ঘুরে আসুন রুমি দরওয়াজা
দু'বছর পর আবার শুরু সপরিবার ভ্রমণ। এবার লক্ষ্ণৌ হয়ে কুমায়ূণ হিমালয়। সপ্তমীর সকালে কলকাতা স্টেশনে ধরি 'অকাল -তক্ত্ এক্সপ্রেস'। ম্যারাথন রেসে দৌড়বীর যেমন শুরু করে ধীরে ধীরে, প্রথমে তেমনি চলছিল সুদৃশ্য ট্রেনটি। গোচরে আসছিল দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে সকালের কাঁসর ঘন্টাধ্বনি ও স্নানাঘাটে পুণ্যার্জনকারীদের ভীড়। হুগলি ও বর্ধমান জেলার বিমোহিত করা ধানমাঠ। জলের অভাবে অতিকষ্টে ধান রোয়া শেষ করেছিল দেশের প্রধান সম্পদ কৃষকসমাজ। শেষমেশ মৌসুমি জলবায়ুর দয়াদাক্ষিণ্য ও নিম্নচাপের অশেষ কৃপায় প্রতিটি ধানমাঠ এখন যেন মখমলের মতো সবুজ গালিচা পাতা। ঝড় ঝঞ্ঝা এলেও সামলে নেবে কারণ ঘন গোজের ধানগাছ ঢ্যাঙা নয় দৈর্ঘ্যে। মনে পড়ে কৈশোরে সপ্তমী থেকে ঠাকুর দেখা র স্মৃতি কারণ তার আগে জমতোই না গ্রামের পুজো। দূর গাঁয়ে ঠাকুর দেখতে যাওয়া ও আসার পথে বয়সে- বড় জ্ঞাতি ভাই-পো চেনাতো ধান মাঠে বিভিন্ন মাছের ঘাই মারা। তীব্র রোদে, হালকা রোদে ও গোধূলি বেলায় পাল্টে পাল্টে যেত মাছেদের ঘাই মারা। এভাবে শিখেছি কোন্ ঘাইটা কই মাছের কোনটা ভেটকির কোনটা শোলের...
দুর্গাপুর থেকে বদলে গেল দৃশ্যপট। অনেক অনাদর অবহেলায় যেমন বাচ্চারা বেড়ে ওঠে তেমনিভাবে ছোট ছোট খেত থেকে উঁকি দিচ্ছে লিকলিক করা ধানগাছ। বিহারের অনেকটাই তাই।পাটনা-র গঙ্গাও তেমনি, রাজপ্রাসাদ যেমন এক পাশে করে দেয় দুয়োরাণীকে তেমনি গঙ্গায় যেটুকু জল প্রকৃতি ঠেলে দিয়েছে একধারে। খাঁ খাঁ করছে মরুভূমি সদৃশ চর, তাতে প্রশ্ন চিহ্নের মতো পড়ে আছে ভেসে আসা নানা সামগ্রী। পাটনা পেরোতেই ফিরে এল জেলার দৃশ্য অর্থাৎ সবুজে ঠাসা ধানমাঠ। চলল যতক্ষণ না চোখের ওপর মিহিদানা-র মতো অন্ধকার নেমে আসে। জানুয়ারি মাসে যখন 'পূর্বা এক্সপ্রেস' করে এই অঞ্চল পার হই, দেখি মায়াবী রোদ মেখে শুয়ে আছে সোনালি গম খেত। এখন ট্রেন ছুটছে পাগলের প্রলাপের মতো দিশাহীন গতিতে। আশঙ্কা জাগছে তবে কি সময়ের আগেই পৌঁছে যাবে? একবার ভোপাল থেকে ইন্দোর পৌঁছে যাই সময়ের আগেই ভোর না হতেই। সে কী বেচাল অবস্থা। হোটেল মালিকের ঘুম কেন আগে ভাঙিয়েছি, তার জন্য জরিমানা দিতে হয় টাকায়। 'অকাল তক্ত'-ও লক্ষ্ণৈ পৌঁছে গেল সময়ের আগেই। এখানেও সময়ের আগে হোটেলে ঢুকতে অতিরিক্ত চার্জ লাগল ৫০০ টাকা। হোটেলের অবস্থান লক্ষ্ণৌর স্টেশন সংলগ্ন চারবাগ এলাকায়। একটু জিরোবার পর ফ্রেশ হয়ে 'নির্মল প্যালেস' থেকে নিচে নেমে দেখি দোহারা চেহারার হরিশঙ্কর প্রস্তুত। ঘোরাতে নিয়ে যাবে। এতদিন শুধু সরস্বতীপূজোতে অঞ্জলি দিয়ে এসেছি। এই প্রথম আমার সৌভাগ্য হল অষ্টমীতে দেবী দুর্গা কে অঞ্জলি দেওয়ার, তাও সুদূর লক্ষ্ণৌ এসে। কাছেই 'পান্ডরিবাগ দুর্গা পুজা কমিটি' আয়োজিত দেবীর মন্ডপে সুষ্ঠুভাবে হল এই পুষ্পার্ঘ্য। হরিশঙ্করকে যেখানে-ই নিয়ে যেতে বলছি, অবলীলায় ঘাড় নাড়ছে। বিশাল বপুর অটো। খোলামেলা। পাইলট সাহেবকে দেখে মায়া হয়। স্ত্রী মধুমিতা বা শ্বশুর বাড়ির লোকজনদের বক্তব্য গাড়ি নিজের হোক বা তাদের। খুবই যত্ন -আত্তির করতে হয় পাইলট সাহেবের, মানে আমরা যা খাব সে-ও যেন তাই খায়, প্রাপ্য নিয়ে সে যেন এতটুকু অসন্তুষ্ট না হয় কারণ একটাই স্টিয়ারিং যে তার হাতে। অর্থাৎ তার হাতেই আমাদের মরা বাঁচা। হরিশঙ্কর হায়দরগঞ্জের রামলীলা মন্দির, সুদৃশ্য ব্রিজ ও জ্যোতিবা ফুলে উদ্যান পার করে নিয়ে গেল রুমি দরওয়াজা ঢুকে বড় ইমামবাড়া। তার ডানপাশে জামা মসজিদ। ১৭৮৩ খৃষ্টাব্দের মন্বন্তরে প্রজাদের আশ্রয় দিতে ১৭৮৪-তে ইরানি স্তপতি দিয়ে নবাব আসফ-উ- দৌলা তৈরি করান এই ইমামবাড়া। চার তলা বাড়ির নিচ তলায় রয়েছে নবাবদের নানা আকারের তাজিয়া ও নবাব সাহেবাদের সমাধি। মহরম এলে এখানকার সিয়া সম্প্রদায়ের অশেষ আনন্দ। প্রবেশপথে এখনো আয়াতোল্লা খোমেনি সহ আরো চার ধর্মগুরুর ছবি। ৪৫ সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় প্রবেশ। এখানেই শুরু ভুলভুলাইয়ার মহিমা। সরু রাস্তা, গভীর অন্ধকার, মোবাইলের টর্চই সম্বল। বাচ্চার কান্না, হাতড়িয়ে হাতড়িয়ে গাইডকে অনুসরণ ছাড়া গতি নেই। বহু পথ বহু সুড়ঙ্গ পার করে টপ ফ্লেরে পৌঁছেতেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচা, অগাধ আলো, অসাধারণ চারপাশেের দৃশ্য। উত্তরে গোমতী নদী, এপাশে পুরনো লক্ষ্ণৌ, ওপারে নতুন শহর। প্রায় প্রতিটি বাড়ির গায়ে নবাবী আমলের নক্সা। তবে ভুলভুলাইয়া -তে হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি আছে বলে মন হয় না। এতো সংখ্যক গাইডের আনাগোনা! দেওয়ালের গায়ে আস্তে কথা বললে সেটা জোরে শোনা যায়। এত পুরনো বিল্ডিং কিন্তু কোথাও ক্র্যাক নেই। অথচ বাড়ি তৈরির মালমশলা ছিল চুন সুরকি গুড় চিনি মাটি ইত্যাদি..
//এল//