
সংগৃহীত ছবি
বাংলা সাহিত্যের গগনে কাজী নজরুল ইসলাম এক ব্যতিক্রমী জ্যোতিষ্ক, যিনি ছিলেন একাধারে কবি, সাহিত্যিক, সুরকার, সাংবাদিক, সৈনিক ও সমাজসংস্কারক। তাঁর সাহিত্যপ্রতিভা শুধু কাব্য ও গানে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং তা বিস্তৃত ছিল গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, শিশুসাহিত্য, অনুবাদ ও রাজনৈতিক ভাষণে। নজরুলের সাহিত্য জীবন ছিল বহুবর্ণিল, বহুমাত্রিক এবং বিপ্লবী এক অভিব্যক্তি—যা যুগে যুগে মানুষকে উজ্জীবিত করে চলেছে।
তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত রূপ ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে, তবে নজরুল শুধু বিদ্রোহের নয়, ভালোবাসারও কবি। তাঁর কণ্ঠে ছিল অবিচার ও শোষণের বিরুদ্ধে বজ্রগর্জন, আবার একইসঙ্গে প্রেম ও মানবতার স্নিগ্ধ কণ্ঠস্বর। ধর্মীয় সাম্য, নারী-পুরুষ সমতা, শ্রেণিহীন সমাজব্যবস্থা এবং উপনিবেশবিরোধী চেতনায় তাঁর সাহিত্য ছিল সুদৃঢ়, আপসহীন ও প্রগতিশীল।
নজরুল এমন এক সময়ে আবির্ভূত হন, যখন সমাজে ধর্মীয় বিভাজন, বর্ণবাদ, ব্রাহ্মণ্যবাদ, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতা এবং নারীর প্রতি বৈষম্য প্রকট। তিনি তাঁর সাহিত্য দিয়ে এসব কৃত্রিম প্রাচীর ভেঙে দিতে চেয়েছেন। হিন্দু-মুসলিম ঐক্য তাঁর সাহিত্যিক ও রাজনৈতিক আদর্শের কেন্দ্রস্থলে ছিল। তাঁর গান, প্রবন্ধ ও কবিতা যেমন মানুষকে উজ্জীবিত করেছে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে, তেমনি আজও তা অনুপ্রাণিত করে সমাজে সাম্য ও মানবাধিকারের সংগ্রামে। কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যে শুধু একটি নাম নয়, তিনি একটি চেতনা, এক অবিনাশী আত্মার প্রতিনিধিত্বকারী কণ্ঠ—যাঁর প্রাসঙ্গিকতা সময়ের সীমানা ছাড়িয়ে চিরন্তন হয়ে উঠেছে। তাঁর সাহিত্য কেবল বিদ্রোহ নয়, তাঁর কবিতা, গান, প্রবন্ধ ও বক্তৃতা ছিল এক বিশাল সামাজিক আন্দোলনের ভাষ্য।
বর্তমান বাংলাদেশ একদিকে নতুন সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উন্নয়নের পথে হাঁটতে চলেছে, অপরদিকে নানা শ্রেণি বৈষম্য, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা, নারী নির্যাতন, শ্রমজীবী মানুষের শোষণ ও দলিত-সংখযালঘু ও আদিবাসীদের বঞ্চনার বাস্তবতায় প্রতিনিয়ত দ্বন্দ্বে জর্জরিত হচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে নজরুলের চেতনা আবারও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। তাঁর সাহসী কণ্ঠস্বর আজও তরুণ প্রজন্ম, সামাজিক আন্দোলন ও অধিকারকেন্দ্রিক সংগঠনের মধ্যে অনুরণিত হয়।
নজরুল ইসলাম প্রথম জীবনে সৈনিক, পরে সাংবাদিক, আবার একইসঙ্গে কবি, সাহিত্যিক ও সুরকার। কিন্তু এই বহুবিধ পরিচয়ের অন্তর্নিহিত সুর ছিল—মানবিকতা। তিনি ছিলেন নিপীড়িত মানুষের কণ্ঠস্বর। তাঁর কবিতা “বিদ্রোহী”,“মানুষ”, “দারিদ্র্য”, “ভিক্ষুকের গান”—এসব কাব্য মানবমুক্তির গান। তিনি বলেছিলেন: “আমি চির-বিদ্রোহী বীর— আমি বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির।” কিন্তু তাঁর এই বিদ্রোহ রাজনৈতিক ক্ষমতার বিরুদ্ধে যতটা, তার চেয়ে বেশি ছিল সমাজে প্রথিত বৈষম্য ও অবিচারের বিরুদ্ধে। নজরুল কোনো ধর্মের প্রচারক ছিলেন না, তিনি ছিলেন ধর্ম-উত্তরণবাদী। হিন্দু ও মুসলিমের মধ্যে কৃত্রিম বিভেদ তিনি কখনো মানেননি। তাঁর লেখা “ধূমকেতু”, “কাণ্ডারি হুঁশিয়ার”, “মোহররম”—এসব সাহিত্যকর্মে এক নব ধর্মনিরপেক্ষতার বীজ রোপিত হয়। সাম্প্রদায়িক হামলা, মন্দির ভাঙচুর, ধর্মীয় কটুক্তি ইত্যাদি ঘটনার প্রতিবাদে নাগরিক সমাজ যে ভূমিকা রাখছে, তা নজরুলের ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদী দর্শনকে পুনরুজ্জীবিত করে। নজরুল নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে শুধু আবেগ নয়, যুক্তি ও দর্শনের ভিত্তিতে নারীকে স্বতন্ত্র মানবসত্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, সমাজে নারীকে গৃহবন্দিনী ও পরাধীন রেখে প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব নয়। নজরুলের চেতনায় নারী শুধু মা, বোন বা প্রেয়সী নন—তিনি সহযাত্রী, সংগ্রামী ও স্বাধিকার চেতনার প্রতীক।
বলা যায় বাংলা সাহিত্যের শিশু সাহিত্যেরও অন্যতম দিকপাল কবি নজরুল ইসলাম। শিশুদের নিয়ে তার রচনাগুলো এখনো শিশুদের শেখানো হয়। “লিচুচোর”,“খাঁদু-দাদু”,“প্রভাতী”,“খুকি ও কাঠবেড়ালি” কবিতা কিংবা “প্রজাপতি প্রজাপতি”-র মতো গান আজো শিশুদের শৈশবকে সুন্দরভাবে রাঙিয়ে তুলছে। আবার এই নজরুলই মানব শিশুর শৈশবকে জয় করে তারুণ্যে প্রবেশ করে তারুণ্যকে সমাজের সকল বাঁধা অনাচার অবিচার ভেঙে দিয়ে নতুন সমাজ গড়তে অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। নব যৌবন জোয়ারকে কবি বরণ করেছেন তার দৃপ্ত লেখনীর শানিত তরবারিতে-
“এই যৌবন-জল-তরঙ্গ রোধিবি কি দিয়া বালির বাঁধ ?
কে রোধিবি এই জোয়ারের টান গগনে যখন উঠেছে চাঁদ ?”
নজরুল নিম্নবর্ণ, দলিত ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সাহিত্যে দৃশ্যমান করেছেন, যা তখনকার সমাজে বিরল ছিল। তাঁর কবিতা “মানুষ”, “শূদ্র”, “চণ্ডালিনী”—এসবই ছিল একটি শ্রেণিমুক্ত, মানবিক সমাজের দাবি। আজো আমাদের দেশে শ্রমিকদের আন্দোলনে বারবার উঠে আসে ন্যায্য মজুরি, নিরাপদ কর্মপরিবেশ ও শ্রমিক মর্যাদার দাবি। নজরুলের কবিতা “দারিদ্র্য”, “জীবন বন্দনা” আজও সেই সুর বাজিয়ে যায়।
আধুনিক পথনাট্য, প্রতিবাদী সংগীত—সব জায়গাতেই নজরুল ফিরে এসেছেন এক নতুন রূপে। নজরুলের উক্তি ও কবিতার পঙ্ক্তি এখন সোশ্যাল মিডিয়ার ফেসবুক-ইনস্টাগ্রাম স্টোরিতে, ডিজিটাল ক্যাম্পেইনে, পোস্টারে জায়গা করে নিয়েছে এবং নিচ্ছে। “বিদ্রোহী” কবিতা আজো প্রতিবাদী সভার শুরুতে পাঠ করা হয়। জুলাই বিপ্লবেও কবি নজরুল হয়ে উঠেছিলেন প্রাসঙ্গিক। দেয়ালে দেয়ালে গ্রাফিতিতে নজরুলের নানা বাণী তখন ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে হয়ে উঠেছিলো বজ্র নিনাদ।
বর্তমানে নজরুলকে অনেকাংশে জাতীয় উৎসবে আবদ্ধ রাখা হয়েছে। তাঁর বিদ্রোহী ও সাম্যবাদী ভাবধারা প্রায়শই বিস্মৃত হয়। তাঁর ভাবনাকে শুধু তাঁর সাহিত্যকর্মেই মধ্যেই সীমাবদ্ধ না রেখে নীতিনির্ধারণেও প্রতিফলিত করা প্রয়োজন। শিক্ষার মাধ্যমে শিশু ও তরুণ সমাজের মধ্যে মানবিকতা, অসাম্প্রদায়িকতা ও সহমর্মিতা জাগরণে নজরুলের সাহিত্য চর্চা করা যেতে পারে। বিচারবহির্ভূত হত্যার বিরুদ্ধে আন্দোলন, সংখ্যালঘু নিরাপত্তা, নারীর অধিকার বা লিঙ্গ-ভিত্তিক সমতার পক্ষে যে সামাজিক সংগঠনগুলো কাজ করছে, তাদেরও সুযোগ রয়েছে নজরুলকে তাদের নৈতিক ভিত্তি হিসেবে পুনঃআবিষ্কার করা।
কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের শিখিয়েছেন, মানুষে মানুষে বিভাজন নয়—মানবতার মিলনই সমাজের প্রকৃত ভিত্তি। তাঁর লেখনি একদিকে সাহস, অন্যদিকে সহমর্মিতার পাঠ। যখন আমরা বলি, “মানুষের চেয়ে বড়ো কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান্!” তখন আমরা নজরুলের কাছ থেকেই সেই প্রেরণা নিই। আজকের বাংলাদেশ যখন বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশ হবার পথে আগাচ্ছে, তখন নজরুলের চেতনা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—বৈষম্যহীনতা, সাম্য, ধর্মীয় সহনশীলতা ও নারী-পুরুষ সমতা ছাড়া উন্নয়ন একক নয়। তাই নজরুলকে শুধু কবি হিসেবে নয়, সমাজ দর্শনের পথপ্রদর্শক হিসেবে গ্রহণ করাই হবে আমাদের ভবিষ্যৎ নির্মাণের অন্যতম ধাপ। বৈষম্য দূরীকরণে নজরুল শুধু অতীতের এক কণ্ঠ নয়, তিনি ভবিষ্যতেরও দিকপাল ; তার প্রাসঙ্গিকতা সকল সময়ের জন্যই। সাম্য, মানবতা ও ন্যায়বিচার—এই ত্রয়ী ভিত্তির উপরই গড়তে হবে নতুন বাংলাদেশ - আর এই ভিত্তির নামই নজরুল।
লেখকঃ নজরুল সংগীত শিল্পী, বিসিএস তথ্য ক্যাডারের সদস্য এবং সহকারী পরিচালক (অনুষ্ঠান) পদে বাংলাদেশ বেতারে কর্মরত
পিআইডি ফিচার