
মলয় চন্দন মুখোপাধ্যায়
জীবনানন্দপাঠের গোড়াতেই চমক লাগে, তাঁর সব কবিতা- ই, দু- একটি ব্যতিক্রম বাদ দিয়ে, সব- ই অক্ষরবৃত্ত ছন্দে লেখা। রবীন্দ্রনাথ এবং তৎপরবর্তী কবিরা যখন অক্ষরবৃত্তের পাশাপাশি মাত্রাবৃত্তের বর্ণিলতায় কবিতা রাঙাচ্ছেন, সেখানে একটিমাত্র ছন্কেই ভাবপ্রকাশের মাধ্যম করে গেলেন তিনি। পাঁচ-ছয়-সাতমাত্রাকে পরখসকরেও দেখতে চাইলেন না, যেখানে তাঁর আক্ষরিক অর্থেই সমবয়সী কবি নজরুল মাত্রাবৃত্তের ফুলঝুরিতে ভরিয়ে দিয়ে গেছেন বাংলা কবিতার ফিরোজা আকাশ।
নজরুলের মাত্রাবৃত্তে আবার দেখি ছ-মাত্রার পক্ষপাতিত্ব ও প্রাচুর্য, যদিও তিনি অক্ষরবৃত্ত এবং স্বরবৃত্তেও পর্যটনপ্রিয়। আশ্চর্য, জীবনানন্দের প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'ঝরাপালক' যদিও বিস্তৃতাংশে নজরুলের ছায়াপাতে রঞ্জিত, তবু ছন্দের ক্ষেত্রে তিনি নজরুলের বৈভবকে সরিয়ে রেখে অক্ষরবৃত্তের প্রতি- ই আনুগত্য ও সৌহৃদ্য দেখিয়ে গেছেন।
স্বরবৃত্তে তিনি কিছুই লিখলেন না। মূলত ছড়ার ছন্দ এটি। অতএব তাঁর কোনো ছড়া নেই। সেইসূত্রে শিশুসাহিত্য, শিশুতোষ কবিতা, গল্প-উপন্যাসের তো প্রশ্ন- ই ওঠে না, নেই তাঁর। অর্থাৎ প্রথম থেকেই তিনি তাঁর আয়ুধ ঠিক করে কাব্যে নেমেছেন- একটি যে তার, কেবল সেইটি বাজাবেন। নইলে রবীন্দ্রনাথ নজরুল সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, এমন কি তাঁর সময়কার প্রতিনিধিস্থানীয় সব কবি-ই যখন ছড়া লিখছেন দুর্নিবার, আমরা অন্নদাশংকরকেও মনে রাখবো, বাদ দেবো না জীবনানন্দের মেন্টর বুদ্ধদেব বসুকেও, তখন একমেবাদ্বিতীয় একটিমাত্র কুঠারে তিনি কাব্যসিদ্ধির এমন শীর্ষবিন্দুতে পৌছলেন, যাতে করে আধুনিক বাংলা কবিতায় শেষবিচারে যে প্রমুখ এবং আশিরনখর পাঁচজন কবি দাঁড়ান, তাঁদের অন্যতম হয়ে ওঠেন। এঁরা হলেন মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল, সুকান্ত ও তিনি,-এক স্বভাবত স্বতন্ত্র কবি, যাঁকে অনুকরণের চেষ্টা করেছেন বহু, সমর্থ হন নি কেউ। জানি, পাঁচজন কবি উচ্চারণটা দায়ে ফেলবে আমাকে। দায়মুক্তির প্রয়াস- ও থাকবে লেখাটির অন্তিমে।
জীবনানন্দ আদ্যন্ত রহস্যময়। রহস্যময়তা তাঁর এতো এতো লেখা ও তা না ছাপানোয়, যদিও দারিদ্র্য তাঁকে ঘরে সাবলেট নিতে বাধ্য করছে। আজকের কোনো কবি এই বিধুরতার কথা ভাবতে পারবেন? সাবলেটের অর্থ একটিমাত্র বাথরুম তাঁর স্ত্রী ও কন্যার সঙ্গে সেই অচেনা মানুষটিও ব্যবহার করবেন, ভাবা যায়! অথচ একটি দুটি না, খান চৌদ্দ উপন্যাস, একশোর মতো গল্প বাক্সে পড়ে আছে লিখিত হয়ে, যেগুলো প্রকাশিত হলে অর্থাগম তো হতোই, জীবিতাবস্থায় তাঁকে নিয়ে তোলপাড় দেখে যেতে পারতেন তিনি। পড়ে আছে 'রূপসী বাংলা'- সহ অসংখ্য কবিতা, যেসবের প্রকাশ ঘটবে তাঁর মৃত্যুর ঢের পরে, আর কিছু কিছু চিরতরে হারিয়ে যাবে বাক্সবন্দী সেই লেখাগুলো নিয়ে তাঁর কন্যার অন্যমনস্ক ট্রেনভ্রমণে! লন্ডনে ট্রেনের কামরায় রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলির ইংরেজি পাণ্ডুলিপি হারিয়ে গেলেও তা পুনরুদ্ধার হয়। জীবনানন্দের হয়নি। History repeats itself , কথাটা যদি সত্যি হতো!
জীবনানন্দের রহস্য তাঁর ডায়েরিতেও। একাধিক নারীর নাম আছে সেখানে, যাঁদের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক ছিল তাঁর। বিভূতিভূষণের ডায়েরিতে দু: সাহসিকভাবে তাঁর সঙ্গে খুকু এবং সুরমার সঙ্গে তাঁর গান্ধর্ব সম্পর্ক উঠে এসেছে। জীবনানন্দ এমনকি নামটি পর্যন্ত হেঁয়ালির ভাষায় লিখে রেখেছেন। গোপনতাই যদি কাম্য, তবে এই মোহিনী আড়াল কেন? উল্লেখ না করলে ক্ষতি ছিল? রহস্য, রহস্য !
সারাজীবনে বন্ধু বলতে যা বোঝায়, তা তিনি পান নি। চান নি বলেই। এমন কি যে বুদ্ধদেব বসু বা সঞ্জয় ভট্টাচার্য তাঁর পৃষ্ঠপোষক, তাঁদের সঙ্গেও কি প্রকৃত অন্তরঙ্গতা ছিল তাঁর? কতোবার কতো কলেজে পড়িয়েছেন, কলকাতা, হাওড়া, বরিশাল, দিল্লি ও আরো কতো জায়গায়। কোনো কলিগ বা ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল কি তাঁর, কখনো? রহস্য তো এখানেও।
তবু সব বিচার শেষে, সব নদী ও পাখি যখন ঘরে ফেরে, থাকেন শুধু জীবনানন্দ আর তাঁর অবিনাশী গ্রন্থরাজি, উদ্ভাসিত পুলক ও বিস্ময় নিয়ে পাঠ করতে হয় তাঁকে।
অক্ষরবৃত্ত তথা পয়ার জীবনানন্দের প্রিয় হাতিয়ার। তিনি কখনোই অমিত্রাক্ষরের দিকে যান নি। অন্ত্যমিল ছাড়েন নি কখনো। রবীন্দ্রনাথ -নজরুল- সুকান্ততেও মধুসূদনের অন্ত্যমিলহীনতার পরম্পরা দেখি না। তাঁদের গদ্যছন্দতে নিপুণতা বিস্ময়কর (সুকান্ত তাঁর স্বল্পস্থায়ী জীবনেও কিন্তু গদ্যছন্দে অনবদ্যতা দেখিয়েছেন। আবার 'কাশ্মীর' কবিতাটি তিনি একবার ছয়মাত্রার মাত্রাবৃত্তে লিখলেন, ফের গদ্যছন্দে )। রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি গানে অন্ত্যমিলহীনতা লভ্য। জীবনানন্দ আদ্যন্ত অন্ত্যমিলনির্ভর। আর পয়ারেও তৃপ্তি পান নি তিনি, মহাপয়ার, মহা মহাপয়ারের মতো দীর্ঘশ্বাসী কবিতা না লিখে তৃপ্তি পেতেননা তিনি। নজরুল ও সুকান্ত মহাপয়ারে অতোটা স্বচ্ছন্দ ছিলেন না। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন, তবে কম। রবীন্দ্রনাথের সনেট চৌদ্দ অক্ষরের - ই অনুগত থেকেছে অধিকাংশ সময়ে। জীবনানন্দের সনেট, 'রূপসী বাংলা '- সহ অন্য উদাহরণেও দেখা যাবে, চৌদ্দ অক্ষরে সীমাবদ্ধ হতে চায় নি, খুঁজেছে আরো ব্যাপ্ত পরিসরের অবকাশ।এই লম্বা ডানাটি বাংলার নীলিমাকে ষড়ৈশ্বর্যসমেত উপলব্ধির সহায়ক ছিল তাঁর পক্ষে, এটাই আমাদের বিশ্বাস।
'চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা ' (আঠারো অক্ষরের মহাপয়ার) অথবা 'আমরা হেঁটেছি যারা নির্জন খড়ের মাঠে পউষসন্ধ্যায়' (বাইশ অক্ষরের মহা মহাপয়ার ) এর মধ্যে কবিতার বীর্যধারণক্ষমতা প্রতিফলিত। অর্থাৎ ভাব ও তাকে বিলম্বিত লয়ে শব্দে শব্দে গ্রথিত করার কবিশক্তি অভাবিত পরিমাণে না থাকলে এ জিনিশ সম্ভব নয়। দীর্ঘ একটি কবিতা, যেখানে শব্দে - ছন্দে - ভাবে ও আনুষঙ্গিক আরো বহুতর কারুকৃতিতে রসাত্মক বাক্য হয়ে ওঠে কাব্য, তাকে দীর্ঘবলয়িত করার লেখনী কেবল একজন লেভিয়াথানের , অন্য কারো নয়। জীবনানন্দ সেই কালপুরুষ, - ক্ষণজন্মা, কবিতার অণু - পরমাণুবেষ্টন যাঁর সর্বাঙ্গে, আর কবিতালেখার সামান্য কিছু তূণীর ও কন্দুকে যিনি চিরজীবী কবির্মনীষী।
আমরা কি জীবনানন্দের কবিতায় অন্ত্যমিলের স্বকীয়তায় একটু মনোনিবেশ করতে পারি? অন্ত্যমিল বাংলা কবিতার ঊষাকাল সেই চর্যাপদের-ই সমবয়সী। অবাক কাণ্ড! সুবিপুল সংস্কৃতসাহিত্যে বা তার পূর্বসূরি বৈদিক সাহিত্যে অন্ত্যমিল দুর্লভ। আছে কেবল শঙ্করাচার্যে, জয়দেবে। বাংলা কবিতায় অন্ত্যমিল উড়ে এসে জুড়ে বসলো প্রাকৃতের হাত ধরে, এবং টানা রাজত্ব করে গেল প্রাক্ - মধুসূদন পর্যন্ত। এমনকি মধুসূদন - ও কিন্তু অন্ত্যমিল দিয়ে কবিতা লিখেছেন , 'মেঘনাদবধ ' - এর আগে ও পরে, বিশেষ করে সনেট রচনা করতে গিয়ে।
চর্যাপদ - মঙ্গলকাব্য - বৈষ্ণবপদাবলী - ভারতচন্দ্র হয়ে আধুনিককালের যাত্রাপথে অন্ত্যমিলের বিপুল প্রবাহ ও বৈচিত্র্য নিয়ে গবেষণা সম্ভব। এখানে তার স্থান নেই। তবে কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করতে হবে আমাদের , জীবনানন্দ - ব্যবহৃত অন্ত্যমিলের অনন্যতা - স্বাতন্ত্র্য বোঝাতে।
1. মহাভারতের কথা অমৃতসমান।
কাশীরাম দাস কহে , শুনে পুণ্যবান।।
2. দু:খ করো অবধান দু:খ করো অবধান।
জানু ভানু কৃশাণু শীতের পরিত্রাণ।।
3. মন্দির বাহিরে কঠিন কপাট/
চলয়িতে শঙ্কিত পঙ্কিল বাট।/
তাহে অতি দূরতর বাদল দোল /
বারি কি বারই নীল নিচোল? /
সুন্দরী কৈছে করবি অভিসার , /
হরি রহুঁ মানস সুরধুনিপার।
4. লতামউ প্রভৃতি রাঢ়ের সরু চালু / রসে গন্ধে অমৃত আপনি আলুথালু / অন্নদার রন্ধন ভারত কি বা কয় / মৃত হয় অমৃত অমৃত মৃত হয়।
5. রেখো মা দাসেরে মনে -----
6. পঞ্চনদীর তীরে-----
ওপরের ছটি উদাহরণে যে অন্ত্যমিলগুলো রয়েছে , তাতে কবিকে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায় চিহ্নিত করা যায়। কাশীরাম দাসের অভিপ্রায় কারিগরের; চমৎকারিত্ব বা কবিত্বের অভীপ্সাবর্জিত পদ্যমাত্র। দ্বিতীয়টিতে চণ্ডীমঙ্গলকার অন্ত্যমিলের সঙ্গে বিবেচনায় রাখছেন রসসৃষ্টি আর শব্দকে , ওয়ার্ডসওয়ার্থের ভাষায় তার Best form - এ দাঁড় করাতে, আর অল রাউন্ডারের মতোই অন্ত্যমিলটির দায়বদ্ধতাকে মাথায় রাখছেন তিনি। শব্দধানুকী মুকুন্দরাম তাঁর কবিতায় 'তৈল তুলা তনূনপাত '- কেও নিয়ে এসে সম্ভ্রান্ত স্থান দিতে পারেন মধুসূদনের 'যাদ:পতিরোধ: যথা চলোর্মি আঘাতে '- র ঢের আগে, ' এবং রবীন্দ্রনাথের জ্বলদর্চিরেখা '- র ঢের ঢের আগে।
পরের কবিতাংশটি বৈষ্ণবকবি গোবিন্দদাসের। অন্ত্যমিল ও কবিত্বের বৈভব এখানে দ্বেবেণীসঙ্গম রচনা করেছে।কপাট / বাট, বাদল দোল / নিচোল অভিনব শব্দের মাধ্যমে যে অভিনবত্ব আনলেন তিনি, তার চূড়ান্ত বিন্দু পৌঁছলো গিয়ে পরের দুটি পঙকতিতে।এখানে অন্ত্যমিল তো বাহিরসজ্জা, রসসৃষ্টি রূপ নিল উত্তুঙ্গ নান্দনিকতার। সুন্দরীর অভিসার বর্ষারণ্যে ব্যাহত। তাই রাধা ও কৃষ্ণের দূরত্ব , বাস্তব ও মানসিক দূরত্ব, এখন বহু। কৃষ্ণ এখানে আর অতএব কৃষ্ণ নয় ,-- দূরত্বসঞ্জাত হরি। আমরা অন্ত্যমিল যে সাধারণ থেকে বিস্ময়করতায় পৌঁছতে পারে, দেখলাম।
পরের কবিতায় দক্ষ কবি ভারতচন্দ্র 'চালু' আর ' আলুথালু ' এনে দায় সারলেন। কিন্তু গতানুগতিক - ও যে অবিনশ্বর কবিতার কুসুম ফোটাতে পারে , কবিতাকে স্বর্গীয় করে তুলতে যে অন্ত্যমিলের জন্য হন্যে হতে হয় না, সামান্য কয়/ হয় দিয়েই তা সম্ভব , তা দেখালেন। কবিসিদ্ধি একেই বলে।
পরের কবিতাংশ মধুসূদন ও রবীন্দ্রনাথের। অন্ত্যমিলের ছড় ড়া এনেছেন একেবারে। মধুসূদন কবিতাটিতে পদে / কোকনদে / জীবননদে / অমৃতহ্রদে / শ্যামা বরদে / সুবরদে / কি শরদে এনেছেন। একটু ক্লান্ত করে বৈকি, নিজ কবিত্বের প্রতি অবহেলা - ও দেখিয়েছেন। ' শবদে শবদে বিয়া ' -র ঘটক হিশেবে করতালি পাবেন না। ঠিক তেমনি রবীন্দ্রনাথ: শিখ / নির্ভীক / দিক / নির্ণিমিখ , অথবা অলখনিরঞ্জন / ভয়ভঞ্জন / ঝনঝন / এবং ভাবনাহীন, এসব অন্ত্যমিলপ্রয়োগে একরকম ব্যায়াম করে গেছেন মাত্র । তবে হ্যাঁ, মহান প্রতিভার ব্যায়াম নি:সন্দেহে।
এর পাশাপাশি জীবনানন্দের কবিতার অন্ত্যমিলের প্রতিতুলনায় যাবো আমরা। সর্বপ্রথম যেটি লক্ষ্যণীয়, তাঁর অন্ত্যমিল অধিকাংশ সময়েই ফল্গুধারাসদৃশ, নীরব, অন্তশ্চারী, সহসা অনুভবগম্য নয়, যেন তাঁর প্রিয় ঋতু হেমন্তের মতোই আলতো পরশের।
' মৃত্যুর আগে' কবিতাটিকে উদাহরণ হিশেবে নেওয়া যাক। অন্ত্যমিলকে পাঠকের কাছে আবডালে রাখতে তিনি কগখঘ রীতি আনছেন , আবার পাঠক তা ধরে ফেলা মাত্র ঙচ! আর মিল দিচ্ছেন সমমাত্রিক শব্দের সঙ্গে অসমমাতৃকের , - ফুল / ধুন্দুল , শিয়রে / তরে , ভালো / হারালো , সঞ্চার / ভাসাবার ,বক / কুহক।
অন্ত্যমাল রাখছেন, কিন্তু তাতে মনোযোগী হতে দিচ্ছেন না পাঠককে। প্রয়শ বিশেষ্যের সঞ্গে সর্বনাম , ক্রিয়ার সঙ্গে বিশেষণের মিল আনছেন, অন্ত্যমিল - অমনস্ক হয় যেন পাঠক।কোথায় ছিলেন / বনলতা সেন, বা ' গোধুলিসন্ধির নৃত্য ' কবিতায় ' কয়েকটি নারী যেন ঈশ্বরীর মতো / পুরুষ তাদের ; কৃতকর্ম নবীন; / খোঁপার ভিতরে চুলে ; নরকের নবজাত মেঘ, / পায়ের ভঙ্গির নিচে হঙকঙের তৃণ '। নবীন / তৃণ মিশছে যখন, পাঠক টের - ই পাচ্ছেন না। অর্থাৎ অন্য কবিদের যেমন দেখানোপনা, জীবনানন্দের লোকিনোপনা। এই লুকানোপনার জন্য মহাপয়ার, মহা মহাপয়ার প্রশস্ত। এই জন্যই কি তিনি?
অন্ত্যমিল রাখছেন, আবার এক - ই কবিতায় বাদ - ও দিচ্ছেন। এটা বোঝাতে, কবিথার আদিতে, মধ্যে ও অন্থে অন্ত্যমিল দিতেই হবে , এমন কোনো দিব্যি দেয়নি কোনো ছান্দসিক। তাঁর বিখ্যাত কবিতা ' আট বছর আগে ' - র ' উটের গ্রীবার মতো কোনো এক নিস্তব্ধতা এসে ' অন্ত্যমিলের দোসরহীন। আরো। ' চারিদিকে মশারির ক্ষমাহীন বিরুদ্ধতা।' রয়েছে আরো। এবং তার পরিপূরণ ঘটাতেই যেন কবিতাটির অন্যত্র অন্ত্যমিল - আধিক্য , যেমন আর / বেদনার / ভার , জাগে / মাগে / অনুরাগে , জীবন / মন / শিহরণ, চমৎকার / এবার / সমাচার, চমৎকার / পার / ভাঁড়ার। এই বৈচিত্র্য- ই জীবনানন্দের অনন্যতা।
আধুনিক কবিপঞ্চক মধুসূদন রবীন্দ্রনাথ জীবনানন্দ নজরুল এবং সুকান্ত। কোন্ বিচারে?
প্রথমত এঁরা জীবনে বহুতর কাজে লিপ্ত থেকেও কাব্যরচনার পাদপীঠে আসীন ছিলেন সর্বদা। তাই নাটকীয়তাময় জীবন আর ভাগ্যতরীকে একূল ওকূল দুকূলে ভাসিয়েও মধুসূদন কবিতার বৈঠা ছাড়েন নি। কবিতার চেয়ে অনেক বেশি প্রবন্ধ লিখে, অনেকানেক সময় জমিদারির পেছনে ব্যয় করেও রবীন্দ্রনাথ কবি। অভিনেতা - রাজনীতিকরিয়ে ও আরো অজস্র কর্মে নিয়োজিত থেকেও নজরুল আশিরনখর কবি। অধ্যাপনা ( সব মিলিয়ে কুড়ি বছরের অধিক সময় তিনি অধ্যাপনা করেছেন) , বেকারত্ব , সব একদিকে আর অন্যদিকে কাব্যজগতকে পাখির চোখ করে রেখেছিলেন জীবনানন্দ, আর সুকান্ত, তিনিও সব কর্ম -অবসানে একজন কবি- অন্তপ্রাণ।
দ্বিতীয়ত, সংস্কৃত আলঙ্কারিকেরা 'অপূর্বনির্মাণক্ষমা' বলে একটি মোক্ষম বৈশিষ্ট্য আরোপ করেছেন কবি হওয়ার আবশ্যিক শর্তরূপে। অপূর্ব, যা পূর্বে কখনও ছিল না, তা আনতে পারলেই তাঁকে কবি বলা হবে। এই পাঁচ কবিতে তা ব্যাপকভাবেই আছে।
অন্তিম বিচারে বলা যায়, কবিদের কাব্য আদ্যন্ত পাঠ্য, বারবার না পড়ে তৃপ্ত হয় না পাঠক। যুগ যুগ ধরে প্রাসঙ্গিক তাঁরা, যেমন কালিদাস, শেকসপীয়ার, গ্যেটে, ওমরখৈয়াম, বোদলেয়ার। আমাদের আলোচ্য কবিরা, বিশেষ করে আজ যাঁকে নিয়ে আলোচনা সেই জীবনানন্দ- ও বিগ ব্যাঙ-এর মতো ক্রমপ্রসারিত হচ্ছেন।
আর হ্যাঁ, কবি তাঁরা, নির্বিচারে যাঁদের সমস্ত কবিতার মধ্যেই গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। নির্বাচন করে পাঠ করা যায় না এঁদের কবিতা, কেননা প্রতিটি কবিতা এঁরা রচনা করেন দৈবী অনুভব আর মরমী অভিপ্রায় থেকে, গহন মন ছাড়া যা হয় না। অতএব প্রকৃত কবিরা আদ্যন্ত পাঠ্য।
//জ//