
ফাইল ছবি
দুর্গা পূজা নিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সাম্প্রদায়িক, উস্কানিমূলক ও অপমানজনক মন্তব্যর প্রতিবাদে দেশের ক্ষুদ্ধ নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে ২২ জন নাগরিক তা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন।
বুধবার (১০ সেপ্টেম্বর) এক বিবৃতিতে বলা হয়, “সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব:) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী আসন্ন শারদীয় দুর্গাপূজা নিয়ে অত্যন্ত সাম্প্রদায়িক, উস্কানিমূলক ও অপমানজনক মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, ‘এবার দুর্গাপূজা নিয়ে মদ-গাঁজার আসর বসানো যাবে না’। তার এই মন্তব্য এক সুপ্রাচীন, ঐতিহ্যগত, সর্বজনীন ধর্মীয় উৎসবের পবিত্ররূপ এবং ভাবগাম্ভীর্যকে নিষ্ঠুরভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করেছে। তার এই বক্তব্যের ভেতর দিয়ে শিশু, নতুন প্রজন্মসহ ভিন্ন ধর্মাবলম্বী সকলের কাছে দুর্গাপূজাসহ সনাতন হিন্দুদের বিষয়ে এক বৈষম্যমূলক অন্যায় বার্তা এবং সাম্প্রদায়িক ভুল তথ্য প্রচারিত হয়ছে। যেন পবিত্র এই ধর্মীয়-সামাজিক উৎসব মাদক এবং অসামাজিক কার্যকলাপের সাথে জড়িত। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার এই বক্তব্য শুধু সনাতন হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেনি, বরং বাংলাদেশের অসাধারণ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সামাজিক শক্তি ও ঐতিহ্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। আমরা তার সর্বৈব মিথ্যা, চক্রান্তমূলক, বৈষম্যমূলক, বর্ণবাদী এবং উস্কানিমূলক উগ্র সাম্প্রদায়িক বক্তব্যের তীব্র নিন্দা এবং প্রতিবাদ জানাই। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে অবশ্যই এ ধরণের বক্তব্যের জন্য সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বীসহ দেশের সকল ধর্মপ্রাণ এবং শান্তিপ্রিয় নাগরিকের কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত এবং দ্রুত তার বক্তব্য প্রত্যাহার করে নিয়ে আসন্ন দুর্গাপূজার সামগ্রিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি
সামাজিক অসঙ্গতি এবং সংকট দূর করতে অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে সকলের মঙ্গল কামনায় সর্বজনীন উৎসব হিসেবে আয়োজিত হয় শারদীয় দুর্গোৎসব। সনাতন হিন্দুদের ধর্মীয় পূজা হলেও দুর্গা পূজার উৎসবে সমাজের সকল ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি-পেশা-জেন্ডারের সকল মানুষের অভূতপূর্ব সম্মীলন ঘটে এবং এক অনন্য অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির উদাহরণ এই উৎসব। কোনোভাবেই এই পূজাকে ‘মদ-গাজা’ দিয়ে কলংকিত করে মিথ্যা বানোয়াট উস্কানিমূলক তথ্য ছড়িয়ে কোনো উগ্র সাম্প্রদায়িকতার বিশৃংখলা তৈরি করা যাবে না। তবে একইসাথে এটিও স্মরণ রাখা জরুরি দুর্গাপূজাসহ হিন্দু এবং দেশের জাতিগত এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুর পূজা, অনুষ্ঠান, উৎসব এবং ধর্মস্থলে নানাসময়ে হামলা, আক্রমণ, ভাংচুর, নিপীড়ন, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের মতো সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস ঘটেছে। মুক্তিযুদ্ধ থেকে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে দেশের হিন্দুসহ সকল জনগণের অবদান ও হিস্যা আছে। কোনোধরণের উস্কানি বা মবসন্ত্রাসকে জায়েজ করে ধর্মসহ হিন্দুদের সামগ্রিক জীবনের ওপর কোনো বৈষম্য, নিপীড়ন, বর্ণবাদ এবং অপমান দেশের সংবিধান, আইন এবং জনসংস্কৃতি বিরোধী।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পরেও দেশের ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু এবং ভিন্ন মতাবলম্বীদের বিশ্বাস, চর্চা, স্থাপনা, প্রার্থনাস্থল, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ওপর হামলা হয়েছে। এমনকি মদ ও গাঁজার প্রমাণহীন অজুহাত তুলে দেশজুড়ে বহু মাজার ও স্থাপনায় হামলা চালানো হয়েছে। কবর থেকে লাশ তুলে নুরাল পাগলার লাশ পর্যন্ত পোড়ানো হয়েছে। বিচারহীন এসব ঘটনায় উগ্রবাদী উস্কানিমূলক শক্তির প্রভাব স্পষ্ট। রাষ্ট্রের অত্যন্ত দায়িত্বশীল অবস্থানে থেকেও একজন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা এমন বর্ণবাদী উস্কানীমূলক বক্তব্য উগ্রবাদী শক্তিকে আরো বেশি মবসন্ত্রাসে উৎসাহিত করতে পারে। এই ধরণের দায়িত্বহীন আচরণ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার অপচেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়।
বিবৃতিতে পাঁচটি দাবি উত্থাপন করা হয়,
১. সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বীসহ দেশের সকল দর্মপ্রাণ এবং শান্তিপ্রিয় নাগরিকের কাছে অবিলম্বে বর্ণবাদী, উস্কানিমূলক এবং সাম্প্রদায়িক বক্তব্যের কারণে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে হবে।
২. রাষ্ট্রের কোনো দায়িত্বশীল পদে থেকে কোনো ব্যক্তি যেন ভবিষ্যতে কারোর ধর্মীয় বা সামাজিক উৎসব নিয়ে কোনো ধরণের অপমানজনক, বানোয়াট, উস্কানিমূলক এবং বর্ণবাদী বক্তব্য করতে না পারেন সে বিষয়ে রাষ্ট্রীয় সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
৩. আসন্ন দুর্গাপূজার সামগ্রিক নিরাপত্তা এবং এর সর্বজনীন অসাম্প্রদায়িক আয়োজনের ক্ষেত্রে সকল ধরণের রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।
৪. হিন্দুসহ দেশের সকল ধর্মীয় এবং জাতিগত সংখ্যালঘুর ধর্মীয় ও সামাগ্রিক জীবনের নিরাপত্তা এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় অবিলম্বে প্রশাসনকে অসাম্প্রদায়িক ন্যায্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
৫. জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মূল সুর সবাইকে নিয়ে বহুত্ববাদী ইনক্লুসিভ বাংলাদেশ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সকল রকমের উগ্রাবাদী, উস্কানিমূলক, বৈষম্যমূলক, বিভ্রান্তিকর বক্তব্য এবং আচরণকে বাতিল করে বাংলাদেশের জনগণের সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সম্প্রীতির সংস্কৃতিকে জাগ্রত করতে হবে।”
বিশিষ্ট নাগরিকরা হলেন - আনু মোহাম্মদ, অর্থনীতিবিদ, অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, সুলতানা কামাল, মানবাধিকার কর্মী ও প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন, ড. ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাহী পরিচালক, টিআই-বি, অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না, সিনিয়র অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ও চেয়ারপার্সন, আইন ও সালিস কেন্দ্র, শামসুল হুদা, নির্বাহী পরিচালক, এএলআরডি, পাভেল পার্থ, লেখক ও গবেষক, সুব্রত চৌধুরী, সিনিয়র আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট, এড. তবারক হোসেন, সিনিয়র আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট, ড. সুমাইয়া খায়ের, অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, তাসনীম সিরাজ মাহমুব, সহযোগী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ড. জোবাইদা নাসরীন, অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়,
রোবায়েত ফেরদৌস, অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ড. ফিরদৌস আজীম, অধ্যাপক, ইংরেজি ও মানবিক বিভাগ, ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়,
জাকির হোসেন, প্রধান নির্বাহী, নাগরিক উদ্যোগ,. রেজাউল করিম চৌধুরী, নির্বাহী পরিচালক, কোস্ট ট্রাস্ট, জবা তালুকদার, নৃবিজ্ঞান গবেষক, রোজীনা বেগম, গবেষক ও অধিকারকর্মী, মাইদুল ইসলাম, সহযোগী অধ্যাপক, সমাজতত্ত¡ বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, আমিরুল রসুল, মানবাধিকার কর্মী, সাঈদ আহমেদ, মানবাধিকার কর্মী, হানা শামস আহমেদ, গবেষক ও আদিবাসী অধিকার কর্মী, সৈকত শুভ্র আইচ, উন্নয়ন কর্মী প্রমুখ।
ইউ