ঢাকা, বাংলাদেশ

মঙ্গলবার, ৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৯ মার্চ ২০২৪

English

বৃত্তের বাইরে

‘আব্বার স্মৃতি গুলো জ্বলজ্বল করুক আমার মনিকোঠায়’

মীর তাওহিদা তাসনীম তুলি

প্রকাশিত: ১৮:১৬, ৫ নভেম্বর ২০২২; আপডেট: ১৯:২৭, ৫ নভেম্বর ২০২২

‘আব্বার স্মৃতি গুলো জ্বলজ্বল করুক আমার মনিকোঠায়’

আব্বার স্মৃতি গুলো জ্বলজ্বল করুক আমার মনিকোঠায়

"তুলি... আম্মা... 
সকাল হইছে, ঘুম থেকে উঠো, আস্তে আস্তে ঘুম ভাঙ্গো"
প্রতিদিন সকালে আব্বা এভাবেই আমার ঘুম ভাঙ্গাতেন।

আমারও আব্বার মত রাত জেগে পড়ার অভ্যাস। আরও অনেক বিষয়ে নাকি আব্বার সাথে আমার মিল আছে।
ছোটবেলা থেকে শুরু করে তিনি যতদিন বেঁচে ছিলেন বিশেষ করে শারীরিক অসুস্থতার সময় আব্বার সাথে আমার অনেক জায়গায় যাবার সৌভাগ্য হয়েছে। যেহেতু ছোট সন্তান, তাই ছোটবেলায় নিয়ে যেতেন শখ করে কিন্তু জীবনের শেষ সময়ে আমাকে সাথে রাখতেন ভরসা হিসেবে।এক হাতে থাকতো লাঠি,অন্য হাতে ধরে রাখতো আমার একটি হাত।

আব্বা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ (পুরুষ) ময়মনসিংহ এর চারুকলা বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। যেহেতু আমরা কোয়ার্টারে থাকতাম, সেহেতু আমার স্কুল ছিল কোয়ার্টারের ভিতরে সরকারি ল্যাবরেটরী হাই স্কুল, ময়মনসিংহ। আমার স্কুল ছুটির পরে আব্বা আমাকে উনার ক্লাশের সামনের চেয়ারে বসিয়ে রেখে ক্লাশ করাতেন।  

আমি মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আব্বার লেকচার শুনতাম।
উনার সাথে যখন কোথাও বের হতাম, দেখতাম সবাই সালাম দেয়, সম্মান করে, শ্রদ্ধা করে। তখন থেকেই মনোস্থির করলাম-"আমি জীবনে চাকরী করলে আব্বার মত একজন শিক্ষক হবো।"  

আজ আমি একজন শিক্ষক। আমার এই পেশা বেছে নেয়াটাকে আব্বা গর্বের সাথে সবাইকে বলতেন। আব্বার মত এই মহান পেশাটাকে আমিও ভালোবাসি।

আমার গ্রুমিং এর চালকের আসনে বসা ছিলেন আব্বা-আম্মা দু'জনই।পারিবারিক গ্রুমিংটা খুব দরকার সন্তানের জন্য, পারিপার্শ্বিক অবস্থাতো আছেই। 

আব্বা শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন এর সরাসরি ছাত্র ছিলেন। ময়মনসিংহে অবস্থিত "শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা ও আর্ট স্কুল" এর প্রতিষ্ঠাকালীন অধ্যক্ষ। তিনি বিভিন্ন সামাজিক,সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথেও জড়িত ছিলেন।তিনি জীবদ্দশায় অসংখ্য সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন।

একাধারে তিনি ছিলেন চিত্রশিল্পী, কবি, সাহিত্যিক, সৎ, সদাহাস্যোজ্জ্বল, শিল্পীমনা, ব্যক্তিত্ববান একজন ব্যক্তিত্ব। যিনি আপাদমস্তক ছিলেন একজন সাদা মনের মানুষ।

অসুস্থ হলে বুঝা যায়, একজন বাবা-মা তার সন্তানের উপর কতটা নির্ভরশীল। আব্বা আমার মাথার উপর সব সময় তার আস্থা, নির্ভরতা ও বিশ্বস্ততার হাতটা রেখেছিলেন। আমি বিশ্বাস করি এখনও আমার মাথার উপর হাতটা আছে।

দীর্ঘদিন শারিরীক অসুস্থতার সাথে লড়াই করে ২০১৯ সালের ৫ নভেম্বর পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে আমাদের সবাইকে ছেড়ে চলে যান।

আব্বা বেঁচে থাকতেও অনুভব করেছি, এখন আরও বেশি অনুভব করি। মনে হয়, আমি আমার জীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষকে হারিয়ে ফেলেছি। যার কাছ থেকে আমার আরও অনেক কিছু জানার ছিল, শেখার ছিল।
আমার অহংকার, আমার আদর্শ,আমার শিক্ষাগুরু আমার আব্বা।আমি তার সন্তান হয়ে গর্বিত।

লিখতে লিখতে অনেক স্মৃতিই মনে মধ্যে হুমরি খেয়ে পড়ছে, আর চোখ দিয়ে গরিয়ে পানি পড়ছে।স্মৃতির অনুভূতি লিখায় ব্যক্ত করা যায় না,শুধু অনুভব করা যায়। 

আব্বার সাথে আমার কাটানো সময়গুলো এখন শুধুই স্মৃতি। স্মৃতিগুলো নিঃশব্দে কাঁদে। তবুও স্মৃতিগুলো বেঁচে থাকুক। আমার ভিতরে জ্বল জ্বল করুক। আমি ভুলতে চাইনা। মনে রাখতে চাই আমৃত্যু। আব্বার স্মৃতিগুলো আমার শক্তি, অনুপ্রেরণা।
শুধু একটাই কষ্ট আমার এখন আর মন ভরে আব্বা ডাকতে পারিনা..
আব্বা...আব্বা...আব্বা....

//জ//