিতা নিশ্চিত করে গণমাধ্যমে প্রতিবন্ধী সমতা বিষয়ক ব্যবহারিক নির্দেশিকা প্রকাশনা হয়েছে। এর বাংলা ভাষান্তর করেছেন সাংবাদিক শাহনাজ মুন্নী। গণমাধ্যম কর্মীরা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উপর প্রতিবেদন তৈরিতে এই ব্যবহারিক নির্দেশিকা কাজে লাগাবেন।
তিনি আরো বলেন, মানবাধিকারভিত্তিক পদ্ধতিকে মূলধারায় নিয়ে আসতে প্রতিবেদন নির্মাণ বা গল্প বলার ক্ষেত্রে মানবাধিকারভিত্তিক পদ্ধতি অনুসরণ করতে পাঁচটি মূলনীতি মনে রাখতে হবে।অংশগ্রহণ, জবাবদিহি, বৈষম্যহীনতা, ক্ষমতায়ন এবং আইনগত বৈধতা।
বৈষম্য চিহ্নিত করে তা প্রকাশ করতে হবে। সমাজে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের পূর্ণ অংশগ্রহণে সামাজিক, আইনি বা নীতিগত বাধাগুলো নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করা। প্রতিবেদনে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকারের বিষয়টি তুলে ধরা। এছাড়া সমাজের ভ্রান্ত ও নেতিবাচক ধারণা চিহ্নিত করা। সমাজে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার তুলে ধরতে নীতি-নির্ধারকদের অংশগ্রহণে উন্মুক্ত সংলাপ অনুষ্ঠান চালু করা প্রয়োজন। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এবং এর কার্যকারণ ও নীতিমালার অকার্যকারিতা নিয়ে অনুসন্ধানের মাধ্যমে দায়িত্বশীলদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা।
সোহরাব হোসেন বলেন, গণমাধ্যম কিভাবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের তুলে ধরে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে ভূমিকা পালন করবে সেটাও গুরুত্ব দিতে হবে। এক তৃতীয়াংশ যদি প্রতিবন্ধী ব্যক্তি হয়, অর্ধ কোটি মানুষ কোনো না কোনোভাবে প্রতিবন্ধিতার শিকার হয়। তাদের প্রতি মনোযোগ দেওয়া দরকার। এই মনোযোগটা পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র দিচ্ছে কিনা তা দেখা।
শাহনাজ মুন্নী বলেন, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের আমরা মানবাধিকারের দৃষ্টিভঙ্গীতে দেখব। একজন মানুষ যেসব সুযোগ সুবিধা পাবেন, সেসব অধিকারের প্রতিটি একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তির পাওয়ার অধিকার রয়েছে। আমাদের গণমাধ্যমের পাঠক, শ্রোতা, দশক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরাও। কিন্তু আমরা যখন সংবাদ, অনুষ্ঠান পরিবেশন করি, তখন তাদের কথা ভাবি না ।
শাহনাজ শারমিন এর মতে, একটি বিদ্যালয় যখন প্রতিষ্ঠা বা সংস্কার করা হবে তখনি একই খরচের মধ্যে প্রতিবন্ধী
ব্যক্তিদের প্রবেশগম্যতার জন্য রেম নির্মাণ করা হবে। কিন্তু শিক্ষা ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়হীনতার কারণে তা হয়নি। যে প্রকৌশলী ডিজাইন করবে তিনি এই বাজেটের মধ্যে প্রতিটি বিদ্যালয়কে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রবেশগম্যতা করাবে। যে বিদ্যালয়ে হুইলচেয়ারে প্রতিবন্ধী শিক্ষাথীরা পড়ে তাদের ক্লাস দোতলা / তিনতলায় হলে তাদের ক্লাস একতলায় হবে। প্রতিবন্ধী শিক্ষাথীরা শিক্ষকদের বলতে না পারায় বিদ্যালয়ে থেকে ঝরে পড়ে।
সংলাপে অংশ নেন বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সাংবাদিক সংগঠনের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের প্রতিনিধি এবং উন্নয়ন ব্যক্তিত্বরা । প্যানেল আলোচনায় অংশ নেন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক সোহরাব হাসান, চ্যানেল আইয়ের চিফ এক্সিকিউটিভ এডিটর এম জাহিদ নেওয়াজ খান, লেখক ও সাংবাদিক শাহনাজ মুন্নী, যুগান্তরের শুচি সৈয়দ, মানবজমিনের কাজল ঘোষ, বিএফইউজের আরফানুল হক নাহিদ, ক্র্যাবের এম এম বাদশাহ্, জাতীয় প্রেসক্লাবের শাহনাজ বেগম পলি, বিজেসির শাহনাজ শারমিন, ডিআরইউ’র নাদিয়া শারমিন, উইমেন আই২৪.কমের রীতা ভৌমিক, ইত্তেফাকের রাবেয়া বেবী, ডেইলি স্টারের নীলিমা জাহান, বি-স্ক্যানের সুমনা খান, সাইট সেভার্সের অয়ন দেবনাথ, এসআরএস-এর সিকান্দার আলী মিনা, আরবান-এর আরিফুজ্জামান প্রমুখ ।
উপস্থিত সাংবাদিকরা তাদের চর্চায় ব্যবহারিক নির্দেশিকা অনুসরণের অঙ্গীকার করে প্রতিশ্রুতিপত্রে স্বাক্ষর করেন।
ইউ