ঢাকা, বাংলাদেশ

শুক্রবার, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ মে ২০২৪

English

সাহিত্য

বাংলাটা ঠিক আসে না

অশোক সেনগুপ্ত

প্রকাশিত: ১০:০১, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪; আপডেট: ১০:৩৫, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

বাংলাটা ঠিক আসে না

সংগৃহীত ছবি

বখশীশ, না বখসিস? না কি বকশিশ, বা বকশিস? শব্দটা লিখতে গেলে শুদ্ধতার প্রশ্নে তো কপালে ভাঁজ পড়বেই। কোনটা ঠিক? সংসদ অভিধানে কিন্তু ওই চারটে বানানই রয়েছে। কথাটার উৎপত্তি ফার্সি বখ্ শীশ থেকে। 

আজ বুধবার, ২১শে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।  সামাজিক মাধ্যম ওই দিন উতল হয়ে ওঠে। কিন্তু বছরভর আমরা কতটা যত্নবান থাকি শুদ্ধ বাংলা শব্দ ব্যবহারে? যেটা দিয়ে শুরু করেছি, হরেক বাংলা বানান আছে, এটাও হয়, ওটাও হয়। যেমন হেনস্তা, হেনস্থা। পরগনা ও পরগণা। মোদী ও মোদি। শিরপা, শিরোপা। বকেয়া ও বখেয়া (আরবি ‘বকীয়া’ থেকে)। বাংলায় ঢুকে পড়া আর এক আরবি শব্দ মুনশি, মুন্সি, মুন্সী— তিন রকম বানান আছে অভিধানে। ফার্সি মুসলমান, আরবিতে মুস্লিম। দুটোই বাংলায় চলে। ‘শিরোনামায়’ না ‘শিরনামায়’? দুটোই চলে (ফার্সি সর্ নামহ্ থেকে আসা)। আবার সংস্কৃত মুষল ও মুশলও বাংলায় পরিচিত। যেমন মুশলধারে বৃষ্টি। মুশল কথাটার অর্থ পেষণদণ্ড। 


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘গরু’ ও ‘গোরু’— দুটো বানানই ব্যবহার করেছেন। আবার সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন গরু। আবার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ডঃ সৌমিত্র শেখর লিখেছেন, “জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস তাঁর ‘বাঙ্গালা ভাষার অভিধান’-এ যেখানে হিন্দি ভাষায় ‘গোরু’ শব্দের ব্যবহারকে চিহ্নিত করেছেন।”
সব মিলিয়ে ধন্দে ফেলার পক্ষে যথেষ্ঠ তো বটেই! ‘শ’ না ‘স’, ‘ন’ না ‘ণ’, ‘ি’ না না ‘ী’— লিখতে গিয়ে হামেশাই ধন্দে পড়ি আমরা।

যাঁরা বই পড়েন, তাঁরা অনেকে বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের ‘ডিহি কলকাতা ছাড়িয়ে’ নামটার সঙ্গে পরিচিত। ডিহি মানে গ্রাম। ডিহি কলকাতা ছিল বাংলার একটি অধুনালুপ্ত জনপদ। ডিহি থেকে দহ। যার থেকে মালদহ, শিলাইদহ, শিয়ালদহ, আড়িয়াদহ, চাকদহ— প্রভৃতি হরেক দহ। ক্রমে মালদহ, শিয়ালদহ, চাকদহ হয়ে উঠেছে শিয়ালদা, মালদা, চাকদা। তাহলে আমরা কোনটা লিখব? 

যদি নির্দিষ্ট প্রকাশনা সংস্থা হয়, একটা বানানবিধি মেনে চলা উচিত। অধিকাংশই মানতে পারে না। তবে, আনন্দবাজার পত্রিকা বানানবিধি মেনে চলার চেষ্টা করে। অনেকে তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, বা ভিন্নমত 
পোষণ করেন। কিন্তু দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় দেখেছি, তাদের অনুসৃত নীতির যথেষ্ঠ যুক্তি আছে। 

ওই পত্রিকায় সাংবাদিক হিসাবে একটা সময় আমাদের প্রতিদিন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর নির্দেশিকা পড়তে হত। তাঁর লেখা ‘বাংলা কী লিখবেন কেন লিখবেন' বইয়ের ফ্ল্যাপে লেখা— “আপনি বঙ্গভাষার লেখক । কিন্তু যে বাংলা আপনি লেখেন, তা কি পুরোপুরি নির্ভুল”? বইটির কথা অনেকেই জানেন। আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত ভুল বানান-ব্যাকরণগুলো রোজ তিনি স্বহস্তে একটা ফুলস্কেপ কাগজে লিখে দিতেন। তখনও সেভাবে কম্পিউটার আসেনি। কাগজটির কয়েকটি প্রতিলিপি কিছু বাঁধানো খাতায় আঠা দিয়ে লাগিয়ে পাঠানো হত পত্রিকার রিপোর্টিং, ডেস্ক, সম্পাদকীয় বিভাগে। সম্পাদক মহাশয়ের নির্দেশ ছিল সেটি ভালভাবে দেখার। যাতে সকলে একই ভুল একাধিকবার না করেন। 

ছোটবেলায় আমরা লিখতাম চীন, দীঘা, আসাম। এখন লিখি চিন, দিঘা, অসম। যুগান্তরের সাথে সাথে এভাবে বদলে যায় অজস্র বানান। বাংলা ১৩২৩-এ (এখন ১৪২৯) জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস (১৮৭২-১৯৩৩) সংকলিত ও সম্পাদিত ‘বাংলা ভাষার অভিধান’-এ হিউয়েন সাঙ্ বানান ৯ রকম লেখা হয়েছে। প্রামান্য ওই অভিধানে আছে বাঙ্গালী, স্ট্রীট, পর্ত্তুগীজ, দুর্ব্বোধ্য, পূর্ব্ববঙ্গ প্রভৃতি বানান। এখন এই প্রতিটি বানানই বদলে গেছে।

এপার বাংলায় আমরা যেরকম নামের সঙ্গে বাবু কথাটা ব্যবহার করি, হিন্দিতে পুরুষ এবং মহিলা উভয় ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হয় ‘জী’ বা ‘জি’ কথাটা। মুলায়ম সিং যাদবকে উত্তরপ্রদেশে বলা হত নেতাজি। কয়েক বছর আগে একটি বাংলা দৈনিকে তাঁর নামের সঙ্গে ‘নেতাজি’ সম্বোধনটি ব্যবহার নিয়ে বিতর্ক ও প্রশ্ন উঠেছিল। কারণ, বাঙালি তার প্রাণের নেতাজির (সুভাষ চন্দ্র বসু) সমনামে আর কাউকে মানতে পারে না। আশৈশব দেখেছি আর একজন ‘
জি’ পেয়েছে বাংলা। তিনি হলেন গান্ধিজি। কিন্তু এখন বাংলা শব্দমালায় প্রবল বেগে ঢুকে পড়েছে মোদীজি, অমিতজির মত বেশ কিছু ‘জি’। প্রশ্ন উঠতেই পারে নির্বিচারে এ ‘জি’-র ব্যবহার কতটা সমর্থনযোগ্য। 

ভাষায় শব্দের প্রবাহ নতুন কিছু নয়। অসংখ্য বিদেশি এবং প্রাদেশিক শব্দ বাংলা শব্দমালায় ঢুকে গ্যাঁট হয়ে বসে গেছে। কিন্তু প্রচলিত বাংলা শব্দ থাকতেও আমরা কথ্য ভাষায়, এমনকি পোর্টালে ইংরেজির ছড়াছড়ি দেখি। রেজাল্ট, মেরিট লিস্ট, ইলেকশন, লাঠিচার্জ, ওয়ারেন্ট— প্রতিদিন এ ধরণের হরেক শব্দ চোখে পড়ে বাংলা খবরের নানা পোর্টালে। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় কথাটা যত লিখি বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয় ততটা বলিনা, লিখিনা। বদলে স্কুল, কলেজ বলায়, লেখায় আগ্রহ ও স্বচ্ছন্দ বেশি। 

সমাজ মাধ্যমে বাংলা বানান-ব্যাকরনের শুদ্ধতা খুঁজতে গেলে মাথা খারাপ হয়ে যাবে। ১২/২/২৪-এ জনৈকা কৃষ্ণা ভট্টাচার্য লিখেছেন, “আমার বাড়িতে একজন বিশ্বস্থো কাজের লোক চাই, কেও ইচ্ছুক থাকলে  ।” সঙ্গে মুঠোফোন নম্বর। অপর একটি পোস্টে বড় হরফে একজন লিখেছেন, “একটি টু রুম ডাইনি ডাবল টয়লেট ফ্ল্যাট আছে”। হত ডাইনিং। এমন কিছু ক্ষেত্রে দেখেছি নেটনাগরিকদের কেউ ভুলটা শুদ্ধ করে দেওয়ার আবেদন করে প্রকাশ্যে মুখ ঝামটা খেয়েছেন। কি আর কী-এর ব্যবহারে আমাদের গুবলেট করে ফেলার অজস্র নমুনা ছড়িয়ে। সেই আমরাই ৩১শে কুম্ভীরাশ্রু বর্ষণ করব মাতৃভাষার বিপন্নতায়। 

পোর্টালগুলোর বাংলায় ছন্দপতন নিয়ে কেউ আকর্ষণীয় একটা সংকলন করতে পারেন। কিছুকাল আগে একটি পোর্টাল লিখেছে “গ্রেফতার চার কুক্ষাত চোর“। একটি খবরে সৌগত রায়ের ছবি দিয়ে তাঁর উক্তি দিয়েছে জি ২৪। নিচে বড় হরফে লিখেছে “বিশ্বব্যাকে আমাদের বিরোধী ঐক্য দরকার নেই“। কথাটা হবে বিশ্বব্যাপী। টিভি নাইন-এর একটি খবরের শিরোনাম ‘‘ভাতের হোলেট ভুলে“।

হোটেল হয়ে গিয়েছে হোলেট। একটা ‘ব্রেকিং’-এ মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর ছবির পাশে লেখা, “কথা বলবেন বাজি কারখানার নিহতদের সঙ্গে”। গত ১৪/২-এ এবিপি আনন্দ-র মত প্রথম সারির পরিবেশক পোর্টালে উপহার দিল সঙ্গা কথাটা। হবে সংজ্ঞা। আমজনতাকে দেওয়ার আগে শব্দ ও বাক্যের শুদ্ধতা বজায়ের ছাঁকনি নেই। থাকলেও তাতে এত বড় গর্ত যেটা দিয়ে এ সব গলে যাচ্ছে।   

১২ জানুয়ারি একটি পোর্টাল শিরোনামায় লিখল, বিবেকান্দের জন্মবাষিকী পালন সাড়ম্বরে। দেখুন প্রথম দুটি শব্দেরই ভুল বানান। 

‘ব্যাঘ্র’-তে আ-কার আছে। কিন্তু একই রকম উচ্চারণ সত্বেও ‘ব্যথা’তে আ-কার নেই। এটা একটা উদাহরণ। ধন্দে ফেলার জন্য এরকম প্রচুর শব্দ আছে। নানা কারণে প্রচারমাধ্যমে বানানের ভ্রান্তি উদয় হয়। সমাধানের জন্য রয়েছে অভিধান। তাতে না পেলে আমি কখনও ডঃ পবিত্র সরকার, ডঃ অচিন্ত্য বিশ্বাস, প্রাক্তন অগ্রজ সহকর্মী শম্ভু সেনের কাছে প্রশ্ন করি। অবশ্যই এঁরা তিনজন বানান-ব্যাকরণে নির্ভরযোগ্য। 

এক সহকর্মী তাঁর খবরে বারাশত বানানটা লিখলেন। ডেস্ক-এর এক সহকর্মী ওই বানানের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুললেন। সংবাদদাতা স্থানীয় একটি স্কুলের ব্যাজের ছবি প্রমাণ হিসাবে পাঠিয়ে দিলেন। তাতে বারাশত লেখা। অগত্যা সেই বানানই নেওয়া হল। গত ১০ জানুয়ারি পশ্চিম বঙ্গ মধ্য শিক্ষা পর্ষদের প্রাক্তন সচিব, উচ্চ শিক্ষা সংসদের প্রাক্তন সভাপতি এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাসমূহের নিয়ামক, স্থানীয় বাসিন্দা, বাংলায় প্রকৃতই সুলেখক সুদীন চট্টোপাধ্যায়কে প্রশ্ন করলাম, “বারাসাত না  বারাশত? কোন বানান হওয়া উচিত?” জবাবে তিনি জানালেন, “বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে বর্তমানে 'বারাসাত' নামই স্বীকৃত ও সর্বস্তরে গৃহীত হয়েছে।”

২০২০-তে অক্ষয় কুমার দত্তর দু’শ বছর পূর্ণ হয়েছে। বিজ্ঞানমনস্ক এই তপস্বী তৈরি করেছিলেন অজস্র বাংলা পরিভাষা। পুরাতত্ত্ব থেকে গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান থেকে ভাষাতত্ত্ব, বহুসংস্কৃতির পুরোধা ছিলেন তিনি। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চাকে পথ দেখিয়েছিল এই পরিভাষা। বিজ্ঞান, গণিত, ভূগোলের ক্ষেত্রে অসংখ্য পারিভাষিক শব্দ তৈরি করেছিলেন। যেমন, দূরবীক্ষণ, অণুবীক্ষণ, চুম্বক, জ্যোতির্বিদ্যা, দাহ্য পদার্থ, জড়, তড়িৎ, পরিমিতি, ধ্রুবতারা, অঙ্গার, বাষ্প, বজ্র, জোয়ার, রামধনু, সৌরজগৎ, মাধ্যাকর্ষণ, গ্রহণ, সুমেরু, কুমেরু, মানমন্দির, জ্বালামুখী, আগ্নেয়গিরি। এগুলি নমুনা মাত্র। তালিকাটি দীর্ঘ। শব্দগুলির সঙ্গে আমরা প্রায় সকলেই পরিচিত। কিন্তু বলার এবং লেখার সময় ক’জন সেভাবে ব্যবহার করি?

এরকম চলতে থাকলে আমরা কি নিজেদের অবহেলায় অনেক শব্দের অপমৃত্যুর আশঙ্কা তৈরি করছি না? বাংলা কি সংস্কৃতের মত গুরুত্বহীন হয়ে অবলুপ্তির পথ ধরবে? কয়েক মাস আগে ৩৮ বছর ধরে বাংলায় অধ্যাপনা করা, প্রাক্তন উপাচার্য ডঃ অচিন্ত্য বিশ্বাসকে এই প্রশ্ন করেছিলাম। জবাবে তিনি বলেন, “প্রশ্নটার যুক্তি আছে। তবে আরও ৩০০ বছর ভাষাটা টিঁকবে কারণ এ রাজ্যের গ্রামগঞ্জের মুখের ভাষা, মনের ভাষা বাংলা।”

কিন্তু এখন পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক গুরুত্ব কতটুকু? বাংলার বানিজ্যিক মূল্যও তলানিতে। 
শিশুদের সুন্দর সুন্দর ছড়া ও পাঠ্যবই সরিয়ে তাদের হাতে তুলে দিচ্ছি ইংরেজি বই। আর চাইব সবাই বাংলায় ভাবুক, বলুক, লিখুক— তা কি হয়? সব দেখেশুনে সদ্যপ্রয়াত কবি ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের সুন্দর কবিতার পংক্তিগুলো মনে পড়ছে—
“জানেন দাদা, আমার ছেলের, বাংলাটা ঠিক আসেনা।
ইংলিশে ও ‘রাইমস’ বলে
‘ডিবেট’ করে, পড়াও চলে
আমার ছেলে খুব ‘পজেটিভ’  অলীক স্বপ্নে ভাসে না
জানেন দাদা, আমার ছেলের, বাংলাটা ঠিক আসে না।”

//এল//

নরসিংদীতে বজ্রপাতে প্রাণহানি ২

যে দেশে সন্তান নিলেই পাবেন ১ কোটি ২৩ লাখ টাকা !

‘বিদ্যুৎ সংকটে লোডশেডিং হবে গুলশান-বনানীতে’

ডিএসইসির নবনির্বাচিত কমিটির দায়িত্ব গ্রহণ

বাজেট ঘোষণা ৬ জুন 

ভারতের কাছেও হোয়াইটওয়াশ টাইগ্রেসরা

মেয়ের মা হলেন পরীমণি

ওয়ালটন ফ্রিজ কিনে লাখ টাকা ক্যাশ ভাউচার পেলেন এনামুল

সিআইপি কার্ড পেলেন যে ১৮৪ ব্যবসায়ী

অটোয় যাত্রী তোলা নিয়ে সংঘর্ষে প্রাণহানি ৩

তামিলনাড়ুতে বিস্ফোরণে প্রাণহানি ৮

রাতে বজ্রবৃষ্টির আশঙ্কা

৪৬তম বিসিএসের প্রিলিমিনারির ফল প্রকাশ

পিরোজপুরে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তা কর্মচারীদের কর্মবিরতি চলছে

নিজের নামে স্থাপনায় প্রধানমন্ত্রীর না