
ছবি: উইমেনআই২৪ ডটকম
মানব মানদণ্ডের দর্শন ও মনস্তত্ত্ব: শিক্ষকের ভূমিকা
মানুষের মনন ও মানদণ্ডের ভিত্তি স্থাপিত হয় এক গভীর দার্শনিক ও মনস্তাত্ত্বিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। দর্শন আমাদের শেখায়, জীবনের উদ্দেশ্য কী, সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য কোথায়, আর নৈতিকতার উৎসই বা কী। একজন শিক্ষক এই দার্শনিক অনুসন্ধানে সক্রেটিসের 'ধাত্রীবিদ্যা'র মতো কাজ করেন—তিনি সরাসরি জ্ঞান দেন না, বরং শিক্ষার্থীর ভেতরের সুপ্ত সম্ভাবনাকে প্রশ্ন ও আলোচনার মাধ্যমে বাইরে নিয়ে আসেন। শিক্ষকের ভূমিকা এখানে কেবল তথ্য সরবরাহ করা নয়, বরং শিক্ষার্থীর মধ্যে আত্ম-অনুসন্ধান (Self-exploration) ও সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা (Critical Thinking)-এর বীজ বপন করা। একটি মননশীল জাতি গঠনে এই দার্শনিক ভিত্তি অপরিহার্য।
অন্যদিকে, মনস্তত্ত্ব নির্দেশ করে কীভাবে একজন মানুষ শেখে, আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে এবং সামাজিক সম্পর্ক তৈরি করে। একজন আদর্শ শিক্ষক জানেন যে প্রতিটি শিক্ষার্থী ভিন্ন মনস্তত্ত্বের অধিকারী—কারও শেখার গতি বেশি, কেউ বা সৃজনশীলতায় এগিয়ে। তাই শিক্ষকের ক্লাসরুম পরিচালনায় সহানুভূতি (Empathy), ইতিবাচক সম্পর্ক স্থাপন (Positive Relationship) এবং নিরাপত্তাবোধের মতো মনস্তাত্ত্বিক আবহ বজায় রাখা আবশ্যক। যখন শিক্ষকের আচরণে শিক্ষার্থীর প্রতি সম্মান ও যত্ন প্রতিফলিত হয়, তখন তা শিক্ষার্থীর আত্মবিশ্বাস ও শেখার আগ্রহকে বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়, যা একটি মানবিক ও মানসম্পন্ন জাতি গঠনের মূল চালিকাশক্তি।
একজন আদর্শ শিক্ষকের মানদণ্ড: সেরা চিন্তা ও সৃজনশীলতার সমন্বয়
আজ ৫ অক্টোবর, বিশ্ব শিক্ষক দিবস। ইউনেস্কোর উদ্যোগে পালিত এই দিবসটির ২০২৫ সালের প্রতিপাদ্য হলো: 'শিক্ষকতাকে একটি সহযোগী পেশা হিসেবে পুনর্গঠন'। একজন শিক্ষকের মানদণ্ড আজ কেবল পাঠদানে দক্ষতার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং তা জ্ঞান, নৈতিকতা, সৃজনশীলতা ও সামাজিক দায়বদ্ধতার এক সমন্বিত রূপ।
১. মানবিক ও নৈতিক আইকন হিসেবে শিক্ষক
একজন আদর্শ শিক্ষককে অবশ্যই হতে হবে চরিত্র ও নৈতিকতার প্রতীক (Moral Icon)। তিনি হবেন সেই 'মোমবাতি' যা নিজে পুড়ে সমাজকে আলোকিত করে। তার আচরণ, কথা এবং জীবনধারা শিক্ষার্থীর জন্য বাস্তব জীবনাদর্শ তৈরি করবে।
-
মানদণ্ড: সততা, ন্যায়পরায়ণতা, দায়িত্বশীলতা ও সহানুভূতি—এই চারটি স্তম্ভের ওপর শিক্ষকের ব্যক্তিত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। ক্লাসের বাইরেও তার সামাজিক দায়িত্ববোধ হবে প্রশ্নাতীত।
-
করণীয়: শিক্ষকদের নিয়মিতভাবে নৈতিক ও মানসিক স্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন, যাতে তারা নিজেদের জীবনযাত্রার মান বজায় রেখে শিক্ষার্থীদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হতে পারেন।
২. জ্ঞান ও দক্ষতার ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন
আধুনিক শিক্ষক কেবল বইয়ের জ্ঞানের মধ্যে আটকে থাকতে পারেন না। প্রযুক্তির দ্রুত পরিবর্তনশীল যুগে তাকে হতে হবে একজন ক্রমাগত শিক্ষণশীল ব্যক্তি (Lifelong Learner)।
-
সৃজনশীলতা: শিক্ষককে কেবল জ্ঞান বিতরণ না করে, শিক্ষার্থীদের মধ্যে সৃজনশীলতা ও সমস্যা সমাধানের দক্ষতা তৈরি করতে হবে। পাঠদান পদ্ধতিতে খেলা, বিতর্ক, প্রজেক্ট এবং প্রযুক্তিকে অন্তর্ভুক্ত করে শিক্ষাকে করতে হবে আনন্দদায়ক।
-
মনস্তাত্ত্বিক দক্ষতা: তাকে জানতে হবে শিক্ষণ মনোবিজ্ঞান। কোন শিক্ষার্থী কেন পিছিয়ে পড়ছে, তাকে কীভাবে বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে—এই কৌশলগত জ্ঞান একজন আদর্শ শিক্ষকের আবশ্যকীয় মানদণ্ড।
-
করণীয়: শিক্ষকদের জন্য বিশ্বমানের প্রশিক্ষণ এবং আন্তর্জাতিক শিক্ষণ পদ্ধতির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ তৈরি করতে হবে।
৩. সহযোগী ও সম্মিলিত পেশার দীপ্তি
২০২৫ সালের প্রতিপাদ্য অনুযায়ী, শিক্ষকতা আজ একক প্রচেষ্টার পেশা নয়। শিক্ষকদের নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ, অভিজ্ঞতা বিনিময় এবং সম্মিলিত উদ্যোগ অপরিহার্য।
-
পেশাগত সহযোগিতা: একজন শিক্ষক তার সহকর্মীদের সাথে অভিজ্ঞতা ও রিসোর্স ভাগ করে নেবেন। এটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একটি শক্তিশালী পেশাদার সংস্কৃতি তৈরি করবে, যেখানে প্রত্যেকে একে অপরের সহায়ক।
-
নীতি ও কাঠামো: সরকারকে শিক্ষকদের জন্য একটি সহযোগিতামূলক প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তৈরি করতে হবে, যেখানে শিক্ষক-নেতৃত্ব (Teacher Leadership) এবং পারস্পরিক পরামর্শকে উৎসাহিত করা হবে।
শিক্ষকতা: আগামীর তারুণ্যের কাছে এক অনুপ্রেরণার পেশা
শিক্ষকতাকে যদি তরুণ প্রজন্মের কাছে পছন্দের আইকন পেশা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হয়, তবে এই পেশার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে।
-
মর্যাদা ও সম্মান: তরুণরা যখন দেখবে যে সমাজে শিক্ষককে উচ্চ আর্থিক নিরাপত্তা ও সামাজিক মর্যাদা দেওয়া হচ্ছে, তখন তারা এই পেশা গ্রহণে উৎসাহিত হবে। উন্নত বেতনের পাশাপাশি শিক্ষকদের জন্য আবাসন, স্বাস্থ্যসেবা ও উচ্চশিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।
-
স্বাধীনতা ও সৃজনশীলতা: একজন তরুণ শিক্ষক যখন জানবেন যে তিনি তার সৃজনশীল ধারণাগুলিকে ক্লাসরুমে স্বাধীনভাবে প্রয়োগ করতে পারবেন এবং কেবল মুখস্থবিদ্যার চাপে জর্জরিত হবেন না, তখন তিনি এই পেশাকে চ্যালেঞ্জিং ও আকর্ষণীয় মনে করবেন।
-
জাতীয় বিনির্মাণে অংশীদারিত্ব: তরুণদের বোঝাতে হবে, তারা কেবল পাঠদান করছে না, বরং জাতীয় বিনির্মাণ ও মানবসম্পদ উন্নয়নে সরাসরি নেতৃত্ব দিচ্ছে। শিক্ষকতা হলো ভবিষ্যতের জন্য কর্মী তৈরির একটি সৃজনশীল কর্ম, যা অন্য কোনো পেশায় সম্ভব নয়।
বিশ্ব শিক্ষক দিবসের এই দিনে, আমাদের সম্মিলিত অঙ্গীকার হোক—একজন আদর্শ শিক্ষককে তার প্রাপ্য সম্মান দেওয়া এবং শিক্ষকতা পেশাকে দার্শনিক, মনস্তাত্ত্বিক ও পেশাগত দিক থেকে সর্বোচ্চ মানদণ্ডে উন্নীত করা, যাতে আগামীর তরুণরা এই পেশাকেই তাদের প্রথম পছন্দ হিসেবে বেছে নিতে পারে।
ইউ