
ফাইল ছবি
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কর্তৃক গঠিত নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন বাতিলের দাবিসহ নারী বিদ্বেষ ও উসকানি তৈরিতে হেফাজত ও অন্যান্য উগ্রবাদী গোষ্ঠী যে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে তার প্রতি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে ৫০ জন নাগরিক বিবৃতি দিয়েছেন। বিবৃতিতে ওইসব মহলের অপতৎপরতার নিন্দা ও তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়। ওইসব গোষ্ঠীর সহিংস বক্তব্য ও অন্য নাগরিকদের প্রতি ভীতি সঞ্চারের হুমকির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা ও জোরালো অবস্থান গ্রহণের জন্য সরকার ও নাগরিক সমাজকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানানো হয়।
মঙ্গলবার (৬ মে) ওই বিবৃতিতে তারা বলেছেন, ‘আমরা গভীর ক্ষোভ ও উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি যে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কর্তৃক গঠিত নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন বাতিলের দাবিতে গত কয়েকদিন ধরে হেফাজতে ইসলাম, জামাতে ইসলামীসহ কিছু ধর্মীয় নামধারী সংগঠনের প্রতিনিধিসহ প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী বক্তব্য-বিবৃতি প্রদান করে আসছে। তাদের কেউ কেউ উক্ত কমিশন বাতিল না করা হলে সরকার উৎখাত, দেশ অচল করে দেয়া এমনকি সারা দেশে আগুন জ্বালিয়ে দেবার মতো হুমকি প্রদান করেছেন। আমরা মনে করি তাদের এই দাবি শুধু আপত্তিকর ও অগ্রহণযোগ্যই নয়, একইসাথে তা জনমনে নারী-বিদ্বেষ উস্কে দেয়া এবং দেশব্যাপী অরাজকতা সৃষ্টির অপচেষ্টার গুরুতর অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রকাঠামো, সংবিধান এবং সর্বোপরি বৈষম্যবিরোধী চেতনার বিপরীতে অবস্থান নিয়ে তারা জুলাই ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের অবদান ও আত্মত্যাগকে অবমাননা করার উদ্ধত্য দেখিয়েছেন বললেও কম বলা হয়। অথচ এ ব্যাপারে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শক্ত অবস্থান নেয়ার প্রত্যাশা জনমনে থাকলেও এই ব্যাপারে তাদের কার্যত নিরবতায় আমরা ক্ষুব্ধ ও হতাশ। আমরা অনতিবিলম্বে সরকারের অবস্থান সুস্পষ্ট করার আহ্বান জানাই। দু’একটি ব্যতিক্রম ছাড়া রাজনৈতিক দল ও শক্তিসমূহের সুস্পষ্ট অবস্থানগ্রহণে ব্যর্থতাও দুরভিসন্ধিমূলক, হতাশাজনক ও নিন্দনীয়। কেননা, সাম্প্রদায়িক এবং নারী-বিদ্বেষী গোষ্ঠীর এহেন ধৃষ্টতাপূর্ণ বক্তব্য ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ কেবল নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন কিংবা সরকারের জন্য নয়, সমগ্র দেশের জনগণ ও তাদের অধিকারের ওপর আক্রমণ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।’
বিবৃতিতে আরো বলা হয়, ‘‘আমরা সুস্পষ্টভাবে বলতে চাই স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের অধিকার সকলের আছে। কিন্তু কমিশনের সংস্কার বিষয়ক সুপারিশের বিষয়ে অভিযোগের ক্ষেত্রে যথাযথ গঠনমূলক প্রক্রিয়া অবলম্বন না করে পুরো কমিশনকে বাতিল করার দাবির পেছনে গভীর দুরভিসন্ধি এবং রাজনৈতিক ও কায়েমী স্বার্থ জড়িত। আমরা আগেও লক্ষ করেছি যে দেশে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন, সাম্প্রদায়িক হামলা কিংবা আয়-বৈষম্যের মতো জাতীয় ইস্যু কিংবা নারী নির্যাতন, ঘুষ-দুর্নীতি, ভূমি জবরদখলের মতো গুরুতর অপরাধ ও সামাজিক অনাচারের বিরুদ্ধে ঐ গোষ্ঠী কোনো অবস্থান না নিয়ে নিশ্চুপ হয়ে থাকে অথচ নারীর অধিকারের প্রসঙ্গ এলেই তাদের প্রতিবাদ, বিক্ষোভ, হুমকি শুরু হয়ে যায়। আমাদের মনে রাখতে হবে এ কমিশন রাষ্ট্রীয় ম্যান্ডেট পাওয়া একটি কমিশন। কমিশনের সব সুপারিশের সাথে সবাই একমত হবেন সেটি না হতেই পারে। কিন্তু কমিশনের কিছু সুপারিশের ক্ষেত্রে আপত্তি বা দ্বিমত থাকলে পুরো কমিশনকে কেন বাতিল করতে হবে- আর কেনই বা প্রকাশ্যে নারীর বিরুদ্ধে বিষোদগার করা হবে, কমিশন সদস্যদের চরিত্র হনন করা হবে- এর জন্য তাদের এবং অন্তর্বর্তী সরকার উভয়কেই জবাবদিহি করতে হবে। যেসব সুপারিশ নিয়ে তাদের দ্বিমত আছে সে ব্যাপারে তাদের মতামত তারা জানাতেই পারেন, প্রয়োজনে সরকার বা কমিশনের কাছে সুপারিশ সংশোধন বা বাতিলের দাবি তারা জানাতে পারতেন, তাদের দাবির স্বপক্ষে যুক্তি থাকলে তুলে ধরতে পারতেন, এখনো পারেন। কিন্তু সেটি না করে কমিশন বাতিল, সরকার উৎখাত কিংবা দেশ অচল করে দেবার মতো হুমকি কোনো গ্রহণযোগ্য আচরণ নয়।’
‘এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, যে দু-তিনটি সুপারিশ বিষয়ে উস্কানি, বিদ্বেষ ও হুমকি ছড়ানো হচ্ছে, সেগুলোর ক্ষেত্রে নারীর মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সম্পত্তির অধিকার- যেটি তার অর্থনৈতিক সক্ষমতা ও ক্ষমতায়নের জন্য অপরিহার্য এবং রাজনৈতিক অধিকারের প্রসঙ্গটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী-গণঅভ্যুত্থানে যারা অংশ নিয়েছিলেন, শহীদ হয়েছেন কিংবা প্রতিবন্ধিতার শিকার হয়েছেন তারা একটি বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ দেখতে চেয়েছিলেন। দেশের অর্ধেক জনসংখ্যা নারীকে পিছিয়ে রেখে, তাদের প্রতি বৈষম্য বজায় রেখে বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়া অসম্ভব। আজ যারা নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন বাতিল চান তাদের আসল উদ্দেশ্য নারীকে তো বটেই দেশের অধিকাংশ মানুষকে অবদমিত রেখে, বৈষম্যকে জিইয়ে রেখে নিজেদের গোষ্ঠীগত ও কায়েমী স্বার্থ হাসিল করা। এই স্বার্থ বজায় রাখার জন্য তারা অতীতের মতোই মানুষের ধর্মীয় আবেগ-অনুভ‚তিকে ব্যবহার করার মতো হীন ও ন্যাক্কারজনক পথ যে বেছে নিয়েছেন সেটি তাদের এই অমূলক, অগ্রহণযোগ্য ও অগণতান্ত্রিক দাবি ও হুমকির দ্বারা আরো একবার পরিস্কার হলো। দেশ অচল করার হুমকি দিয়ে তারা কার এজেন্ডা বাস্তবায়নে নেমেছেন সেটি তদন্তের মাধ্যমে খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।’
‘কাজেই আমাদের আহ্বান বিষয়টিকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে এ বিষয়ে সরকার তার অবস্থান অনতিবিলম্বে পরিস্কার করবে এবং তদন্তের মাধ্যমে এই উস্কানিদাতা ও তাদের ইন্ধনদাতাদের দ্রæত সনাক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। আমরা একই সাথে জনগণকে যেকোনো ধরনের উস্কানি ও বিভ্রান্তি থেকে সতর্ক থাকা এবং নারীদের অধিকারসহ সবার সম-মর্যাদা ও অধিকার সুরক্ষায় ঐকবদ্ধ থাকার আহŸানের পাশাপাশি এই উগ্রবাদী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর যে কোনো অপচেষ্টার বিরুদ্ধে দেশের সকল সচেতন শক্তি, শিক্ষার্থী-জনতা, সরকার, পুলিশ, সেনাবাহিনীসহ সকল রাষ্ট্রীয় শক্তিকে একাত্ম হয়ে এদের অপরাধমূলক তৎপরতা রোধ করার আহবান জানাই।’’
এই বিবৃতিতে দিয়েছেন ১. আনু মুহাম্মদ, অর্থনীতিবিদ, সাবেক অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
২. খুশী কবির, মানবাধিকার কর্মী ও নিজেরা করি’র সমন্বয়কারী
৩. ড. ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাহী পরিচালক, টিআই-বি
৪. রাশেদা কে. চৌধুরী, নির্বাহী পরিচালক, গণস্বাক্ষরতা অভিযান ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা
৫. শাহীন আনাম, নির্বাহী পরিচালক, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন
৬. ব্যারিস্টার সারা হোসেন, অনারারি নির্বাহী পরিচালক, ব্লাস্ট
৭. শামসুল হুদা, নির্বাহী পরিচালক, এএলআরডি
৮. ড. সামিনা লুৎফা, অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
৯. অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না, সিনিয়র অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
১০. ড. শহিদুল আলম, আলোকচিত্রী ও লেখক
১১. তাসলিমা ইসলাম, প্রধান নির্বাহী (ভারপ্রাপ্ত), বেলা
১২. প্রফেসর ডা. নায়লা জামান খান, সাবেক প্রতিষ্ঠাতা প্রধান, পেডিয়াট্রিক নিউরোসায়েন্স, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড হেলথ, ঢাকা শিশু হাসপাতাল
১৩. সুব্রত চৌধুরী, সিনিয়র আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
১৪. রোবায়েত ফেরদৌস, অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
১৫. অ্যাডভোকেট সালমা আলী, নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ উইমেন্স লইয়ার্স এসোসিয়েশন (বিএনডব্লিউএলএ)
১৬. ড. শাহনাজ হুদা, অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
১৭. ড. সুমাইয়া খায়ের, অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
১৮. তাসনীম সিরাজ মাহমুব, সহযোগী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
১৯. ড. ফিরদৌস আজীম, অধ্যাপক, ইংরেজি ও মানবিক বিভাগ, ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়
২০. ড. পারভীন হাসান, ভাইস চ্যান্সেলর, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটি
২১. ড. জোবাইদা নাসরীন, অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
২২. রেজাউল করিম চৌধুরী, নির্বাহী পরিচালক, কোস্ট ট্রাস্ট
২৩. জাকির হোসেন, প্রধান নির্বাহী, নাগরিক উদ্যোগ
২৪. পাভেল পার্থ, পরিচালক, বারসিক
২৫. রেহনুমা আহমেদ, লেখক ও গবেষক
২৬. সায়দিয়া গুলরুখ, সাংবাদিক ও গবেষক
২৭. মনীন্দ্র কুমার নাথ, ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ
২৮. ড. রুশাদ ফরিদি, সহকারি অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
২৯. ড. সাদাব নূর, অধ্যাপক, ল্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটি
৩০. অ্যাডভোকেট সাইদুর রহমান, নির্বাহী পরিচালক, মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন
৩১. মিনহাজুল হক চৌধুরী, আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
৩২. ব্যারিস্টার সাদিয়া আরমান, আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট
৩৩. সাঈদ আহমেদ, মানবাধিকার কর্মী
৩৪. অরূপ রাহী, সাংস্কৃতিক কর্মী
৩৫. জান্নাতুল মাওয়া, আলোকচিত্রী ও শিক্ষক
৩৬. নাসরিন সিরাজ, নৃবিজ্ঞানী
৩৭. ফারজানা ওয়াহিদ সায়ান, সংগীত শিল্পী
৩৮. অধ্যাপক মাসুদ ইমরান মান্নু, শিক্ষক, প্রত্মতত্ত্ব বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
৩৯. আতিকা রোমা, অ্যাক্টিভিস্ট
৪০. অ্যাডভোকেট দিলরুবা শfরমিন, আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ও মানবাধিকার কর্মী
৪১. ড. ফারজানা আলম, শিক্ষক, প্রশিক্ষক ও প্রাণী অধিকারকর্মী
৪২. ফাতেমা শুভ্রা, শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
৪৩. লায়লা পারভীন, শিক্ষক ও সদস্য, নারী অধিকার জোট, নোয়াখালী
৪৪. হানা শামস, পিএইচডি গবেষক, ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা
৪৫. ফারহানা শারমীন ইমু, স্থপতি, মানবিক সহায়তা কর্মী
৪৬. ড. ইলোরা শেহাবুদ্দীন, ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া বার্কলি, যুক্তরাষ্ট্র
৪৭. ডা. সাদিয়া চৌধুরী, স্বাস্থ্যকর্মী, যুক্তরাষ্ট্র
৪৮. হানা শামস আহমেদ, গবেষক ও আদিবাসী অধিকার কর্মী
৪৯. মুক্তাশ্রী চাকমা, মানবাধিকার কর্মী ও গবেষক
ইউ