
ছবি: উইমেনআই২৪ ডটকম
প্রতিবন্ধী নারীদের অভিজ্ঞতা চ্যালেঞ্জ ও নেতৃত্বের গল্প -৩
পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রে প্রতিবন্ধী নারীরা সবচেয়ে বেশি বৈষম্য ও নির্যাতনের শিকার হন। তাদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে আইন থাকলেও বাস্তবায়ন নেই। কারণ তারা একে তো নারী, তার উপর আবার বিচারপ্রার্থী প্রতিবন্ধী নারী। অন্যদিকে প্রতিবন্ধী নারীদের মধ্যে নেতৃত্ব প্রদানের সংখ্যা হাতে গোণা হলেও, রাজনীতিতে প্রতিবন্ধী নারীর অংশগ্রহণ নেই বললেই চলে। যারা নেতৃত্বের জায়গায় এসেছেন তাদেরকেও নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়।
সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর ইউনিয়নের নবীপুর গ্রামের অষ্টমী মালো। তিন ভাই এক বোনের মধ্যে তৃতীয়। শৈশবেই পলিও জ্বরে আক্রান্ত হয়ে শরীরের এক দিক অবশ হয়ে গিয়েছিল। কারণ তাকে পলিও টিকা দেওয়া হয়নি। হাঁটতে পারতেন না। মা চাইতেন মেয়ে লেখাপড়া শিখুক। প্রতিবন্ধিতার কারণে বাবা তাকে লেখাপড়ার খরচ দিতে অনীহা প্রকাশ করেন।
লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ দেখে মা তাকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দেন। কিন্তু সহপাঠীরা তার প্রতিবন্ধিতাকে নিয়ে উপহাস করত। এক বেঞ্চে বসতে দিতো না। একদিন জোর করে তাকে বেঞ্চ থেকে উঠিয়ে দেয়। তিনি সহপাঠীদের এই আচরণে ভীষণ কষ্ট পান। কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি যান। কিন্তু মা তাকে আবার স্কুলে নিয়ে আসেন।
লেখাপড়ার প্রতি ছিল তার অদম্য আগ্রহ। অষ্টমী মালো সেটা শিক্ষকদের জানায়। এও বলেন, পরিবার তার লেখাপড়ার খরচ দিতে চায় না। শিক্ষকরা তার দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। বাকিটা আত্মীয় স্বজনদের আর্থিক সহযোগিতায় তিনি লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারেন।
পাশাপাশি চিকিৎসার দিকেও নজর দেন। অষ্টম শ্রেনিতে পড়ার সময়ে তিনি তার মাসীর সহযোগিতায় ভারতের বেলেঘাটা বিসিজি রায় পলি হাসপাতালে ভর্তি হন।
চিকিৎসার জন্য ছয় মাস হাসপাতালের বেডে থাকতে হয়েছে তাকে। সেখানে পায়ে কয়েক ধাপ অপারেশন হয়। কিন্তু লেখাপড়ার ক্ষতি হওয়ায় একটি অপারেশন বাকি থাকতেই তিনি হাসপাতাল ছাড়েন। এ কারণে এখন তিনি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটেন। এইচএসসি পাশের পর ২০০৬ সালে তার বিয়ে হয় । কিন্তু লেখাপড়া বন্ধ করেননি। স্বামীর সহযোগিতায় বিএ পাশ করেন।
একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ডিআরআরের কর্মকর্তারা ২০০৪ সালে তার বাড়ি পরিদর্শন করতে আসেন। এই সংস্থায় তার চাকরি হয়। ২০২১ সাল পর্যন্ত তিনি এই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন। এখানে কাজের মাধ্যমে তিনি নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেন। এর স্বীকৃতিস্বরূপ মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের খুলনার বিভাগীয় পর্যায়ে সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার শ্রেষ্ঠ নারী সম্মাননা পান তিনি। এরপরই তিনি এলাকার প্রতিবন্ধী নারীদের উন্নয়নে ‘জয়িতা প্রতিবন্ধী নারী উন্নয়ন সংস্থা’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। প্রায় ১৫০ থেকে ২০০ প্রতিবন্ধী নারীর উন্নয়নে কাজ করছেন সাতক্ষীরার শ্যামনগর ইউনিয়নের অষ্টমী মালো।
অষ্টমী মালো বলেন, প্রতিবন্ধী নারী-শিশু-কিশোরী যারা নির্যাতনের শিকার হন তাদের আইনি সহায়তা প্রদানে সহযোগিতা করাই হলো আমার মূল লক্ষ্য । কোথায় গেলে তারা আইনি সহায়তা পাবেন। এছাড়া তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আর্থিকভাবে সাবলম্বী করে গড়ে তোলা সবদিকে এগিয়ে নিতে কাজ করছি।
এ কাজে বাধার সম্মুখীনও হয়েছেন তিনি। তিনি বলেন, সরকারি-বেসরকারি সুযোগগুলো কেউ প্রতিবন্ধী নারীদের সহজে দিতে চায় না। কারণ একজন প্রতিবন্ধী নারী কাজ করবে এটা কেউ মেনে নিতে পারেন না। এই বাধাগুলো উপেক্ষা করে, কেউ অন্যায় আচরণ করলে প্রতিবাদ করেই আমি আমার লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছি।
শ্যামনগর ইউনিয়নের নবীনগর গ্রামের একজন বুদ্ধি প্রতিবন্ধী মেয়ে ধর্ষণের শিকার হয়। সংবাদ পাওয়া মাত্র তিনি সেখানে যান। ধর্ষণের শিকার মেয়েটিকে শ্যামনগর ওসিসি কেন্দ্রে ভর্তি করান। ধর্ষণকারীকে গ্রেফতারের ব্যবস্থাও করেন।
আরেকটি ঘটনায়ও তিনি এগিয়ে আসেন। একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী নারী তার স্বামীর দ্বারা প্রতিনিয়ত নির্যাতনের শিকার হচ্ছিলেন। তার সাথে সংসার করা সত্বেও স্বামী আরেকটা বিয়ে করে। ভিডিও কলে দ্বিতীয় স্ত্রীর সাথে কথা বলত, আর দৃষ্টি প্রতিবন্ধী স্ত্রীকে নির্যাতন করত কেনো সে স্বামীর বাড়ি ছেড়ে যায় না। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে প্রথম স্ত্রী ঘটনাটি অষ্টমী মালোকে জানায়।
অষ্টমী মালো বলেন, ঘটনাটি সত্যতা যাচাই করি। তার স্বামীর বিরুদ্ধে পারিবারিক নির্যাতন আইনে মামলা করা হয়। পুলিশ তার স্বামীকে গ্রেফতার করে। কিন্তু কিছুদিন পর জামিনে বের হয়ে আসে। শ্যামনগর থেকে সাতক্ষীরা দূরত্বের কারণে একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী নারীর মামলায় হাজিরা দেওয়াও অনেক কষ্টকর হয়ে ওঠে । এক্ষেত্রে যাতায়াত খরচেরও একটা বিষয় রয়েছে। উপকূলীয় এলাকায় ভিকটিম নারীদের এটি একটি বড় সমস্যা।
উইম্যান উইথ ডিজাব্লিটিজ ডেভেলপম্যান্ট ফাউন্ডেশন (ডাব্লি উডিডিএফ) দেশের ৭টি বিভাগে প্রতিবন্ধী নারী ও মেয়েশিশুদের প্রতি লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার উপর একটি জরিপ পরিচালনা করেছে। গত বছরের ২০২৪ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ২ হাজার ১৩২ জন উত্তরদাতার ওপর এই জরিপ পরিচালনা করা হয়।
এতে উঠে এসেছে, বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী নারী ও মেয়েশিশুরা এক ধরনের “দ্বৈত প্রান্তিকতা”-র মধ্যে রয়েছেন। তারা নারী ও মেয়েশিশু এবং প্রতিবন্ধী হওয়ার কারণে দ্বিগুণ বৈষম্যের শিকার হয়। এই দুয়ের মিলিত প্রভাব তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান ও সামাজিক মর্যাদায় গভীর প্রভাব ফেলছে। অন্যদিকে, সমাজের সক্ষম পুরুষকেন্দ্রিক কাঠামো তাদের আরও অদৃশ্য করে দিচ্ছে। বাড়িয়ে দিচ্ছে শোষণ ও বিচ্ছিন্নতার ঝুঁকি।
গবেষণায় জানা যায়, প্রতিবন্ধী নারীদের ৭৫ শতাংশ শিক্ষা পাওয়ার ক্ষেত্রে গুরুতর বাধার সম্মুখীন হয়েছেন। ৪৮ দশমিক ৫৫ শতাংশ কখনো কোনো আনুষ্ঠানিক শিক্ষা পাননি। এদিকে অর্ধেকের বেশি ৫২ দশমিক ৬ শতাংশ বেকার, আর মাত্র ৪ দশমিক ৮৩ শতাংশ কোনোভাবে আনুষ্ঠানিক কর্মসংস্থানে যুক্ত। যদিও ৬৪ শতাংশ প্রতিবন্ধী নারী নিজেদের রাজনৈতিক অধিকার সম্পর্কে সচেতন। তবুও ৬৭ শতাংশের বেশি বলেছেন, গত এক বছরে কোনো রাজনৈতিক কর্মকান্ডে তারা অংশ নেননি।
প্রতি তিনজনের একজন জানিয়েছেন, তারা (শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতন ) কোনো না কোনো ধরনের সহিংসতার শিকার হয়েছেন। দুঃখজনক হলেও সত্যি, ৬৭ শতাংশ প্রতিবন্ধী নারী জানেনই না, দেশে সহিংসতার শিকার প্রতিবন্ধী নারীদের সহায়তা দেয় এমন কোনো সংস্থা আছে। ৬৫ দশমিক ৬ শতাংশ উত্তরদাতার মতে, বৈষম্য একটি বড় বাধা। ৫৯ দশমিক ১৫ শতাংশ মনে করেন, অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা, ৫৩ দশমিক ৮০ শতাংশ তথ্যের অভাব এবং ৩৭ দশমিক ৩৪ শতাংশের মতে, সাংস্কৃতিক রীতিনীতিও রাজনৈতিক অংশগ্রহণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। ৭৮ দশমিক ৯০ শতাংশ প্রতিবন্ধী নারী রাজনীতিতে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে প্রধান বাধা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কারণ দেশে এখনো হুইল চেয়ার ব্যবহারকারী প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, প্রবীণ, গর্ভবতীর মতো শারীরিক অবস্থায় চলাচলকারীদের প্রবেশগম্যতা সৃষ্টি হয়নি।
জরিপে অংশ নেওয়া ১ হাজার ৬৮২ জন জানিয়েছেন, রাজনৈতিক সভা, ভোটকেন্দ্র বা সরকারি দপ্তরে প্রবেশের সুযোগ সীমিত থাকায় তারা রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হতে পারছেন না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন এন্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. তানিয়া হক বলেন, পরিবার, সমাজ ও জনবহুল স্থানে প্রতিবন্ধী নারীরা অনেক ঝুঁকিতে রয়েছেন। প্রতিবন্ধী নারীর অবস্থার উন্নয়নে একটি সমন্বিত জাতীয় গবেষণা হওয়া জরুরি।
এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তাসলিমা ইয়াসমীন বলেন, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে বাংলাদেশের আইনে অধিকারভিত্তিক দিকগুলোকে উপেক্ষা করা হয়েছে। সব প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য একই রকমের সংকট ও অধিকারের কথা তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবন্ধী নারীরা যে বৈষম্যের শিকার এবং তাদের জন্য বিশেষ ধরনের মনোযোগ দরকার, তা আইনটিতে নেই।
প্রতিবন্ধী নারীদের প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ, নির্যাতনের শিকার হলে বিচার চাওয়ার ক্ষেত্রে প্রবেশগম্যতা ও তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কাজে সমন্বয় আনতে হবে জানালেন বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সালমা আলী।
ইউ