ঢাকা, বাংলাদেশ

শুক্রবার, , ০৯ মে ২০২৫

English

মতামত

স্ত্রীর স্বপ্নপূরণে পাকিস্তান আমলেই এফডিসি প্রতিষ্ঠা করেন শেখ মুজিব

সোহেল সানি:

প্রকাশিত: ১১:০৪, ১৪ আগস্ট ২০২৩; আপডেট: ১১:০৫, ১৪ আগস্ট ২০২৩

স্ত্রীর স্বপ্নপূরণে পাকিস্তান আমলেই এফডিসি প্রতিষ্ঠা করেন শেখ মুজিব

সাংবাদিক সোহেল সানি। ছবি-উইমেনআই

১৯৫৫-৫৬ খ্রীস্টাব্দ। স্বাধীনতার পরপরই পশ্চিম পাকিস্তানে উর্দু সিনেমার জন্য 'পাকিস্তান চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা' গড়ে উঠলেও রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা বাংলা হলেও তাদের উপর উর্দু সিনেমাই চাপিয়ে দেয়া হচ্ছিল। পাকিস্তান চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থার 'বাংলা সিনেমা' নির্মাণ তো দুঃস্বপ্নের মতো, আর পূর্বপাকিস্তানেও কেউ বাংলা সিনেমা নির্মাণ করবে এমন দুঃসাহস কার?

পূর্বপাকিস্তানে সিনেমা বা চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা প্রতিষ্ঠার তাগিদ কোন নাট্যামোদী বা অভিনয় শিল্পীর ছিলো না। এটি প্রথম অনুভব করেন শেখ মুজিবুর রহমানের স্ত্রী শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। যখন সমগ্র পাকিস্তান অর্থাৎ কেন্দ্রীয় সরকারের পাশাপাশি পূর্বপাকিস্তান প্রাদেশিক সরকারেও আওয়ামী লীগ। মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বাধীন প্রাদেশিক সরকারের শিল্প ও বানিজ্য মন্ত্রী শেখ মুজিব । ভারতের পশ্চিম বাংলায় বাংলা সিনেমায় উত্তম-সূচিতা জুটি তুমুল জনপ্রিয়। পূর্বপাকিস্তানে তখন বাংলা সিনেমা আমদানি করা হতো পশ্চিমবঙ্গ থেকে। দ্বিজাতিতত্ত্বের সাম্প্রদায়িক ভাগবাটোয়ারায় ভারত ভেঙ্গে পাকিস্তানের জন্মের স্বার্থে তৎকালীন সর্ববৃহৎ প্রদেশ বাংলা দুটো হলে বাংলা ভাষাভাষী পূর্বপাকিস্তানকে সংখ্যালঘু উর্দুভাষী কেন্দ্রীয় সরকার উর্দু সিনেমা চাপিয়ে দেয়। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা একমাত্র উর্দু করার বিরুদ্ধে ১৯৪৮ সালেই  বাংলা ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত এবং ১৯৫২ সালের তীব্র আন্দোলন শুরু হয়। স্বভাবতই  সালাম-বরকত-জব্বার-শফিক- রফিককে গুলি করে হত্যার পর উর্দু ছবি বর্জন করে এখানকার বাঙালিরা। পশ্চিম বাংলার বাংলা সিনেমাকেই বিনোদনের অন্যতম অবলম্বন হিসেবে বেছে নেয়া হয়।

কেন্দ্রে ও প্রদেশে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা গ্রহণ করার পর একদিন উত্তম সূচিত্রার সিনেমার গল্পসল্প করতে গিয়ে বেগম মুজিব স্বামী শেখ মুজিবকে বলেন, "আমাদের প্রেক্ষাগৃহে হিন্দি-উর্দু সিনেমার পাশাপাশি পশ্চিম বাংলার বাংলা সিনেমাগুলোও প্রদর্শিত হচ্ছে। বাংলা  সিনেমা দারুণ জনপ্রিয় কিন্তু এর মাধ্যমে ভারতীয়রা আমাদের বিনোদন দিয়ে আমাদেরই পকেটের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। অথচ,  আমাদের দেশেও অনেক প্রতিভাবান নাট্য শিল্পী আছেন। যাদের দিয়ে সিনেমা নির্মাণ করলে দর্শকশ্রোতারা হুমড়ি খেয়ে পড়তো, সরকারও আর্থিকভাবে লাভবান হতো। ধীরে ধীরে উর্দুর পাশাপাশি বাংলা সিনেমাও একটা শিল্প হিসেবে গড়ে উঠতে পারতো। তুমি যখন এ প্রদেশের শিল্প ও বানিজ্য মন্ত্রী এবং তোমার নেতা সোহরাওয়ার্দী সাহেবই যখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, তখন এ দেশেও একটা সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি করে ফেলো - তোমার কাছে এটা আমার দাবি, আমার বিশ্বাস  সোহরাওয়ার্দী সাহেব তোমার কথা ফেলবেন না।"

স্ত্রীর দাবির প্রতিত্তোরে শেখ মুজিব প্রথমে বলেছিলেন, "সিনেমা করার জন্য যে অবকাশ দরকার তা কোথায় এখানে? তবে বঞ্চনা তো সর্বক্ষেত্রেই। পার্টিশনের আগে পশ্চিম পাকিস্তানী চলচ্চিত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ছিলো বোম্বেতে। কিন্তু গত ৯ বছরে পাকিস্তান সরকার পশ্চিম পাকিস্তানে গড়ে তুলেছেন, চলচ্চিত্র শিল্প সংস্থা।" 
যাহোক স্ত্রীর স্বপ্ন বলে কথা। 

শিল্প-বাণিজ্য ও দুর্নীতি দমন মন্ত্রী শেখ মুজিব তাঁর লিডারের (কেন্দ্রীয় প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী) কাছে  সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি প্রতিষ্ঠা নিয়ে আলাপআলোচনা করলেন। করাচী থেকে ফিরে সরকারি অর্থানুকূল্যে পূর্বপাকিস্তানে একটি চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খানের সঙ্গে পরামর্শ করেন। 

যদিও ওই উদ্যাগের কথা প্রচারিত হওয়ার পর ইসলাম নামধারী দল ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী সভা-সমাবেশ ও ওয়াজ মাহফিল করে চরম বিরোধিতায় নেমে পড়েছিলেন। তারা আওয়ামী লীগ সরকারকে ইসলামের শত্রুরূপে ঘোষণা করে ধর্মভীরু মুসলমানদের উস্কানী দিচ্ছিলেন। গ্রামেগঞ্জের তুমুল জনপ্রিয় যাত্রাপালার মতো সিনেমাও কুরআন সুন্নাহ পরিপন্থী বলে মাঠ-ময়দান সরগরম করেন।

 প্রসঙ্গত পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল আইউব খান, সাহিত্যে গীতাঞ্জলির জন্য নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়ে যে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ পৃথিবীবাসীর সঙ্গে বাংলা ভাষার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন, সেই তাঁর "রবীন্দ্র সঙ্গীত" রাষ্ট্রীয়ভাবে নিষিদ্ধ করার পর এই সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী ও দলের মওলানা মুসুল্লিরা স্বাগত জানিয়েছিল, এবং এই তারাই ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের গণহত্যাকে সমর্থন করে সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়ার পক্ষ অবলম্বন করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে পাক-হানাদার বাহিনীকে ত্রিশলাখ বাঙালি হিন্দু-মুসলমানকে হত্যার পথ প্রশস্ত করে দিয়েছিলো। শুধু তাই নয় দুলাখ ৬৯ হাজার নারীর সম্ভ্রম কেড়ে নিতে ন্যাক্কারজনক ভুমিকা রেখেছিলো।    

স্বাধীন পাকিস্তান অভ্যুদয়ের পরপরই  পাকিস্তানের সংখ্যালঘু উর্দুভাষী শাসকরা বাঙালিদের দেশের নামটিও পাল্টে দেয়। রাতারাতি 'পূর্ববাংলা' বা 'পূর্ববঙ্গ' প্রদেশের নামটাই গর্ভনর জেনারেল কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ'র এক প্রজ্ঞাপণে 'পূর্বপাকিস্তান' হয়ে যায়। পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় ভাষা একমাত্র উর্দুকে চাপিয়ে দেয়া হয়। অথচ, ১৯৪৭ সালে যে ভারতবর্ষের বিভক্তির মাধ্যমে পাকিস্তানের জন্ম, সেই ভারতবর্ষেও সর্ববৃহৎ প্রদেশ  বেঙ্গলে ইংরেজ আমলে ১৮৩৫ সালে সরকারি ভাষা বাংলাকরণের দাবিতে বাঙালি উদয় চাঁদের নেতৃত্বে তীব্র আন্দোলন হয়েছে। যা বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে ঠাঁই না পেলেও ঠিকই ভারতের "মুক্তির সংগ্রামে ভারত" শীর্ষক ভারতের রাষ্ট্রীয় সংকলনে উল্লেখ রয়েছে। 

শুধু তাই নয়, ১৮৫৮ খ্রীস্টাব্দে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে নতুন এক আইন পাস করে ৫ নভেম্বর থেকে ইংল্যান্ডের রানী ভিক্টোরিয়ার হাতে ভারত সাম্রাজ্যের শাসনক্ষমতা তুলে দেয়া হয় - ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে বিদায় করে। ১৮৫৭ খ্রীস্টাব্দের সিপাহী বিদ্রোহের পরিপ্রেক্ষিতেই বৃটেনের মহারানী ভিক্টোরিয়ার কাছে  ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানিকে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হয়। ক্ষমতা হস্তান্তরের দলিলটি লিখিত হয় ইংরেজি ও বাংলা ভাষায়। সেখানে হিন্দি, উর্দু বা ভারতের কতশত ভাষা, কিন্তু কোনটিই স্থান পায়নি। ক্ষমতা হস্তান্তর অনুষ্ঠানটিও ভারতের অন্যকোন প্রদেশে নয়, বাংলার ঢাকার আন্টাঘর ময়দানে অনুষ্ঠিত হয়। যার নামকরণ করা হয় 'ভিক্টোরিয়া পার্ক'। বর্তমানে যা 'বাহাদুর শাহ পার্ক বলে পরিচিত। 

চতুর্দশ-পঞ্চদশ শতকে মুসলিম সুলতানরাও বাঙালির বাংলা ভাষা ও  সংস্কৃতিকে পৃষ্ঠপোষকতা দান করেন। 'বঙ্গ' বা 'বাঙ্গাল' শব্দটিকে 'বাংলা' -য় রূপান্তর করেন বাংলার শাসক শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ। তিনি এজন্য 'শাহে বাঙালিয়ান' খেতাবও পেয়েছিলেন। মোঘল আমলে ভারত সম্রাট আকবর বাংলা ভাষাকে আরো মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেন বাংলা সন মানে বঙ্গাব্দের প্রবর্তন করে। 

১৯৫২ সালের মাতৃভাষা বাংলা আন্দোলনের তাৎপর্য ও বাঙালি জাতিসত্তার অমোঘতা বোঝাতে ভাষা পন্ডিত ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন, "আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি। এটি কোন আদর্শের কথা নয়, এটি একটি বাস্তব কথা। মা প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারা ও ভাষায় বাঙালিত্বের এমন ছাপ মেরে দিয়েছেন যে, মালা-তিলক-টিকিতে কিংবা লুঙ্গি-টুপি-দাড়িতে ঢাকবার জো-টি নেই।"

প্রাদেশিক সরকারের মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক  শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫৫ খ্রীস্টাব্দের ৫ জুন পাকিস্তান  গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ২৫ আগস্ট করাচীতে অনুষ্ঠিত গণপরিষদের অধিবেশনেই তিনি বলেন, "Sir, you will see that they want to place the word 'East Pakistan' instead of 'East Bengal'. We have demanded so many times that you should use Bengal instead of Pakistan, The word 'Bengal' has a history, has a tradition of its own, You can change it only after the people have been consulted. If you want to change it then we have to go  back to Bengal and ask them whether they accept it. So far as the question of one - Unit is concerned it can come in the constitution. Why do you want it  to be taken up just now? What about the state language, Bengali?  What about joint electorate?  What about autonomy?  The people of East bengal will be prepared to consider One - Unit with all these things,  So, I appeal to my frirnds on that side to allow the people to give their verdict in any way, in the form of referendum or in the form of plebicite" সোহরাওয়ার্দীর কল্পিত 'পাকিস্তান জাতীয়তাবাদ' প্রতিষ্ঠার তাত্ত্বিক রাষ্ট্রদর্শনের প্রতিকূল হওয়ায় গণপরিষদে মুজিবের সেই প্রস্তাব  নাকচ হয়ে যায়। 

উল্লেখ্য, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলা গণপরিষদের অন্যতম ভাষা করার দাবি তুলে ভাষাসংগ্রামের সূত্র হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। সেই ভাষা আন্দোলন করতে গিয়ে শেখ মুজিব কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন। ১৯৫২ খ্রীস্টাব্দের সালাম-রফিক-বরকত-শফিক- জব্বারের প্রাণের বিনিময়ে যে একুশে ফেব্রুয়ারির ইতিহাস রচিত হয়েছে, তার নেপথ্যেও কারারুদ্ধ শেখ মুজিবের ঐতিহাসিক ভুমিকা রয়েছে।   কারাগার থেকে প্রেরিত তাঁর চিরকুটের কারণেই ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করায় ওই ইতিহাস রচিত হয়। তিনিই ১৯৫৫ খ্রীস্টাব্দের ১৭ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের অধিবেশনে পরিষদের দৈনন্দিন কার্যপ্রণালি বিধি ও কার্যসূচি ইংরেজি ও উর্দুর মতো বাংলা ভাষায়ও মুদ্রণের দাবি জানান। তিনি ৭ ফেব্রুয়ারি অধিবেশনে ভাষা সম্পর্কিত প্রশ্নে আলোচনায় অংশ নিয়ে বলেন,'শাসনতন্ত্রে রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে যেসব শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, তা অসৎ মতলবে করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় ভাষার প্রশ্নে কোনো ধোঁকাবাজি করা যাবে না। পূর্ববঙ্গে আমরা সরকারি ভাষা বলতে রাষ্ট্রীয় ভাষা বুঝিনা। নতুন করে গণপরিষদ গঠনের পর আওয়ামী লীগের ১২ জন সদস্য শাসনতন্ত্রে উর্দু ও ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাকেও রাষ্ট্রভাষা করার জন্য চাপ সৃষ্টি করেন এবং পরিষদ তা মেনে নিতে বাধ্য হন।২২ ফেব্রুয়ারি খসড়া শাসনতন্ত্রের ওপর আলোচনা করতে গিয়ে রাষ্ট্রভাষা ও সরকারি দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে উর্দুর পাশাপাশি বাংলা ভাষাকেও ব্যবহারের প্রস্তাব করেন এবং গণপরিষদে দেয়া বক্তৃতায় বলেন, "" When the Orders of the Day has been issued is two languages, i e. In English and Urdu, then why not in Bengali? So far, Orders of the Day were issued in English only, but when it has been issued now in English and Urdu, what is the intention of excluding Bengali? We want to know who has done it, is it under your orders, or some official has done it? I do not say that is has been done intentionally ; You are Deputy Speaker and your interpretation is final, but I would like to say that our interpretation is that forms official records and when the Orders of Day were issued in English and Urdu it should also have been issued in Bengali." ১৯৬৯ খ্রীস্টাব্দের ২৩ ফেব্রুয়ারি ছাত্রজনতা কর্তৃক 'বঙ্গবন্ধু' হয়ে ওঠা এবং ১৯৭০ খ্রীস্টাব্দের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের মাধ্যমে গণপরিষদ নেতা হয়ে ওঠা শেখ মুজিবুর রহমান ৫ ডিসেম্বর নেতা সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকীর আলোচনায় দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেন, "পূর্বপাকিস্তান আজ থেকে 'পূর্ববাংলা' বা 'পূর্ববঙ্গ' নামেও  নয়, 'বাংলাদেশ' নামেই পরিচিত হবে।" সত্যিই বুঝি বঙ্গবন্ধু হৃদয় দিয়ে আত্মস্থ করেছিলেন, ফ্রেডারিক এঙ্গেলস ও নোবেল বিজয়ী রাসেলের উক্তি। এঙ্গেলসের মতে, 'কোন সুস্থ সাংস্কৃতিক পদক্ষেপই স্বাধীনতাকে সংহত করে'। আর  ব্রান্ডার্ড রাসেলের মতে, 'সাংস্কৃতিক মুক্তি ছাড়া একটি দেশের স্বাধীনতা কখনো সুসংহত হয়না'। এজন্যই বুঝি বঙ্গবন্ধুর ছিলো, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের প্রতি  অগাধ শ্রদ্ধা-ভক্তি। ১৯৬১ খ্রীস্টাব্দে রবীন্দ্র সঙ্গীত নিষিদ্ধ হলে তিনি বিচলিত হয়ে পড়েন। জগন্নাথ কলেজের অধ্যক্ষ সাইদুর রহমান ও বাংলার অধ্যাপক অজিত কুমার গুহকে দিয়ে অন্তত দশ হাজার লোকের উপস্থিতিতি নিশ্চিত করে কলেজ প্রাঙ্গণে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে বলেন। এবং সে অনুষ্ঠানেই রবীন্দ্র সঙ্গীত পরিবেশন করা হয়। খবর পেয়ে পূর্বপাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খান অধ্যাপক অজিত গুহকে কলেজ থেকে চাকুরি থেকেই বিতাড়িত করেন  এবং রাতারাতি জগন্নাথ কলেজটি  সরকারিকরণ করে কর্তৃত্ব সরকারের হাতে নিয়ে নেন। কৈশোরেই শেখ মুজিব স্বদেশী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ফরিদপুরের কিছু সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কর্মীর সংস্পর্শে ভিড়েন। যাদের একজন ছিলেন মাদারীপুরের পূর্ণচন্দ্র। তিনি সন্ত্রাসী হিসেবে ধৃত হন। বিদ্রোহী কবি নজরুল পূর্ণচন্দ্রের   মুক্তি উপলক্ষে মাদারীপুরে আসেন। সভামঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি নিজের লেখা একটি কবিতাধর্মী গানে 'জয়বাংলা' শব্দটি ব্যবহার করেন। তখনি তা শেখ মুজিবের মনে গেঁথে যায়। মুক্তিসংগ্রামে তিনি 'জয়বাংলা' শব্দটিকে লালনপালন করতে থাকেন এবং 'পাকিস্তান জিন্দাবাদ' শ্লোগানের বিরুদ্ধে 'জয়বাংলা' উচ্চারণ করেন। পরবর্তীতে যা মুক্তিযুদ্ধের এবং স্বাধীনতাত্তোর রাষ্ট্রীয় শ্লোগানরূপে ব্যবহৃত হয়। প্রায় ৪১ বছর নির্বাসনে থাকার পর বঙ্গবন্ধু কন্যা রাষ্ট্রীয় শ্লোগান হিসাবে বাংলাদেশ জিন্দাবাদের স্থলেজয়বাংলাকে পুনর্প্রবর্তন করেছেন।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালেই  অসুস্থ ও নির্বাক কবি নজরুলকে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। কবির "চল চল চল" সঙ্গীতটিকে রাষ্ট্রীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীর 'রণসঙ্গীত' করেছেন। একইভাবে বিরল সম্মান প্রদর্শন করেছেন তাঁর কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকেও। ১৯০৬ সালে লেখা 'আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি'-কে জাতীয় সঙ্গীত করে।

বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাও পিতার পথ অনুসরণ করে রবীন্দ্রনাথ ও  নজরুলের নামে পৃথক দুটি  বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন। 

১৯৭২ খ্রীস্টাব্দের ১৬ জুলাই ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের বার্ষিক অধিবেশনে প্রধান অতিথির ভাষণে  জাতির পিতা ঠিকই বলেছিলেন, " বাঙালি জাতীয়তাবাদ না থাকলে আমাদের স্বাধীনতার অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। আমরা বাঙালি। আমরা 'জয়বাংলা' শ্লোগান দিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু করেছি। আমরা সাহিত্য সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের দিক দিয়ে দরিদ্র নই।.. বিশ্বের স্বাধীনতালব্ধ জাতিগুলোর মধ্যে আমরা এদিক থেকে গর্ব করতে পারি যে, আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলন রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগ্রাম হাতে হাত ধরে অগ্রসর হয়েছে।' বঙ্গবন্ধু তাঁর বন্ধু প্রখ্যাত শিল্পী কলিম শরাফীকে বলেছিলেন, 'শিল্পকলা একাডেমি করে দিলাম; এর প্রধান কাজ হবে আমাদের দেশের লোকশিল্পসমূহ সকলরকম শিল্পকর্মের নমুনা সংগ্রহ করে তার ওপর গবেষণা করা। ১৯৭৪ খ্রীস্টাব্দের ফেব্রুয়ারিতে বাংলা একাডেমির আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, 'সাহিত্য-শিল্পে ফুটিয়ে তুলতে হবে এ দেশের দুখী মানুষের আনন্দ -বেদনার কথা, সাহিত্য শিল্পকে কাজে লাগাতে হবে তাদের কল্যাণে। যারা সাহিত্য সাধনা করছেন, শিল্পের চর্চা করছেন, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সেবা করছেন, তাঁদেরকে দেশের জনগণের সঙ্গে গভীর যোগসূত্র রক্ষা করে অগ্রসর হতে হবে।' বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে নাটকের সেন্সরশীপ তুলে নেন। দেশের গরীব দুস্থ গ্রামীণ লোকশিল্পীদেরও একুশে পদক দেন। ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা স্তম্ভ, শিখা চিরন্তন স্থাপনের মাধ্যমে যে সংস্কৃতি বলয় সৃষ্টি করে নানন্দিকতার  ও শিক্ষামূলক সাংস্কৃতিক মূলধারার দেশকে ফিরিয়ে আনেন। ভগ্ন ও অরুচিকর সিনেমার অতীত গৌরব ফিরিয়ে আনতে সরকারি অর্থানুকূল্যে সুস্থধারার সিনেমা নির্মাণের সুযোগ করে দিয়েছেন। সেকালের জনপ্রিয় 'সুন্দরের রানী' খ্যাত নায়িকা শাবানাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে আজীবন সম্মাননা দিয়েছেন শেখ হাসিনা। অসুস্থ ও আর্থিক সংকটে নিপতিত  অভিনেতা -অভিনেত্রী, লেখক, সাংবাদিক, সাহিত্যিকদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। বাক স্বাধীনতা ও মুক্তচিন্তা তথা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার জন্য তিনিই প্রথম বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল প্রতিষ্ঠার সুযোগ করে দেন। দেশে তাঁর কারণেই আজ টিভি চ্যানেলের ছড়াছড়ি। তাঁর প্রায় কুড়ি বছরের শাসনামলে সাংস্কৃতির বিভিন্ন শাখায় প্রভৃতি উন্নয়ন দেখা হচ্ছে। ১৯৫৪ খ্রীস্টাব্দেই শেরেবাংলা-সোহরাওয়ার্দী-ভাসানী- মুজিবের যুক্তফ্রন্ট সরকার ২১ ফেব্রুয়ারিকে 'শহীদ দিবস' ঘোষণা কর এবং দিনটিকে সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা করা হয়। 

মুখ্যমন্ত্রী নূরল আমিনের বাসভবন (বর্ধমান হাউস) বাংলাভাষার গবেষণাগারে পরিণত করে বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠা করা হয়। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রীত্বকালে বাংলাদেশের শহীদ দিবস জাতিসংঘ কর্তৃক আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতিলাভ করে এবং তা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সুমহান মর্যাদায় পালিত হয়। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের যে ঐতিহাসিক ভাষণ, তাও জাতিসংঘের ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্বের ভাষণরূপে গৃহীত হয় এবং বঙ্গবন্ধুকে বিশ্ববন্ধুতে রূপান্তর করেছে।

আজকের যে প্রাণবন্ত একটি মানুষ শেখ হাসিনা। তার কারিগর মা ফজিলাতুন্নেছা। যার হাসিমাখা শ্যামলীময়া মুখখানিতে মায়েরই প্রতিচ্ছবি। আত্মপরিচয় এবং আত্মস্বার্থ কতখানি বিসর্জন দিয়ে শেখ হাসিনার সেবক হয়ে ওঠাও যেনো মায়ের আদর্শ ব্রত হয়ে পাওয়া। স্বামীর নিত্য সাহচর্যে ছিলেন না ফজিলাতুন্নেছা। সর্বংসহা, ধৈর্যের প্রতিমূর্তি, শত দুঃখ-কষ্টের মধ্যেও যাকে দেখা যায়নি এক মুহূর্তের তরে বিচলিত। কেবলই সংগ্রামী স্বামীকে প্রেরণাদানকারী তাই বুঝি মরণেও হয়েছেন সাথী। পুরুষোত্তম স্বামীর সংগ্রামী আদর্শে উজ্জীবীত মহীয়সী নারী।  সর্বংসহা মায়ের অসীম ধৈর্যই বুঝি শেখ হাসিনার জীবনযুদ্ধে এগিয়ে যাবার পুঁজি। মায়ের স্বপ্ন পূরণে চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা- এফডিসি প্রতিষ্ঠা করে দিয়ে গেছেন পিতা।নাট্যকার মামুন উর রশীদের কন্ঠে কন্ঠ মিলিয়ে বলছি, সত্যাসত্যই সংস্কৃতিতে রুচির দুর্ভিক্ষ চলছে।সিনেমা শিল্প ধ্বংসস্তুপে পরিণত।শতশত প্রেক্ষাগৃহ ভেঙ্গে মার্কেট গড়ে তোলা হয়েছে।বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা কী পারেন না- অসাধ্য সাধন করে সিনেমা শিল্পকে আবারও টেনে তুলে দর্শকের হৃদয়ে জায়গা করে দিতে? 

লেখকঃ সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট ও ইতিহাস গবেষক।
 

//জ//

 সাবেক মেয়র আইভি গ্রেপ্তার

জনসমাগম কমলেও আওয়াবী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে আন্দোলন চলছে

মধ্যরাতে আইভীর বাসায় পুলিশের অভিযান, বাড়ি ঘিরে রেখেছে জনতা

নতুন পোপ কার্ডিনাল রবার্ট প্রেভোস্ট

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে পাক প্রধানমন্ত্রীর ফোনালাপ

জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে পদত্যাগ করলেন স্নিগ্ধ

মাহফুজ ও আসিফকে সরকার থেকে সরে আসতে বললেন এনসিপি নেত্রী

বেনজীর কন্যার দুবাইয়ের ফ্ল্যাট জব্দের আদেশ

সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর স্ত্রীর প্লট-ফ্ল্যাট জব্দের আদেশ

সশস্ত্র বাহিনীর ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতার মেয়াদ আরও বাড়ল

মূল্যস্ফীতি ৪ থেকে ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা সম্ভব: গভর্নর

জোড়াতালি দিয়ে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত সম্ভব নয়: তথ্য উপদেষ্টা

ওয়ালটনের অত্যাধুনিক স্মার্ট ফ্রিজ উন্মোচন

ভারতের ১৫ শহরে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা পাকিস্তানের, দাবি দিল্লির

ভারতের ৪০-৫০ সেনাকে হত্যার দাবি পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রীর