
ছবি। বিধ্বস্ত প্রশিক্ষণ বিমান...
২১ জুলাই (মঙ্গলবার) উত্তরার প্রশিক্ষণ বিমান দুর্ঘটনায় ঘটনাস্থল থেকে শুরু করে বিভিন্ন হাসপাতালের মর্গে বিভীষিকাময় এক দিন কাটিয়েছেন সাংবাদিক মারিয়া সালাম। একজন পেশাদার সংবাদকর্মী হিসেবে সংবাদের তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়েও, মানবিকতার গভীরে প্রবেশ করে তিনি উপলব্ধি করেছেন এমন পরিস্থিতিতে সংবেদনশীলতার গুরুত্ব। শোকাহত স্বজনদের বুকফাটা আহাজারি এবং কয়লার মতো পুড়ে যাওয়া শিশুদের সারি সারি মৃতদেহ দেখে একজন সাংবাদিক হিসেবে তিনি এমন এক দ্বন্দ্বে পড়েছেন, যেখানে পেশাদারিত্ব ছাপিয়ে মানবিক আবেগ প্রাধান্য পাচ্ছিল। তাঁর ফেসবুক পোস্টে উঠে এসেছে সেই হৃদয়বিদারক অভিজ্ঞতা।
মারিয়া সালামের বর্ণনায়, দিনের শুরু থেকেই তিনি এমন এক পরিস্থিতির মুখোমুখি হন, যেখানে সংবাদ সংগ্রহের কঠিন দায়িত্বের পাশাপাশি মানুষের প্রতি সংবেদনশীল থাকাটা জরুরি ছিল। ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের বাইরে স্বজনদের আহাজারি ছিল অসহনীয়। একজন মা বিলাপ করে বলছিলেন, তাঁর ছেলের সামান্য টোকা লাগলে যে ব্যথা তাঁর নিজের শরীরে অনুভূত হতো, আজ সেই ছেলের সমস্ত শরীর, এমনকি চুলটুকুও পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এমন হৃদয়বিদারক দৃশ্যে সাংবাদিকদের জন্য ক্যামেরা তাক করা অসম্ভব হয়ে ওঠে। মারিয়া সালাম অনুভব করেন, এমন চরম শোকের মুহূর্তে প্রশ্ন করার সাহস তাঁর হয়নি, বরং তাঁদের পাশে দাঁড়ানোর এক অবর্ণনীয় তাড়না অনুভব করেছেন। একজন মা হিসেবে অন্য সন্তানহারা মায়ের যন্ত্রণা অনুভব করা তাঁর কাছে স্বাভাবিক ছিল।
শোকের মাঝে রাজনীতির ফটোসেশন
দুর্ঘটনার পর পরই ঘটনাস্থলের বাইরে শোক প্রকাশের নামে শুরু হয় এক ধরনের ফটোসেশন। শত শত ক্যামেরা তাক করা হয় 'ভাগ্য বিধাতাদের' দিকে, যারা শত শত নেতা-কর্মী নিয়ে শোক প্রকাশ করতে এসেছিলেন। মারিয়া সালামের মনে প্রশ্ন জাগে, এই পরিস্থিতিতে অসংখ্য প্রশ্ন করার সুযোগ থাকলেও আগুনে ঝলসে যাওয়া এক শিশুর মুখের ছবি তাঁর স্মৃতিতে ভেসে ওঠে। সেই শিশুটি একাকী নগ্ন দেহে প্রাণ বাঁচাতে দৌড়াচ্ছিল, যার মুখ তাঁর নিজের সন্তানের মতো মনে হয়েছিল। এই দৃশ্য তাঁকে এতটাই আবেগপ্রবণ করে তোলে যে তিনি নীরবতা অবলম্বন করেন এবং কোনো প্রশ্ন না করে স্থান ত্যাগ করেন। মানবিক বিবেচনাবোধ তাঁকে এমন পরিস্থিতিতে ছবি তোলা বা প্রশ্ন করার অনুমতি দেয়নি।
মর্গে মর্গে অচেনা শিশুদের সারি
বিকাল গড়াতেই মারিয়া সালাম পৌঁছান কুর্মিটোলা মর্গে। সেখানে দুটি শিশুকন্যার জড়াজড়ি করা দেহ একই ব্যাগে রাখা ছিল। তাদের স্বজনদের তখনো কোনো খোঁজ মেলেনি। সকালে যারা স্কুলের মাঠে বন্ধুদের সাথে উচ্ছ্বাসে ছুটছিল, বিকেলে তারাই অজ্ঞাতনামা হয়ে মর্গে পড়ে আছে। পুলিশ সদস্যরা প্রথমে সহানুভূতিশীল হলেও, মারিয়া সালাম পেশাগত পরিচয় দেওয়ার পর কিছুটা রূঢ়ভাবে তাঁকে সেখান থেকে চলে যেতে বলেন। শিশু দুটিকে পরে সিএমএইচ মর্গে পাঠানো হয়। এই শিশুদের অকালমৃত্যু তাঁকে গভীরভাবে ব্যথিত করে।
জেটের তীব্র গন্ধ আর মৃত্যুর বিভীষিকা
অন্ধকার নামার আগেই মারিয়া সালাম সিএমএইচ মর্গের সামনে গিয়ে দাঁড়ান। বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে একে একে মরদেহ এসে সেখানে জমা হচ্ছিল। প্রতিটি মরদেহের গায়ে ছিল জেট ফুয়েলের তীব্র গন্ধ, যা পুরো মর্গকে যেন এক বিশাল ফুয়েল স্টোরেজে পরিণত করেছিল। সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতার সেই 'দেশলাইয়ের কাঠি'র মতো, এই মৃত্যুর বিভীষিকা যেন শহর থেকে গ্রাম, দিগন্ত থেকে দিগন্তে ছড়িয়ে পড়ার ভয় তাঁকে গ্রাস করে।
সেখানে একজন মা বিলাপ করছিলেন, বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার সাথে সাথেই জ্বালানি ছড়িয়ে পড়ার কারণে তাঁর ছেলে দগ্ধ হয়েছে। মর্গের দরজার দিকে তাকিয়ে তিনি বিড়বিড় করে বলছিলেন, "কুটু, কুটু, তোমার কি কষ্ট হচ্ছে বাবা?"
পার্কিং লটে গিয়েও শান্তি মেলেনি। সেখানে এক তরুণ মাটিতে বসে আহাজারি করছিল, "ও মা, যখন আগুন লেগেছে, তখন কি তোমার অনেক যন্ত্রণা হয়েছে, তুমি কি ভয় পেয়েছিলা আমার পুতুল? মাকে খুঁজেছিলা?" এই তরুণ ছিলেন লিওন মীর, যার ভাগনি ওই দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিল। মারিয়া সালাম অনুভব করেন, এই ধরনের পরিস্থিতিতে শুধুমাত্র সংবাদ সংগ্রহ নয়, শোকাহত মানুষের প্রতি সহানুভূতি জানানোও একজন সংবাদকর্মীর মানবিক দায়িত্বের অংশ।
হৃদয় বিদারক মরদেহ হস্তান্তর
একসময় শুরু হয় মরদেহ হস্তান্তরের প্রক্রিয়া। সংখ্যা মিলিয়ে, হিসাব কষে ছোট্ট দেহগুলো স্বজনদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। মারিয়া সালামের মনে প্রশ্ন জাগে, এই ছোট্ট শরীরগুলোকে স্বজনরা কীভাবে গোসল করাবেন, কীভাবে কাফনের কাপড় পরাবেন?
পাশেই কান্নাকাটির শব্দ শুনে তিনি দেখেন আরেক ভদ্রলোক এসেছেন স্ত্রীর মরদেহ খুঁজতে। তাঁর স্ত্রী ছেলেকে স্কুল থেকে আনতে গিয়ে মারা গেছেন, আর দগ্ধ ছেলে হাসপাতালে কাতরাচ্ছে। স্বজনরা লোকটিকে ধরে গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়। ঘন অন্ধকারে দাঁড়িয়ে মারিয়া সালাম সেই দৃশ্য দেখেন। ক্যামেরা ব্যাগে থাকলেও, এই দৃশ্য ধারণ করার মতো সাহস তাঁর হয়নি। একজন সাংবাদিক হিসেবে এমন পরিস্থিতিতে তিনি নিজেকে 'অকেজো' অনুভব করেন। এই পুরো অভিজ্ঞতা মারিয়া সালামের মানবিকতাকে নতুন করে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে এবং তাঁকে মনে করিয়ে দিয়েছে যে সংবাদ সংগ্রহ যতই গুরুত্বপূর্ণ হোক না কেন, মানুষের প্রতি সহানুভূতি ও সংবেদনশীলতা তার চেয়েও বেশি মূল্যবান।
মূল লেখাটি পড়তে ক্লিক করুন: এখানে
ইউ