ফাইল ছবি
ঊনিশ শতকের শেষের দিকে মুসলমানদের জাতীয় জীবনে আসে এক চরম যুগ সন্ধিক্ষণ। সে যুগে পুরুষশাসিত সমাজে সমগ্র মুসলিম নারীসমাজে বিরাজিত দু;খ দূর্দশা তাপ গ্লানি শাপ অভিশাপের বেড়াজাল থেকে এবং পুরুষের কামনা বাসনার একমাত্র পুতুল, হাতে পায়ে বেরি দেওয়া নারীসমাজকে যিনি দেখিয়েছিলেন সুর্যের মুখ, যিনি আশ্বাস দিয়েছিলেন নারীদের সম্পূর্ন আলাদা সত্তা নিয়ে পৃথিবীতে বিচরণ করার, যিনি মোমবাতির মৃদু আলোকশিখায় আলোকিত করেছিলেন নারীর মুখাবয়ব, যিনি শীলনোড়া ঠেলেও নারীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন বর্ণ পরিচয়ের ছবি, যিনি দেখিয়েছিলেন নারীর অন্ধ দুচোখে জ্ঞানের আলো, যিনি শুনিয়েছিলেন- ''জাগো বংগবাসী/দেখো কে দুয়ারে/ অতি ধীরে ধীরে /করে করাঘাত'। মুসলিম নারী শিক্ষার কথা আলোচনা করতে গেলে বেগম রোকেয়ার জন্মের পূর্বের নারীদের ইতিহাস একটু আলোচনা করতেই হয়। এমন এক যুগ ছিলো সেদিন, মুসলিম নারীসমাজ ছিলো সম্পূর্ণ অসূর্যম্পর্শা। বই হাতে নেওয়া কথাটাই তখন এদের জন্য পাপের আঁধার। তখনকার সেই সময়াটাতে পুরুষশাসিত সমাজ ছিল মধ্যযুগীয় অন্ধকারে নিমজ্জিত । কুসংস্কার আর গোড়ামির ওপর ভিত্তি করে দুর্দান্ত প্রতাপে সমাজপতিরা সমাজব্যবস্থা পরিচালনা করতেন। সমাজের কঠোর অনুশাসন, অন্ধ কুসংস্কার,সংকীর্ণ স্বার্থবুদ্ধির জন্য নারীর জীবনের সম্ভাবনাকে, নারীর আলাদা সত্তাকে কোনো রকমের স্বীকৃতি দেওয়া হতো না । শাস্ত্রীয় বিধান আর সামাজিক অনুশাসনের দোহাই দিয়ে স্বামীর পদসেবা, সন্তান উৎপাদন, গৃহের চার দেওয়ালের মধ্যে বন্দি থাকার মধ্যেই বিচার করা হতো নারী জীবনের সার্থকতা । কিন্তু এখন সে যুগের অবসান ঘটেছে। কুসংস্কারচ্ছন্ন, স্থুলবুদ্ধিসম্পন্ন স্বার্থান্বেষী পুরুষসমাজ আজ নারীর আলাদা অস্তিত্বকে স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছে। সমাজের কঠিন অনুশাসন আর প্রতিবন্ধকতা ডিংগিয়ে, শতবাধার প্রাচীর পেরিয়ে এই বীর নারী দৃঢ়্রতা আর সা্হসিকতার সংগে অবহেলিত নারীসমাজকে সর্বপ্রথম আলোর পথ দেখালেন।বেগম রোকেয়া এমনই এক মহীয়সী নারী যিনি তার যুগে একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভুত হয়েছিলেন।প্রচলিত সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে।কিন্তু তার সে যুদ্ধে তার হাতে ছিল না কোনো ঢাল,ছিল না শাণিত তরবারি, ছিল না গোলন্দাজ,অশ্বারোহী। তার হাতে প্রয়োজনীয় উপকরণ নেই তাতে কি? তার ছিল শাণিত বাক্যবাণ। আর ছিলো ক্ষুরধার লেখণী। বিন্দুমাত্র নিরাশ না হয়ে বরং স্বীয় বিশ্বাসে অটল থেকে তিনি লেখনি হাতে তুলে নিয়েছিলেন। অসির স্থান দখল করেছিল মসি। অবরোধবাসিনী নারীসমাজকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে আসার জন্য মাত্র মাত্র ৫ জন ছাত্রী নিয়ে প্রতিষ্ঠা করলেন সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল। সেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি ছিল প্রকৃত অর্থে নারী জাগরণের একটি প্রতীক,যাকে কেন্দ্র করে পরবর্তী কালে গড়ে উঠেছিল বিরাট কর্মযজ্ঞ। বেগম রোকেয়ার সমাজসচেতনতা ছিলো সুতীক্ষ্ণ দূরদর্শিতা এবং কল্যাণ কামনায় অভিসিক্ত। পশ্চাদ্পদ ধর্মান্ধ সমাজের প্রবল বাধার মধ্যেও তিনি ধৈর্য্য নিষ্ঠা সহনশীলতার সাথে ভবিষ্যতের রূপ রেখা অংকিত করেছিলেন ৷ এ যুগের নারীদের কাছে এটি রূপকথার মতোই। কিন্তু সে ছিলো এক জীবন্ত ইতিহাস। মহীয়সী বেগম রোকেয়া ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত সাবের পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।বাবা মুহম্মদ নুর সাবের জহীরউদ্দিন মুহাম্মদ আবু আলী হায়দার সাবের ছিলেন বিদ্বান।কিন্তু অত্যন্ত রক্ষণশীল, আভিজাত্যবোধ সম্পন্ন ব্যক্তি। মা রাহাতুন্নেছা সাবেরা চৌধুরানী । বাবা মায়ের দিক থেকে বেগম রোকেয়া উচ্চ বংশীয় এবং জমিদার শ্রেনিভুক্ত। কুর্সিনামা থেকে জানা যায় তার পুর্ব পুরুষ ইরানের তাব্রিজ শহর থেকে ভাজ্ঞান্বেষনে ভারতবর্ষে আসেন এবং পায়রাবন্দ অঞ্চলে জমিদারি স্থাপন করেন। পায়রাবন্দের জমিদারি সম্বন্ধে রোকেয়া বলেন’ আমাদের অবস্থা সচ্ছল ছিল-আম্রা খাইয়া পরিয়া,গা ভরা গহ্নায় সাজিয়া থাকিতাম। কোথায়?আমাদের এ অরণ্য বেষ্টিত বাড়ির তুলনা কোথায়?সাড়ে তিন বিঘা লাখে রাজ জমির মাঝখানে কেবল আমাদের এই সুবৃহৎ বাড়ি ৫বছর বয়স থেকেই এই পরিবারের সন্তান হিসেবে তাকে কঠিন পর্দার অন্তরালে বসে তাকে তোতা পাখির মতো আরবি ফার্সি বয়ান মুখস্ত শেখা ছাড়া আর কোনো বই হাতে নেওয়া ছিল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ । এ সম্পর্কে বেগম রোকেয়ার উক্তি ''বাচ্চাওয়ালা মুরগি আকাশে চিল দেখিয়া ইংগিত করিবা মাত্র তার ছানাগুলো মায়ের পাখার নিচে লুকায়, আমাকেও সেইরূপ লুকাইতে হইত।’ এরকম কঠিন হেরেমে বন্দি তার প্রতিভাসম্পন্ন শিশুমন সারাক্ষণ আলো খুঁজে ফিরত। গভীর রাতে মোমবাতির মৃদু আলোয় শিশু মনের জ্ঞান তৃষ্ণা নিবারণে সাহায্য করতেন তার আপন বড় দুই ভাই। তারা লুকিয়ে লুকিয়ে বোনকে সা্হায্য করতেন। দুই ভাই ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন। বড়ভাই ইব্রাহিম সাবের তাকে ইংরেজি শিক্ষা লাভে উৎসাহ দিয়ে বলতেন,’’ বোন,এই ইংরেজি ভাষাটা যদি শিখতে পারিস,তাহলে তোর সামনে এক রত্ন ভাণ্ডারের দ্বার খুলে যাবে।” আর বড়বোন করিমুন্নিসার কাছ থেকে বাংলা শিখেছিলেন। প্রাথমিক গৃহ শিক্ষই পরবর্তী জীবনে অনেকটা বৃহত্তর কর্মক্ষেত্রের পথরেখা একে দিয়েছিল। রক্ষণশীল অথচ সাহিত্যানুরাগী পিতাও এক সময় কিছুটা সহানুভুতিশীল হলেন। আর তাই কন্যাকে কিছু কিছু বাংলা শেখানোর ব্যবস্থাও করে দিলেন। মাত্র ১৬ বছর বয়সে ১৮৯৬ সালে পাটনা জেলার ভাগলপুরে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট , খান বাহাদুর সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সাথে বেগম রোকেয়ার বিবাহ হয়। উচ্চ শিক্ষিত বিত্তবান উদারচেতা সাখাওয়াত হোসেন রোকেয়ার শিক্ষানুরাগকে প্রীতির চোখেই দেখলেন। স্বামীর অপার অনুকুল উৎসাহ উদ্দীপনা অনুপ্রেরণা রোকেয়ার চিন্তা ও কর্মের জগতকে, তার উচ্চশিক্ষার পথকে সহজ করে দেয়। স্বামীর প্রচেষ্টায় রোকেয়ার মানস চক্ষু আরো উন্মিলিত হতে লাগলো। স্বামী তাকে নিয়ে দেশে বিদেশে ভ্রমণ করেছেন বিচিত্র অভিজ্ঞতায় ভরে দিয়েছেন রোকেয়ার অন্তরকে। খুলে দিলেন তার চোখের তারার স্বপ্নীল জগতকে। স্বামীর আপ্রাণ চেষ্টায় রোকেয়ার কাব্য সাধনা শুরু হলো । খুব দূর্ভাগ্যবশত তাদের দুটি কন্যা জন্মের পর কয়েক মাসের মধ্যেই মারা যায় । ১৯০৯ সালে দূরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে তার স্বামী সাখাওয়াত হোসেন মৃত্যবরণ করলে বেগম রোকেয়া বৈধব্য জীবন বেছে নেন এবং ভাগলপুরের ভীটামাটি ছেড়ে কলকাতায় এসে বসবাস শুরু করেন। সমাজ সেবামূলক কাজে ও সাহিত্য চর্চায় আত্মনিয়োগ করেন। প্রগতিশীল রোকেয়া নারী স্বাধিকার ও সম অধিকারের প্রবক্তা ছিলেন। বাংলার মুসলিম নারীসমাজের অগ্রগতি সাধনের জন্য ১৯১৬ খৃষ্টাব্দে ‘আন্জূমানে খাওয়াতীনে ইসলাম’’ নামে একটি মুসলিম মহিলা সমিতি স্থাপন করেন। এই সমিতির কার্যক্রম সম্পর্কে সুফি মোতাহার হোসেন তার ‘'বেগম রোকেয়া ‘'গ্রন্থে বলেছেন' জাতি গঠনমূলক কাজের জন্য আন্জুমান নাম ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে। আন্জুমান অজস্র বিধবা নারীকে অর্থ সা্হায্য করেছে।চরিত্রহীন স্বামীর অত্যাচার থেকে বহু অসহায় বধূকে রক্ষা করেছে। বয়:প্রাপ্ত দরিদ্র কুমারিকে সৎপাত্রস্থ করেছে।অভাবগ্রস্থ মেয়েদের শিক্ষা গ্রহনে নানা ভাবে সাহায্য করেছে।’
২৩ বছরের বৈধব্য জীবনে তার এই সব প্রতিভার স্ফূরণ ঘটে।মুসলিম নারী জাগরণের অগ্রদুত হিসেবে তার শিক্ষা বিস্তার প্রচেষ্টা, নিরলস সাহিত্য চর্চার ভেতর দিয়ে পুরুষশাসিত কূপমণ্ডূক সমাজের গণ্ডি থেকে অবগুন্ঠণবতি ও অবরুদ্ধ মুসলিম নারীকে মুক্ত করতে যে মহতি প্রয়াস তিনি করেন,যা তার অসাধারণ প্রতিভা ও সমাজ সচেতনতারই পরিচায়ক।
বৈচিত্র্যময় প্রতিভার অধিকারী, বাংলার মুসলিম সমাজের এক বিরল ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন বেগম রোকেয়া। ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর এই মহীয়সী নারীর মহা প্রয়াণ ঘটে।
//এল//