
কথাসাহিত্যিক নাসরীন জাহান:
প্রথমত মানুষ খাওয়ার মতো লেখা আমি লিখতে পারি না। ফলে এই লেখাটা আমার ভেতর কুৃঁড়ে খাওয়া অনুভব থেকে লিখছি, কিন্তু জানি, এই লেখাটাও তেমন খাওয়ার হবে না। দরকারও নেই। অনেকদিন যাবত বিষয়টা পুড়ে খাচ্ছিল, এখন না লিখে পারলাম না। অবশ্য এর আগেও গল্পে,কবিতায় এসব এসেছে।
কিন্তু আজকাল সাহিত্য দিয়ে কোনকিছুর জয়জয়কার সম্ভব না,এ আমি হাড়ে রক্তে অনুভব করছি। কারণ যাদের নাম নিয়ে খাওয়ার চর্চা চলছে, আমি নাম নেব না। শিল্প আমি খাওয়াতে পারি না। আমি ভাবনার দরজায় টোকা দিতে পারলেই ধন্য।
যা হোক,রুচির দুর্ভিক্ষ,এই বাক্য প্রথম বলেছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন । আমি তখন অনেক ছোট।
সে সময় থেকে আশির দশকের শুরু পর্যন্ত পরিচ্ছন্ন বাংলা ছবি দেখে মুগ্ধ হয়েছি।
রঙিন জগৎ এলো, ফালতু নাচ আর রাজকীয় অবাস্তব কাহিনি। রুচিহীন লাগত। সওদাগর ছবি এলো। মানুষ ভেঙে পড়ল হলে। নিতম্ব স্তণ ফোম দিয়ে ঢাউস করা নায়িকা অঞ্জুঘোষ, রোজিনা। শাবানার সাথে সাথে ববিতাও পিছপা ছিলো না।
আমি এদের ময়দায় ঢাকা রঙিন চেহারা দেখে নায়কের সাথে পুরো স্তন চেপ্টা ভয়াবহ ঘষ্টাঘষ্টি দেখে ছবির মাঝখানে বলতাম, ছিঃ, রুচিহীন ছবির জগৎ এসেছে। এরা এসব মাখামাখি না করে সিম্পল চুমু খায় না কেন? দেহের মাংশ মিশেয়ে দিতে সমস্যা নেই।
চুমুই অশ্লীল? হা হা!
সে থেকে চলে আসছে রূপের চাইতে বেশি মেকাপের চল, যা বিবর্তনের মাধ্যমে এখনো চলছে। তার মানে জয়নুল আবেদিন তাঁর জীবনে চারপাশে এমন রুচিশীল জীবনে অভ্যস্ত ছিলেন, বিবর্তনের রুচিহীনতার রূপ কেমন ছিলো জানি না। কিন্তু তা তিনি সহ্য করতে পারেন নি।
যেভাবে আমরা তখন পারি নি। ফেসবুকে আসার আগে সবকিছু অত সহজ ছিলো না। তুমি যা লিখবে,যা করবে যোগ্যতা অনুযোগ্যতার পরোয়াহীন তাই মানুষের সামনে নিয়ে এসে পরিচিত হবে, এমন মাধ্যম ছিলো না। টিভিতে আসতে
হলে শৈল্পিক যোগ্যতা থাকত,পরীক্ষা থাকত।
পত্রিকায় লেখা ছাপতে হলে তুখোড় সাহিত্য সম্পাদকের রুচির দরজা পেরোনোর যোগ্যতা থাকতে হত। আর ফালতু কথা, ফালতু লেখা, কেউ ,পাঠ করলে তার একফোঁটা এগুনোর জায়গা ছিলো না। এজন্যই শিক্ষিত, টেলিভিশনের মালিক যখন নিজের চ্যানেলে বাজে কন্ঠে গান গাইলেন,আমরা কেউ তাকে ছাড় দিইনি। এটা করা জরুরি ছিলো।
এখনো তিনি সবার হাসির পাত্র, অন্তত শিল্পের ব্যাপারে।
ফেসবুক আসায় যে যার ক্ষমতা অক্ষমতার নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল তাঁর ওপর। পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে প্রতিটি মুহূর্ত মানুষের সামনে তুলে ধরতে হবে।
প্রাইভেসি কাকে বলে এটা মানতেই নারাজ এরা। ফলে যারা রুচিসম্মত মানুষ, তারা ধনী হতে পারে, গরীব
হতে পারে,যখন আর না পেরে বলতে শুরু করলেন, ছিঃ, এর মধ্যে কী গুণ আছে,যা তারা প্রদর্শন করছে? ব্যাস, নোংরা ভাষায় সেই রুচিবান মানুষদের ওপর হামলা ধেয়ে আসতে শুরু করল।
তুই কে?তোর কী রুচি আছে? এমন ভাষা দিয়ে শুরু করে তারা ফালতু অযোগ্যদের পাশে দাঁড়িয়ে নিজেদের বিপন্নদের প্রতিনিধি মনে করা শুরু করল,আর যাইচ্ছে তাই বলা শুরু করল তাদের, যাঁরা এদের রুচি নিয়ে প্রশ্ন তোলে।
এটাকেই ট্রল হিসেবে ধরে নিয়ে তাঁদেরকে কুপোকাত করে করে থেকে শানিয়ে আসতে শুরু করল পাল্টা ট্রল।
এরমধ্যে যারা ইউটিউবে ভালো কিছু তৈরী করছেন, তারা তাঁদের সমান্তরালেও নিজেদের ভাবতে শুরু করেছে,
বরং তাদের চেয়েও আরও অনেক বড়।
এদের রুচিহীনতার অসভ্যতার সীমা এমন পর্যায়ে গেছে, গুণী, গুরুত্বপূর্ণ কেউ এদের নিয়ে লিখলে
এঁরা দলবেঁধে খিস্তি খেউড় দিয়ে তাঁকে পারলে ছিঁড়েখুড়ে নর্দমায় ফেলে।
ট্রল,এই শব্দ এই প্রজন্মের বিষাক্ত এক শব্দ।
মঞ্চনাটকের মানুষ আমিও। লিখতে গিয়ে জেনেছি, অভিনয় দেখে জেনেছি,পয়সাহীনভাবে কত জোরলো
কমিটমেন্টের সাথে কষ্ট করে অভিনেতারা প্রাণ দিয়ে অভিনয় করে, নির্দেশক একেবারে যেন পুরো নাটক
সাজানোর প্রাণ।
ওই মূর্খের দল,অভিশাপকারী দল,অসভ্য ভাষায় কথা বলার দল, এসবের একটা কাজও দেখার যোগ্যতা রাখে?
একটা ভালো বই পড়ে কিছু বলতে পারে? একটা ভালো সিনেমা দেখে? এর জন্য তো সবক্ষেত্রে শিক্ষা অশিক্ষা
লাগে না। প্রতিভা লাগে।
প্রতিভা আছে এদের?
এখন এমন যুগ এসেছে কোন মেয়ে পুরুষদের পছন্দের বাইরে নিপীড়ন হয়ে আশ্রয় চাইলে তাকে ট্রল
করে করে বেশ্যা বানিয়ে ফেলে, একই বিপন্নতায় পুরুষ বউ ফেলে আরও বিয়ে করতে চাইলে তাকে
সাবাস,বাহবা করে করে, ট্রল করে হিরো বানিয়ে ফেলে।
যে পুরুষ যত যোগ্যতাহীন, নিজের দারিদ্রের কাঁদুনি গায়, সেও ততো হিরো। এরা নায়ক, হিরো এর অর্থই জানে না।
আমরা যারা মন দেহের রক্ত খুইয়ে একটা মানসম্পন্ন লেখা ছাপি, ক,টাকা সম্মানী পাই? হাতে গোনা, ক, হাজার?
আর যোগ্যতাহীনরা নিজেদের পচিয়ে পাচ্ছে লাখ কোটি টাকা। এরপরও এদের শান্তি নেই, কেন?
তারমানে জয়নুল আবেদীন হয়তো সমুদ্র থেকে নদীতে পড়েছিলেন, আর আমরা নদী, বিল দিঘি ডোবা
পেরিয়ে নর্দমায় পড়েছি।
এখন সত্যিই রুচিহীনতার গন্ধ বাতাস চারপাশে থইথই করছে।