ছবি: অধ্যাপক রোকসানা পারভীন সাথী, মিরপুর বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ...
বাংলার যাবতীয় ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা ও কুসংস্কার এবং রক্ষণশীলতার আবহমান প্রথার চৌকাঠ মারিয়ে সাবলীল দৃষ্টিভঙ্গির সংস্কৃতিতে আসতে পেরেছি আমি, আমরা ও অনেকেই। যদিও পরিবারের কাছ থেকেই আমাদের চেতনার প্রথম পাঠ ও হাতেখড়ি হয়েছিল। তবে এ কথা বলা নিতান্তই মিথ্যে নয় যে রক্ষণশীলতায় মোড়া বাংলার পারিবারিক শিক্ষার প্রথম চেতনাতেই ছেলেকেই শৌর্যবীর্যের প্রতীক হিসেবে প্রাধান্য দেওয়া হয়ে থাকে। এ সমাজে একজন মেয়েকে একটি নির্দিষ্ট গণ্ডির ভেতরে আবদ্ধ থেকে কীভাবে শুধু ঘরের মানুষের দেখভালের দায়িত্বজ্ঞান অর্জন করবে এবং বিয়ে পরবর্তী স্বামীকে কেমন সেবা দিতে হবে এমন শিক্ষাই দেয়া হয়! শুধু বাংলায় নয়, বলতে গেলে উপমহাদেশের তথা দক্ষিণ এশিয়ার অধিকাংশ নারীই নানাবিধ বৈষম্যের শিকার, বহু বহু সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। এ অঞ্চলে মেয়ে হয়ে জন্মানোর খেসারত বহুবিধ। বঞ্চনার এ প্রথা ভাঙতে হবে নিজেদেরকেই। প্রতিটি নারীকেই নিজ যোগ্যতাবলে প্রমাণ করতে হবে পুরুষের চেয়ে একজন নারীও কোনো অংশে পিছিয়ে নেই।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীদেরকে নেতৃত্বদানকারী ভূমিকায় উন্নীত করার বদলে গৃহস্থালি কর্মকাণ্ডের সাতপাকেই আবদ্ধ করে রাখে। ধর্মীয় গোঁড়ামিতে মদদপুষ্ট সাংস্কৃতিক বিধিবিধান নারীদের সামাজিক জীবনে প্রবেশাধিকারের পথকে কুসুমাস্তীর্ণ নয়, করে রেখেছে কন্টকাকীর্ণ।
সাম্প্রতিক সময়ে উন্নয়নে নারী বা নারী উন্নয়ন একটি আধুনিক ধারণা যা বৈশ্বিক ও জাতীয় পর্যায়ে সামাজিক, অর্থনৈতিক উন্নয়নে নারীর গুরুত্বপূর্ণ অবদানকে স্বীকার করে। গভর্নেন্স (Governance) বা সুশাসন প্রক্রিয়া শব্দটি উন্নয়নের শব্দভাণ্ডারে যুক্ত হয়েছে। যদিও গভর্নেন্স বা সুশাসন প্রক্রিয়ার বিষয়টি আমাদের সভ্যতার মতোই পুরোনো। উন্নয়ন নীতিকৌশলের সাথে আবশ্যক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে বিবেচিত গভর্নেন্স বিষয়টি।
বাংলাদেশ,ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কাসহ গোটা দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে নারী নেতৃত্বের বিস্ময়কর উত্থান ঘটলেও পরিসংখ্যানের চিত্র খুবই পীড়াদায়ক। গভর্নেন্স বা সুশাসন প্রক্রিয়ায সর্বক্ষেত্রেই নারীদের অপ্রতুল উপস্থিতি রাষ্ট্রপ্রধানের মতো শীর্ষপদে নারীদের আসীন হবার গৌরবকে অনেকটাই ম্লান করে দেয়।
এই অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ নারী নিরক্ষর ও রুগ্ন স্বাস্থ্যের। জাতীয় হিসাবরক্ষণ ব্যবস্থার কাছে এসব পশ্চাৎপদ ভঙ্গুর নারী মূলত অদৃশ্য। বস্তুত দক্ষিণ এশিয়ার নারীরা জীবনের সকল ক্ষেত্রেই আইনগত, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক বঞ্চনার শিকার। গভর্নেন্স কাঠামোতেও নারী অংশগ্রহণের হার সর্বনিম্ন।
দক্ষিণ এশিয়া গভর্নেন্স কাঠামোতে নারী উপস্থিতি হার: * সংসদীয় আসনের মাত্র ৭ শতাংশ নারীর দখলে * মন্ত্রিসভায় নারীদের অংশগ্রহণের হার মাত্র ৭ শতাংশ * বিচার বিভাগের পদগুলোর মাত্র ৬ শতাংশ পদে নারীরা আসীন * সরকারি চাকরির মাত্র ৯ শতাংশ হচ্ছে নারী * স্থানীয় সরকারের মাত্র ২০ শতাংশ সদস্য নারী।
জনসংখ্যার অর্ধেক হলেও গভর্নেন্স বা সুশাসন প্রক্রিয়ার সকল প্রতিষ্ঠানে আজো প্রায় অদৃশ্য নারীরা।
সাম্প্রতিক সময়ে ভারত ও বাংলাদেশে অন্যান্য গভর্নেন্স কাঠামোর চাইতে স্থানীয় সরকারে বিপুল সংখ্যক নারীর উজ্জ্বল উপস্থিতি গোটা বিশ্বে আলোড়িত। সামগ্রিক বিচারে এ অঞ্চলের গভর্নেন্সের সর্বস্তরে জেন্ডার বৈষম্যের সর্বগ্রাসী সংকট টেকসই উন্নয়নের মূল স্রোতধারায় বিরাট প্রতিবন্ধক হিসেবে বিবেচ্য।
বাংলাদেলসহ গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় ঐতিহ্যগতভাবে নীতিনির্ধারণ বা সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়টি একচেটিয়াভাবে পুরুষের দখলে। বিগত কয়েক দশকে নারীর মর্যাদা বৃদ্ধি পেলেও তা শহরকেন্দ্রিক। শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণির নারীরা সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে কিছুটা স্বাধীনতার স্বাদ পায় কালেভদ্রে। নারীর এই পরাধীনতা পরিবারে ও সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রোথিত প্রথারই ফল; যেখানে সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়টি পুরুষতান্ত্রিকতারই চরম পরাকাষ্ঠা।
নারীরা সমাজের অর্ধেক অংশ। দেশের মূল জনশক্তির অর্ধাংশই নারী। বিশাল সংখ্যক এই নারীসমাজকে উন্নয়নের মূল স্রোতধারায় সামিল করতে না পারলে দেশের, রাষ্ট্রের, সমাজের সার্বিক টেকসই ও কাঙ্ক্ষিত সাফল্য - শ্রীবৃদ্ধি কখনোই সম্ভব নয়।
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নারী জাগরণের, নারীর মুক্তির পথিকৃৎ ও নিবেদিত প্রাণ প্রতিভা বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। বিংশ শতাব্দির একেবারে প্রথম সোপানে যখন রোকেয়ার উত্থান, বাঙালি নারী তখন অন্ধকারে, কুসংস্কারের বেড়াজালে আবর্তিত।
বহু কাঙ্ক্ষিত জাগরণের অনির্বাণ শিখা বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন দেশ-কাল-জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমস্ত মানুষের সমানাধিকারের প্রসঙ্গে দ্বর্থ্যহীন কণ্ঠে বলেছেন ' অর্ধাঙ্গী' প্রবন্ধে। মানুষের সমানাধিকারের চমৎকার দৃষ্টান্ত আজো মননের দরোজায় করাঘাত করে যেন! বেগম রোকেয়া বলেছেন , "মনে করুন কোন স্থানে পূর্বদিকে একটি বৃহৎ দর্পণ আছে, যাহাতে আপনি আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করিতে পারেন। আপনার দক্ষিণাঙ্গভাগ পুরুষ এবং বামাঙ্গভাগ স্ত্রী। এই দর্পণের সম্মুখে দাঁড়াইয়া দেখুন : আপনার দক্ষিণ বাহু দীর্ঘ ( ত্রিশ ইঞ্চি) এবং স্থূল, বামবাহু দৈর্ঘ্যে চব্বিশ ইঞ্চি এবং ক্ষীণ। দক্ষিণ চরণ দৈর্ঘ্যে ১২ ইঞ্চি, বাম চরণ অতিশয় ক্ষুদ্র। দক্ষিণ স্কন্ধ উচ্চতায় পাঁচ ফিট, বাম স্কন্ধ উচ্চতায় চারি ফিট! (তবেই মাথাটা সোজা থাকিতে পারে না, বাম দিকেও একটু ঝুঁকিয়াছে !) দক্ষিণ কর্ণ হস্তিকর্ণের ন্যায় বৃহৎ, বাম কর্ণ রাসভকর্ণের ন্যায় দীর্ঘ! দেখুন!-- ভাল করিয়া দেখুন, আপনার মূর্ত্তিটা কেমন !! যদি এ মূর্ত্তিটা অনেকের মনোমত না হয়, তবে দ্বিচক্র শকটের গতি দেখাই। যে শকটের এক চক্র বড় (পতি) এবং এক চক্র ছোট (পত্নী) হয়, সে শকট অধিক দূরে অগ্রসর হইতে পারে না; সে কেবল একই স্থানে (গৃহকোণেই) ঘুরিতে থাকিবে। তাই ভারতবাসী উন্নতির পথে অগ্রসর হইতে পারিতেছেন না।"
পরিশেষে বলতে চাই,
'নারীকে তার প্রাপ্য দিলে
দেশ ও দশের সুফল মিলে।'
ফলশ্রুতিতে নারীরা আত্মনির্ভরশীল হয়ে ওঠে। নারীর ব্যবস্থাপনা ও প্রশাসনিক দক্ষতা বৃদ্ধি পায় এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ সক্ষমতার প্রসার ঘটে অনিবার্যভাবে।
স্বাবলম্বী, আত্মনির্ভরশীল নারী দেশ ও জাতির সম্পদ। টেকসই উন্নয়নের শ্রীবৃদ্ধিতে সার্বিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। শিক্ষিত ,নারীরা অনেক আত্মনির্ভরশীল নারীর পরিবার আলোকিত পরিবার। অনেক কম দুর্নীতিপরায়ণ হয় আত্মনির্ভরশীল নারী।
স্বাবলম্বী নারীর ক্ষমতার অপব্যবহারও অনেক কম। নীতি- নৈতিকতা- মূল্যবোধের ইতিবাচক দীক্ষায় শিক্ষিত হতে থাকে আদর্শ স্বাবলম্বী মায়ের সন্তান। আলোয় আলোয় ভরে ওঠে গোটা পরিবার। ঘরে-ঘরে, মহল্লায়, পাড়ায়, গ্রামে-গঞ্জের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ুক আলোর ফুলকি। আলোর এই সারথিরাই গড়বে--- ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত, শোষণমুক্ত, দুর্নীতিমুক্ত ...বঙ্গবন্ধুর ধানশালিকের সবুজ সোনার বাংলাদেশ।
ইউ