
ফাইল ছবি
ইপিজেডে-এর নামে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতাল কৃষক উচ্ছেদ প্রচেষ্টা বন্ধ এবং বাস্তবায়িত ইপিজেড কেন্দ্রিক দুর্নীতির তদন্তের দাবি জানিয়ে ৩২ জন নাগরিক বিবৃতি প্রদান করেছেন।
বিবৃতিতে বলা হয়, আমরা গভীর উৎকন্ঠা ও ক্ষোভের সঙ্গে লক্ষ করছি, বিগত স্বৈরশাসনের অনুগতদের পথ অনুসরন করে এক শ্রেণীর দুর্নীতিগ্রস্ত আমলা এবং একটি দুষ্টচক্র দেশের যত্রতত্র বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল কিংবা ইপিজেড-এর নামে দেশের অনেক উর্বর কৃষি জমি অধিগ্রহণ এবং আবাদী দরিদ্র কৃষক এবং বিশেষভাবে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষদের উচ্ছেদের পায়তারা চালিয়ে যাচ্ছে। এই মূহুর্তে গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জের বাগদা ফার্ম এলাকার সাঁওতাল কৃষকদের উচ্ছেদ করতে সেখানে ইপিজেড করার ঘোষণা দিয়ে একটি সংঘবদ্ধ দুর্নীতিবাজ চক্র অতি তৎপর হয়ে উঠেছে। আমরা ক্ষোভের সঙ্গে এটাও লক্ষ করছি যে, ঐ ধরনের ইপিজেড অথবা বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল করতে হলে তার জন্য প্রকল্প গ্রহণের আগেই স্বাধীন নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞদের দ্বারা যে পরিবেশ-এর উপর প্রভাব নিরপনের জন্য ইআইএ এবং সামাজিক প্রভাব পরিমাপের জন্য এসআইএ করার বাধ্যতামূলক বিধান রয়েছে তার কোনটাই ওখানে করা হয়নি। বিশেষভাবে উল্লেখ্য, এটা শুধু গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের জন্যই সত্য তা নয়, বিগত স্বৈর শাসকদের আমলে যে সকল বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল বা ইপিজেড হয়েছে বা প্রস্তাব করা হয়েছিল তার অনেকগুলির জন্য কোন যথাযথ ইআইএ বা এসআইএ এর কোন কিছুই সম্পন্ন করা হয়নি।
পেশাগত ও সম্মিলিত অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিগত দেড়-দুই দশকে ইপিজেড (এক্সর্পোট প্রোসেসিং জোন) স্থাপন কেন্দ্রিক যে সকল প্রকল্প বাস্তবাযন করা হয়েছে তাতে প্রতিশ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের নামে অনেক ক্ষেত্রে জন দুর্ভোগ, জন হয়রানি, প্রান্তিক কৃষক, আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উচ্ছেদ ইত্যাদি যে শুধু বেড়েছে তা নয়, বরং ঐ সব প্রকল্প বাস্তবায়ন করার প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম, দুর্নীতিরও অনেক অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া সব থেকে বড় বিষয় হচ্ছে ই্পিজেড-এর নামে যে সকল কৃষি জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে তার একটি বড় অংশ দুই ফসলা/তিন ফসলা উর্বর কৃষি জমি। অনেক জমি অধিগ্রহণ করার পরে অনেক বছর অতিবাহিত হলেও সেখানে কোন ইপিজেড-এর কার্যক্রম চালুই হয়নি। যে সকল কৃষকদের কাছ থেকে ঐ সব উর্বর কৃষি জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে তাদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ কোন ক্ষতিপূরণ পায়নি বলেও অভিযোগ আছে। এই সকল প্রকল্পে শত শত কোটি টাকা বিগত বছরগুলিতে লুটপাট ও আত্মসাতেরও অনেক অভিযেগ রযেছে।
বিগত ১৬ বছরের স্বৈর শাসনামলে ১০০টি ইপিজেড বা বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের ঘোষণা দিলেও বাস্তবে প্রায় ৩৩ হাজার একর অধিগ্রহণকৃত জমিতে মাত্র ১০টি ইপিজেড বা বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন করা হয়েছিল। যার ৮টি সরকারী উদ্যোগে, বাকী ২টি বেসরকারী উদ্যোগে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল বেজার কর্তৃপক্ষের অভিমত অনুসারে এই সব ইপিজেড খাস জমি, পুরুদ্ধার হওয়া ভ‚মি ও অকৃষি জমিতে স্থাপিত হওযার কথা থাকলেও, বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা যায়, বেশির ভাগ ইপিজেড-এর অধিকাংশ জমি ২/৩ ফসলা উর্বর কৃষি জমি।
এছাড়া বেসরকারি উদ্যোগে যে কয়েকটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপিত হয়েছে, সেই ক্ষেত্রেও সরকারের অধিগ্রহণকৃত জমি কিংবা বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের বৈধ/ অবৈধভাবে দখলকৃত ভ‚মিরও বড় অংশই উর্বর কৃষি জমি অথবা ভরাট করা জলাধার। বেসরকারী উদ্যোক্তাদের একটি অংশ অবৈধ উপায়ে উর্বর কৃষি জমিতে বালু ফেলে তাকে প্রথমে অনুর্বর করে তারপর তাকে অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করেছে-নারায়নগঞ্জের সোনারগাঁওসহ এ রকম দুর্বৃত্তপনার একাধিক নজির রয়েছে। যদিও সম্প্রতি বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল (বেজা)-এর চেয়ারম্যান তাদের অধীনে থাকা ১০টা অর্থনৈতিক অঞ্চল বাতিল ঘোষণা করেছেন এবং তিনি বলেছেন, বর্তমান বাস্তবতায় আগামী ১০ বছরে ১০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল করা গেলেই তা যথেষ্ট হবে।
এই বাস্তব পরিস্থিতির আলোকে আমরা অন্তবর্তী সরকারের কাছে নিম্নোক্ত দাবিগুলি উত্থাপন এবং অবিলম্বে তা কার্যকর করার দাবি জানাচ্ছি-
১. গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ -এর বাগদা ফার্ম এলাকায় কৃষি কাজে নিয়োজিত ও বসবাসরত সাঁওতাল আদিবাসীদের উচ্ছেদের অসৎ উদ্দেশ্যে ইপিজেড স্থাপনের যে প্রচেষ্টা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয় এবং জেলা প্রশাসনের কোন কোন কর্মকর্তার প্রচ্ছন্ন সমর্থনে একটি সংঘবদ্ধ চক্র চালিয়ে যাচ্ছে বলে যে অভিযোগ আছে, তা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।
২. এ পর্যন্ত যে সকল ইপিজেড স্থাপিত বা প্রস্তাবিত হয়েছে সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগে সেগুলির ভ‚মি অধিগ্রহণ থেকে শুরু করে তার সার্বিক বাস্তবায়নে কোন ধরণের দুর্নীতি, অনিয়ম, আইনের লংঘন হয়েছে কি না, সাধারণ দরিদ্র কৃষক, আদিবাসী কিংবা অন্য কোন জনগোষ্ঠী ক্ষতিপূরণ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন কিংবা অন্য কোন ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন কি না তা তদন্ত করে দেখার জন্য একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করতে হবে।
৩. ইপিজেড, এসইজেড করতে গিয়ে কি পরিমাণ উর্বর কৃষি জমি বিনষ্ট হয়েছে কিংবা এখনো অব্যবহৃত পড়ে আছে তা নিরুপন করতে হবে। ইপিজেড অথবা এসইজেড বাস্তবায়নের নামে পরিবেশ ও কৃষির কি পরিমাণ ক্ষতি করা হয়েছে তা জানা জরুরি। অবশ্যই তা নিরূপন করতে হবে।
৪. যারা দুর্নীতি, অনিয়ম, অনাচার বা কৃষকদের সাথে প্রতারণার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন, তাদের সনাক্ত করে আইনের আওতায় এনে জবাবদিহি ও শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
৫. যে সকল ইপিজেড বা বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল এখনো অব্যবহৃত রয়েছে ঐ সকল অঞ্চলকে অধিগ্রহণ থেকে অবমুক্ত করে যে সকল কৃষকদের জমি হুকুম দখল করা হয়েছিল, প্রয়োজনে আইন সংশোধন করে বিশেষ ব্যবস্থায় তা কৃষিতে ফেরৎ দেবার ব্যবস্থা করতে হবে।
বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছেন-
১. ড. হামিদা হোসেন, মানবাধিকার কর্মী
২. সুলতানা কামাল, মানবাধিকার কর্মী ও প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারপার্সন, মানাবাধিকার সাংস্কৃতিক ফাউন্ডেশন
৩. খুশী কবির, মানবাধিকারকর্মী ও সমন্বয়ক, নিজেরা করি
৪. ড. ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাহী পরিচালক, টিআই-বি
৫. রাশেদা কে. চৌধুরী, নির্বাহী পরিচালক, গণস্বাক্ষরতা অভিযান ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা
৬. শিরীন পারভীন হক, সদস্য, নারী পক্ষ
৭. শাহীন আনাম, নির্বাহী পরিচালক, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন
৮. ড. সুমাইয়া খায়ের, অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
৯. অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না, সিনিয়র অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
১০. এড. তাসলিমা ইসলাম, প্রধান নির্বাহী (ভারপ্রাপ্ত), বেলা
১১. ড. সামিনা লুৎফা, অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
১২. শামসুল হুদা, নির্বাহী পরিচালক, এএলআরডি
১৩. রোবায়েত ফেরদৌস, অধ্যাপক গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
১৪. ড. জোবাইদা নাসরীন, অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
১৫. ড. স্বপন আদনান, ভিজিটিং প্রফেসর, লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্স এবং পলিটিকাল সায়েন্স
১৬. অ্যাডভোকেট সালমা আলী, নির্বাহী পরিচালক, বিএনডব্লিউএলএ
১৭. এড. সুব্রত চৌধুরী, সিনিয়র আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট
১৮. তাসনীম সিরাজ মাহবুব, সহযোগী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
১৯. ড. খায়রুল চৌধুরী, অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
২০. পাভেল পার্থ, পরিচালক, বারসিক
২১. অ্যাড. মিনহাজুল হক চৌধুরী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট
২২. মনীন্দ্র কুমার নাথ, ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ
২৩. রোজিনা বেগম, লেখক ও গবেষক
২৪. মাইদুল ইসলাম, পি এইচ ডি গবেষক, পিটসবার্গ ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র
২৫. ড. সাদাফ নূর, অধ্যাপক, ল্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটি
২৬. রেজাউল করিম চৌধুরী, নির্বাহী পরিচালক, কোস্ট ট্রাস্ট
২৭. জাকির হোসেন, প্রধান নির্বাহী, নাগরিক উদ্যোগ
২৮. দীপায়ন খিসা, মানবাধিকার কর্মী
২৯. অ্যাডভোকেট সাইদুর রহমান, প্রধান নির্বাহী, মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন
৩০. রেজাউর রহমান লেলিন, গবেষক ও মানবাধিকারকর্মী
৩১. সাঈদ আহমেদ, মানবাধিকার কর্মী
৩২. হানা শামস আহমেদ, পিএইচডি গবেষক, ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা
নির্বাহী পরিচালক, এএলআরডি
ইউ