
ছবি: উইমেনআই২৪ ডটকম
কাপড়, পাথর, আঠা দিয়ে চুড়িতে নকশা করছিলেন ফাবলিহা নামে এক বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন এক তরুণী। এক ভাই এক বোনের মধ্যে সবার বড়।
ফাবলিহা জানালো একদিনে ও তিনটে পুঁতির মালা তৈরি করতে পারে।
একই টেবিলে পুঁতির মালা তৈরি করছিল কাজী তাসফিয়া তাসলিম নামে আরেক তরুণী। সাথে গানও গাচ্ছিল।
ওর মা কাজী দোয়েল মুহিতের মতে, ও গান গাইতে ভালোবাসে। আমি মনে করি, বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু বা ব্যক্তি প্রতিবন্ধী মানেই প্রতিভাবন্ধী নয়। আমার সন্তানের পরিচয়ে আমরা পরিচিত হবো। এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
কানিজ ফাতেমা ঐশী নবম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী। চুড়িতে কাপড় পেঁচিয়ে পাথর, লেইস লাগিয়ে নকশা করছিল। শুধু তাই নয়, চুড়িতে ও সুই সুতোর ফোঁড়ে ফোঁড়ে নকশাও তোলে।
এই বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন তরুণ তরুণীদের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে সাত দিনব্যাপী জুয়েলারি তৈরি প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হয়েছে তেজগাঁও মিডিয়া পাটনার আরটিভির বেঙ্গল স্কয়ারে। চলবে সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৪টা পযন্ত।
আজ সোমবার এসএমই ফাউন্ডেশন ও ইন্সপিরেশন ওয়েলফেয়ার সোসাইটি আয়োজিত বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন তরুণ-তরুণীদের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে জুয়েলারি তৈরি প্রশিক্ষণ কর্মসূচির উদ্বোধন করেন এসএমই ফাউন্ডেশনের মহাব্যবস্থাপক মো: আব্দুস সালাম সরদার, অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি এসএমই ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনোয়ার হোসেন চৌধুরী, ইন্সপিরেশন ওয়েলফেয়ার সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক সৈয়দা মুনিরা ইসলাম, সম্মানিত অতিথি বিশিষ্ট ব্যবসায়ী শাহেদুল ইসলাম হেলাল, কণ্ঠশিল্পী কানিজ সুবর্ণা, অভিনয়শিল্পী মুকিত জাকারিয়া, গণমাধ্যম কর্মী আব্দুন নূর তুষার, আরটিভির বার্তা প্রধান ইলিয়াস হোসেন প্রমুখ।
স্বাগত বক্তব্যে মো: আব্দুস সালাম সরদার বলেন, প্রশিক্ষণ কর্মসূচির মূল উদ্দেশ্য হলো এসব বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন তরুণ তরুণীকে এমন দক্ষতা প্রদান করা, যাতে তারা ভবিষ্যতে নিজেদের কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারে। পরিবারের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারে।
উদ্বোধনী বক্তব্যে সৈয়দা মুনিরা ইসলাম বলেন, খাদ্য, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা এবং চিকিৎসার মতো মৌলিক চাহিদা থেকে বঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়াতে এবং তাদের অধিকার নিশ্চিত করতে ২০১৫ সালে এই প্রতিষ্ঠান যাত্রা শুরু করে।
বিশেষ করে প্রতিবন্ধী ও বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু-কিশোরদের দারিদ্র্য দূরীকরণ, শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমে স্বাবলম্বী করে তোলাই আমাদের প্রধান লক্ষ্য।
আনোয়ার হোসেন চৌধুরী মতে, আমরা বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন তরুণ তরুণীদের তৈরি পণ্যের বাজার গড়ে তুলতে সহায়তা করছি। এসডিজির লক্ষ্য মাত্রা অনুযায়ী কাউকে পিছনে রেখে এগিয়ে যাওয়া যাবে না।
তিনি বলেন, সমাজের পিছিয়ে পড়া প্রান্তিক পযায়ে এই শিশুদের অবস্থান। এখান থেকে তাদের তুলে এনে তাদের ভেতরের উদোগ গুলোকে তুলে ধরা। এরি অংশ হিসেবে তাদের এবং অভিভাবকদের জুয়েলারি প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।
ইলিয়াস হোসেন বলেন, আমাদের সন্তান বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন বা বিশেষ গুণ সম্পন্ন। তাদের চেয়েও সমস্যা আমাদের রাষ্ট্র, দেশ। এই দেশ যারা পরিচালনা করে বা রাষ্ট্র কাঠামো বারবার আঘাত পেয়ে প্রতিবন্ধিতার চরম পযায়ে রয়েছে।
তিনি আরো বলেন, দেশ জাতিকে সামনে এগিয়ে নেয়ার জন্য অনেক মানুষ রক্ত দিয়েছেন, অনেক ধরনের শপথ নিয়েছেন। আবার হোচঁট খেয়ে পড়েছে। বারবার আঘাত প্রাপ্ত হয়েছে। দেশটাই প্রতিবন্ধকতার অবস্থায় রয়েছে। রা্ষ্ট্র পরিচালনা যারা করেন, তারা যদি সঠিক পদ্ধতিতে দেশ পরিচালনা করতো, তাহলে আমাদের বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুরা নিজেদেরকে আরো প্রতিষ্ঠিত করতে পারতো। আমাদের সাথে সুস্থ পরিবেশে বাঁচতে পারতো।
আব্দুন নূর তুষার বলেন, বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুর আচরণ কোনো অসুখ নয়, এটা স্বাভাবিকতা। কারণ তাদের আচরণে পরিবর্তন হয় না। কিন্তু অনেক মানুষের আচরণে পরিবর্তন হয়। আমাদের এই শিশুরা বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু নয়, তারা বিশেষ গুণ সম্পন্ন শিশু। মুশকিল একটাই আমরা সবসময় তাদের চাহিদার কথা বলি এই চাহিদার কথা তো আমাদের শিশুরা জানায়নি। তাদের এটা লাগবে কি লাগবে না। আমাদের সমাজ একটা চাহিদা তৈরি করেছে। আমরা মনে করি আট দশটা শিশুর মতো তাদেরকেও হতে হবে। সেটা হয়নি বলেই আমরা তাকে প্রতিনিয়ত সেটা হওয়ার চেষ্টা করি।
তিনি বলেন, বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের আলাদা আলাদা গুণ রয়েছে। এরা বিশেষ গুণ সম্পন্ন শিশু। এরা আমাদের সাথে সাধারণ মানুষের মতো আচরণ করে না বলেই আমরা মনে করি এরা স্বাভাবিক নয়। কোনটা স্বাভাবিক, কোনটা স্বাভাবিক নয় এটা গণতান্ত্রিক ভাবে নিধারিত হয়।
কানিজ সুবর্ণা নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের সব মায়েদেরই চলার পথ ভিন্ন। আমরা প্রতিদিন নানারকম চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছি। আমার দুই ছেলে বাক প্রতিবন্ধী। আমার যতটুকু ক্ষমতা রয়েছে তা দিয়ে ওদের আগলে রাখার চেষ্টা করছি।
তিনি আরো বলেন, প্রতিভার প্রতিবন্ধকতা থাকবেই। এরি মধ্য দিয়েই প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে চাচ্ছি।
মানসিক স্বাস্থ্য বিভাগ খোলার প্রতি জোর দেন মুকিত জাকারিয়া। তিনি বলেন, বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের গড়ে তুলতে বাবা- মাকে অনেক বাধা অতিক্রম করতে হয়। তাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য সেবা দরকার।
ইন্সপিরেশন ওয়েলফেয়ার সোসাইটির গঠনতন্ত্রের ধারা-৫ এর উপধারা ৫ অনুযায়ী, শিশু, কিশোর, নারী ও বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন মানুষদের মানব সম্পদ ও দক্ষতা উন্নয়নে বহুমুখী কর্মসূচি গ্রহণের অংশ হিসেবে এই উদ্যোগ নিয়েছে। এ ব্যাপারে ইন্সপিরেশন ওয়েলফেয়ার সোসাইটির প্রোগ্রাম হেড মোহাঃ নূর উল আমিন বলেন, আমরা লক্ষ্য করেছি, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও তাদের মায়েরা সমাজে প্রায়শই কর্মসংস্থান ও আয়ের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন। এই প্রশিক্ষণ শুধু জুয়েলারি তৈরির কৌশল শেখানো নয় বরং তাদের হাতে একটি দীর্ঘমেয়াদি জীবিকা গড়ার উপায় তুলে দেওয়া । এতে তারা টেকসই আয়ের সুযোগ তৈরি করার পাশাপাশি আত্মসম্মান ও আত্মবিশ্বাস অর্জন করবেন এবং মূলধারার অর্থনীতিতে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হতে পারবেন। ইনক্লুসিভ কর্মসংস্থানের একটি উদাহরণ তৈরি করবে।
অংশগ্রহণকারী বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন তরুণ-তরুণী ও তাঁদের অভিভাবকদের জুয়েলারি প্রশিক্ষণ দেন এসএমই ফাউন্ডেশনের প্রশিক্ষক তৌহিদা আক্তার সংগীতা।
ইউ