
প্রণব মজুমদার
যশোর অভয়নগর থানার চেঙ্গুটিয়া গ্রামের মেয়ে তনিমা সৈয়দ তৃশা। ৫ বোন। বাবা বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডস্ট্রিজ কর্পোরেশনের কর্মচারি। পিতার চাকরির সুবাদে ঢাকার রামপুরাতে থাকেন তৃশারা। সংসারে বোনদের পড়াশুনা, বাসা ভাড়া এবং সংসারের যাবতীয় অনেক খরচ। এসব চিন্তা করে বড় দু’ বোনের মতো তৃষাও টিউশনি করেন। বেসরকারি একটি বিশ^বিদ্যালয়ে নিজের শিক্ষা খরচ নিজেই সংগ্রহ করে ইংরেজি বিষয়ে স্নাতক সম্মানসহ স্নাতকোত্তর শিক্ষা শেষে বসে থাকেননি চাকরির জন্য। নিজের উদ্যোগে মাত্র ৩ হাজার টাকা দিয়ে শুরু করেছেন ব্লক ও বাটিকের ডিজাইনে মেয়েদের থ্রিপিস পোশাকের ব্যবসা। বন্ধুদের মধ্যে এ উদ্যোগ সীমাবদ্ধ না রেখে পরে ফেসবুকে তৃশাস নামে একটি পেস খুলেন গত বছরের আগস্ট থেকে। সুলভ মূল্যে মনকাড়া বাহারি ডিজাইনের ওর উৎপাদিত পণ্য অনলাইনে বিক্রির প্রসার ঘটে। প্রতি মাসে ঘরে বসে আয় করেন প্রায় দেড় লাখ টাকা। এর মধ্যে ৩০ থেকে ৩৩ শতাংশই মুনাফা। সম্প্রতি বিবাহে বন্ধনে আবন্ধ হয়েছেন তৃশা। নিজ সংসারের খরচ ও বোনদের শিক্ষায় অর্থনৈতিক সহায়তা করছেন তিনি। খুলনার সুন্দরবন থেকে মধু এনে অনলাইনে বিক্রির কাজেও যুক্ত হয়েছেন তিনি। মধুয়ানা ও তৃশাস বেশ ভালোই চলছে মারির ক্রান্তিকালে জানালেন স্বনির্ভরশীল উদ্যোক্তা রাজধানীর মগবাজার মধুবাগের বাসিন্দা তৃশা।
চাকরিজীবী পরিবারের মেয়ে ব্যবসা করবেন এটা পরিবারের অনেকেই মানতে পারত না। অনেক চড়াই উৎরাই পার করে নিজ উদ্যোগে ব্যবসা নিয়ে সামনে এগিয়ে গিয়েছেন খুরশীদা জাহান। প্রথমে অফলাইন শপ দিয়ে শুরু করলেও পরে তা অনলাইন ব্যবসায় গড়িয়েছে। তিনি যার নাম দেন ‘রেট্রো কালারস’।
খুরশীদা জাহান পড়াশোনা করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজকর্ম বিভাগে। লেখাপড়া শেষে চাকরি না করে মনস্থির করেন ব্যবসা করবেন। টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ী ও করটিয়ার শাড়ী নিয়ে ৩০ হাজার টাকা দিয়ে শুরু করেছিলেন উদ্যোক্তা হওয়ার যাত্রা, পাশে ছিল ৬ জন কারিগর। পরে রাজশাহী সিল্কে ডিজাইন ও বাটিক করেছেন, তাঁতের পোশাক নিয়েও কাজ করেছেন।
‘রেট্রো কালারস্’ এ পাওয়া যায় টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ী, ডিজাইনারস শাড়ী ও ড্রেস, বাটিকের শাড়ী, ড্রেস, বেডশীট, তাঁতের থ্রিপিস। যার সর্বনিম্ন মূল্য ৪৫০ টাকা এবং সর্বোচ্চ মূল্য ২০ হাজার টাকা।
তিনি উদ্যোক্তা জানান, ‘শুরুতে অনেক ঠকেছি কারণ প্রথমে যেহেতু অফলাইন ব্যবসা ছিল তাই পাইকারি দিতে হতো, যার ফলে বাকি পরতো অনেক বেশী এবং কিছু পণ্য বাদ পড়ে যেত। ফলে আমার অনেক ক্ষতি হতো।’
তিনি আরো বলেন, সবচেয়ে বড় বাধা এসেছিল পার্টনারের বিরোধিতা করায়।
খুরশীদা জাহান অনলাইনে ব্যবসা শুরু করেন ২০১৭ সাল থেকে। অনলাইনেও অনেক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন তিনি। নতুন ব্যবসায়ীরা মূল্য বোঝে না ড্রেস পাইকারি দরে চায়, এটিও অন্যতম বড় বাধা।
খুরশীদা বলেন, পরিবারে আমার বাবার ও স্বামীর পূর্ণ সহযোগিতা পেয়েছি বলেই আমার উদ্যোক্তা হওয়ার পথটা একটু সহজ হয়েছে। ব্যবসার প্রথম টাকা আমি বাবার কাছ থেকে নিয়েছিলাম। বর্তমানে তার শপে আছেন ৩ জন এবং কারখানায় কাজ করেন ৬ জন।
নতুন উদ্যোক্তাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, পড়তে হবে, জানতে হবে, প্রতিটি পণ্য সম্পর্কে জানতে হবে এবং ধৈর্য্য ও বিশ্বাস রাখতে হবে। তাহলে সাফল্য আসবেই।
বিজনেসে নাকি প্রোডাক্টের সোর্সিং আর উদ্যোগের প্রতি ভালবাসা সবচেয়ে জরুরি। সোর্সিংটা তার ছিলই কারণ শাড়ির রাজ্য টাঙ্গাইলে তার নিবাস। আর নারী বলে শাড়ির প্রতি মুগ্ধতাও ছিল অন্য রকম। শুধু দরকার ছিল সাহস। সেটুকু সঞ্চয় করেই ফেসবুকে একটি গ্রুপ খুলে ফেলেন ২০১৭ সালে। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বাংলা বিভাগে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে অধ্যয়নরত জুঁই ভৌমিক বলেন, ‘পরিচিতরা কিন তো কিš‘ কেন জানি ততটা রেসপন্স ছিল না।’ বিশ^বিদ্যালয়ের হলে থাকলে শাড়ি স্টক করা কষ্ট, পাশাপাশি বেশ পুঁজিও লাগে। পুঁজির অভাবে অনেকদিন বসে থাকার পর অল্প কিছু টাকা দিয়ে শুরু করেন হাতে তৈরি গহনার কাজ। এবারে সাড়া ছিলো কল্পনাতীত। কিন্তু লকডাউন শুরু হবার পর গহনার কাজটাও বন্ধ হয়ে যায়। কয়েক মাস বসে থাকার পর কোরবানি ঈদের আগে আবার শাড়ি নিয়ে কাজ শুরু করেন। কিছুদিন পর ফেসবুকে ‘সোমেশ্বরী’ নামে একটা পেজও খুলে ফেলেন।
উ”ছ¡সিত হয়ে তিনি জানান, ‘আমি কখনোই চিন্তা করিনি সবাই এত পছন্দ করবে আমার শাড়িগুলো। আর করোনার জন্য অনেকেই বাইরে গিয়ে কেনাকাটা করছেন না। তাদের ভরসার জায়গা হতে পারাটা ভীষণ আনন্দের। শুরুতে যদিও টুকটাক বাধা বিপত্তি পোহাতে হয়েছে তবু সেসব মোকাবেলা করেই টুকটুক করে সবার ভালবাসা অর্জন করেছে আমার ‘সোমেশ্বরী’।
করোনা ভাইরাসের অতিমারির সঙ্গে অর্থনৈতিক মন্দার শঙ্কা ছিল শুরু থেকেই। অতিমারি ঠেকাতে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সামাজিক সংযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় স্থবির হয়ে পড়ে অর্থনীতি। কাজ হারায় অনেক মানুষ। অর্থনৈতিক দুঃঅবস্থায় টিকতে না পেরে এই শহর ছাড়েন অনেকেই। এমন দুর্যোগেও আশা জাগিয়েছে ইন্টারনেট।
সোশ্যাল মিডিয়া পেজনির্ভর উদ্যোগের মাধ্যমে কেউ শুরু করেছেন নতুন জীবন। আবার কেউ কেউ ¯’বির ব্যবসাকেও দিয়েছে গতি। ¯’বির অর্থনীতিতেও বেড়েছে ই-কমার্স বাজারের আকার, অনলাইন লেনদেনও বেড়েছে আশাতীত।
শুধু টাকার লেনদেনই নয়, ই-ক্যাব বলছে অনলাইন বাজারের আকার ২০২০ সালে দাঁড়াবে ১৬ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা। ২০১৯ সালে এর আকার ছিল ১৩ হাজার কোটি টাকার।
করোনার প্রভাবে রাতারাতি বন্ধ হয়ে যাওয়া অনেক ভৌত ব্যবসা রক্ষার হাতিয়ারও হয়ে উঠেছে অনলাইন। বগুড়ার রেস্টুরেন্ট ও বুটিক ব্যবসায়ী সামিয়া আফরিন গণি তেমনই একজন। সব বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সামিয়া বুটিকের কিছু পণ্য নিয়ে যান বাসায়। সেগুলোই ছবি তুলে আপলোড করেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। আগে তাঁর ক্রেতা ছিল এলাকাভিত্তিক। এখন দেশজুড়েই তাঁর ক্রেতা। ভিডিও করে পণ্য দেখিয়ে ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে পণ্য বিক্রি করেন তিনি। অনলাইন অফলাইন এখন একই কথা।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে নারী উদ্যোক্তাদের উপ¯ি’তি বাড়ছে। ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) তথ্য বলছে, এখন দেশে প্রায় ২০ হাজার ফেসবুক পেজে কেনাকাটা চলছে। এর মধ্যে ১২ হাজার পেজ চালাচ্ছেন নারীরা।
ইসলামপুরের সরু গলি থেকে শুরু করে এখন লন্ডনসহ বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই সুনাম কুড়িয়েছে আঁখি’স কালেকশন। আঁখি’স কালেকশনের উদ্যোক্তা সালমা রহমান আঁখি বললেন, ‘কলেজে পড়া অব¯’ায় বুটিক হাউস দিই। ইসলামপুর, মিরপুর, মোহাম্মদপুর থেকে পোশাক এনে বিক্রি করি। এখন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি বলেই মনে করি।’
মা মেয়ে মিলে ফেসবুকে ‘সাবেরেং’ নামে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির খাবারের ব্যবসা শুরু করেছেন পারাহিতা চাকমা ও তার মা দেবলক্ষী চাকমা (৫৫)। মা খাবার রান্নার বিষয়টি দেখভাল করেন। একটি কলেজের প্রশাসনিক কর্মকর্তা পারাহিতা বললেন, ‘মায়ের ই”ছাতে তাঁকে সঙ্গে নিয়ে মিরপুরের নিজের বাসায় বসে ফেসবুকে নতুন এই উদ্যোগ চালু করে বেশ সাড়া পাচ্ছি।’
উদ্যোক্তারা ঘরে বসে ব্যবসা করছেন, একইভাবে ক্রেতারাও ঘরে বসে পণ্য পছন্দ করে কল করে অথবা বার্তা পাঠিয়ে পছন্দের পণ্যটি হাতে পা”েছন। তবে অনলাইনে এ ধরনের ব্যবসায় ক্রেতারা ঠকছেন বলেও অভিযোগ আছে। ফেসবুকে এক পণ্য দেখিয়ে ক্রেতার কাছে অন্য পণ্য পাঠিয়ে দেয়ার পর ক্রেতারা কোনো প্রতিকারও পাচ্ছেন না।
কিছু অভিযোগ থাকলেও ই-কমার্সে নারী উদ্যোক্তাদের আগ্রহ বাড়ার বিষয়টিকে ইতিবাচক বলে উল্লেখ করছেন ই কর্মাসের সঙ্গে যুক্ত সংশ্লিষ্টরা। বর্তমানে প্রযুক্তির সুবিধায় নারীদের ঘরে বসে কাজ করার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে এফ-কমার্স বা ফেসবুকভিত্তিক ব্যবসা। অনলাইনভিত্তিক ক্রেতা হিসেবেও নারীর সংখ্যাই বেশি।
অনলাইন উদ্যোগে আরেক সফল নারী তোহফাতুল জান্নাত। বেসরকারি একটি বিশ^বিদ্যালয় থেকে ¯’াপত্যবিদ্যা বিষয়ে পড়াশোনা করার সময়ই যুক্ত হন অনলাইন ব্যবসায়ে। তারপর চাকরি করলেও ব্যবসা বন্ধ করেননি। গৃহসজ্জার (এনটেরিয়র) ফার্ম দেয়ার পাশাপাশি শোরুম দিয়েছেন রাজধানীর অভিজাত শপিং মলে।
অনলাইনে তার পেজের নাম ‘ক্যারিড অ্যাওয়ে বাংলাদেশ’। একজন সহকারী নিয়ে নিজের নকশা করা পোশাক বিক্রি করেন। তার মতে, ক্রেতার চাহিদাকে গুরুত্ব দিতে হবে। ঢাকা বা ঢাকার বাইরের ক্রেতার সš‘ষ্টি ও বিশ্বাস অর্জন করতে না পারলে এ ব্যবসায় ভালো করা যায় না।
উদ্যোক্তা নুসরাত আক্তার জানালেন, ২০১৪ সালে ব্যবসা শুরুর আগে ডিজিটাল মার্কেটিং বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে ফেসবুকে পেজ তৈরি করেন। হাতে থাকা ১ হাজার ২০০ টাকা নিয়ে শুরু করা ব্যবসায় এখন ১৫০ জন তাঁতীর কাছ থেকে পোশাক নিয়ে দেশে বিদেশে দিনে প্রায় ২০০ পোশাক বিক্রি করা হচ্ছে। গয়নাও বিক্রি করেন তিনি।
রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার মাহমুদা সুলতানা নিয়মিত অনলাইনে কেনাকাটা করেন। তিনি বলেন, ‘অনলাইনে কেনাকাটা নিয়ে অনেকে প্রতারণার শিকার হলেও নিজে কখনো সমস্যায় পড়িনি।’
তবে মিরপুর ১০ নম্বরের ইলিয়াস কবির স্ত্রীর জন্য ফেসবুকে থ্রিপিস কিনতে গিয়ে প্রতারণার শিকার হন। সঠিক পণ্য মেলেনি, পণ্যের দাম নিয়েও মনে সংশয় ছিল।
অনলাইনের এই প্রসারে বেড়েছে পণ্য পৌঁছানোর ভৌত বাজারও। নতুন কুরিয়ার কোম্পানি তৈরি হচ্ছে, প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিগুলোরও কাজ বাড়ছে। অনলাইন উদ্যোক্তাদের পণ্য সরবরাহে সহায়তা করে এমন একটি প্রতিষ্ঠান ইকুরিয়ার। বিপ্লব ঘোষ রাহুল বলেন,‘নতুন উদ্যোক্তা যুক্ত হওয়া এবং ডেলিভারি দুইই বেড়েছে আমাদের। অনলাইনে মানুষের আগ্রহ বাড়ায় এটা সম্ভব হয়েছে।’
অনলাইন ব্যবসার এ রকম অগ্রগতির পরও মোবাইল ইন্টারনেটের উ”চমূল্য এবং পরিবহন অপ্রতুল ব্যবস্থার কারণে অনলাইন ব্যবসা এখনো পিছিয়ে আছে অনেকটাই। এই বিষয়গুলোতে জোর দেয়া হলে ইন্টারনেটই হতে পারে দেশের সবচেয়ে বড় মার্কেট পেস।
ই-কমার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) এর দেয়া এক তথ্য মতে, অনলাইন লেনদেন ২০১৭ সালে ১২শ কোটি টাকার মতো ছিল। ১৮ ও ১৯ সালে যথাক্রমে ৩ ও ৪ কোটি টাকা করে লেনদেন বেড়েছে। ২০২০ এ এসে এই বাজার দুই হাজার কোটি টাকা বেড়ে ৪ হাজার কোটি টাকায় উত্তীর্ণ হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
লেখক কথাসাহিত্যিক, কবি ও অর্থকাগজ সম্পাদক
ৎবঢ়ড়ৎঃবৎঢ়ৎধহধন@মসধরষ.পড়স
//জ//