
ছবি: উইমেনআই২৪ ডটকম
আজ দেশের বহুত্ববাদী সংস্কৃতি, বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী, ভিন্নমতাবলম্বী মানুষ, জাতীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, এমনকি মহান মুক্তিযুদ্ধকেও পদদলিত করার অপচেষ্টা ক্রমান্বয়ে সুস্পষ্ট হয়ে উঠছে। তারা জাতীয় সংগীত ও সংবিধানকে নস্যাৎ করার ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে। আজকে ভিন্ন রাজনৈতিক পরিচয়ের মানুষ ভয়াবহ বিপদের মুখে। দেশের বিভিন্ন স্থানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের মাধ্যমে পাবলিক মব তৈরি করে প্রকাশ্যে মাজার ভাঙা হচ্ছে, ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে, রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে পিটিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। নানা ধরনের প্রপাগাণ্ডা চালিয়ে দেশের মধ্যে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা চলছে।"
শনিবার (২ জুলাই) বিকাল সাড়ে ৪টায় বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগাষ্ঠীর আয়োজনে "বাংলাদেশ গণঅভ্যুত্থান: প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি" শীষক সেমিনারে উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সাধারণ সম্পাদক অমিত রঞ্জন দে এ কথা বলেন।
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সেমিনার কক্ষে (জাতীয় নাট্যশালার ৬ষ্ঠ তলা) অনুষ্ঠিত হয় এ সেমিনার। এতে সভাপতিত্ব করেন উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সহ-সভাপতি মাহমুদ সেলিম।
সেমিনারে মূল প্রবন্ধে অমিত রঞ্জন দে বলেন, "এ ভূখণ্ডের মানুষ অজস্র গণআন্দোলনের ও সংগ্রামের মধ্যদিয়েই আজকের এ পর্যায়ে এসে উপনীত হয়েছে। তাকে সামন্ত প্রভুদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়েছে, লড়তে হয়েছে জমিদার-জোতদার, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। লড়াই করতে হয়েছে ভাষার জন্য, বাংলা নামের দেশটি প্রতিষ্ঠার জন্য, একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য লড়তে হয়েছে পাকিস্তানি স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে, লড়তে হয়েছে বা হচ্ছে বৈষম্য থেকে মুক্তির জন্য। এই লড়াই বা আন্দোলনসমূহ কখনো কখনো রূপ নিয়েছে গণঅভ্যুত্থানে।"
লিখিত প্রবন্ধে এ ভূখণ্ডের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকটি গণঅভ্যুত্থানের উল্লেখ করে উদীচীর সাধারণ সম্পাদক বলেন, "১৯৬৯ সালের গণঅভ্যূত্থান পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে স্বাধিকার চেতনায় জাগ্রত করে তোলে। গণঅভ্যূত্থানের ফলে জনগণের মধ্যে যে স্বৈরাচারবিরোধী মানসিকতা গ্রোথিত হয় তা বাকস্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার জন্য সর্বস্ব ত্যাগের পথে পরিচালিত করে। জাতি ঝাঁপিয়ে পড়ে ১৯৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধে এবং লাখো শহীদের আত্মদানের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করে ছাড়ে। এদেশের মানুষ বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দঁড়ানোর সুযোগ পায়। "
১৯৯০ এর গণঅভ্যুত্থানের প্রসঙ্গে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, "আজ ৯০ এর গণঅভ্যুত্থানের সাড়ে তিন দশক পর যখন মূল্যায়ন করা হয় তখন সুস্পষ্টরূপে প্রতিভাত হয় যে সে গণঅভ্যুত্থানের প্রত্যাশার তিলার্ধ পরিমাণ প্রাপ্তি জনসাধারণের হয়নি। লাভ-লোভে মোহবিষ্ট রাজনৈতিক দলসমূহ এবং তাদের নেতা-কর্মীদের সীমাহীন অন্যায়ে ম্লান হয়ে গেছে গণঅভ্যুত্থানের প্রত্যাশা। শ্রমজীবী মেহনতী মানুষের লড়াই-স্বপ্নের এবং জনসাধারণের আত্মত্যাগের অপমৃত্যুর মাধ্যমে বেঁচে আছে ৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের ফসিল।"
সবশেষ ২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থান প্রসঙ্গে উদীচীর সাধারণ সম্পাদক লিখিত প্রবন্ধে উল্লেখ করেন, "বাংলাদেশের ইতিহাসে চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ছাত্র-শ্রমিক-জনতার সম্মিলিত সে অভ্যুত্থানে পতন হয়েছে দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে চলা আওয়ামী লীগের স্বৈরাচারি শাসনের। কোটা সংস্কারের দাবিকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া আন্দোলন, সরকারের আইন-শৃক্সখলা বাহিনী, সরকারি সংগঠন এবং প্রশাসনের দমন-পীড়নের কারণে এক পর্যায়ে রূপ নেয় সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনে যার পটভূমি আওয়ামী সরকার নিজেই তৈরি করে রেখেছিল।"
এতে আরো বলা হয়, "আওয়ামী লীগ সরকারের কর্তৃত্ববাদী প্রবণতা ও স্বৈরাচারী আচরণ অতিতের সকল রেকর্ড ছাপিয়ে যায়। একদিকে চলতে থাকা সীমাহীন দুর্নীতি, প্রশাসনের সর্বত্র দলীয়করণ-আত্মীকরণ, সাধারণ জনগণের উপর দলীয় কর্মীদের খবরদায়িত্ব, লুটপাট, অর্থ পাচার, ঋণ খেলাপী, ব্যাংক জালিয়াতি, দলীয় লেজুড়বৃত্তি, সর্বত্র তোষামোদী-চাটুকারিতা, টেন্ডারবাজি যেভাবে অতিসাধারণ-স্বাভাবিক এবং ক্ষেত্রবিশেষে নিয়মের বিষয় হয়ে উঠেছিল তাতে দেশের মানুষের মধ্যে অসন্তোষ-হতাশা এবং ক্ষোভ ধীরে ধীরে জমাট বাঁধছিল। আর অন্যদিকে নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি জনজীবনকে দুর্বিসহ করে তোলে।" "সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা পুনরায় চালু করার বিরুদ্ধে ছাত্র-ছাত্রীরা রাস্তায় নেমে যে সংগ্রাম শুরু করেছিল সেই সংগ্রামই বৈষম্য বিরোধী এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে সরকার বিরোধী আন্দোলনে পরিণত হয়। মাত্র দুই-তিন সপ্তাহের মধ্যে এই সংগ্রামই দাবানলের মত জ্বলে ওঠে। দীর্ঘদিনের অন্যায়, অবিচার, দম্ভ, মানুষের প্রতি অবজ্ঞাসহ নানা কারণে পূঞ্জিভ‚ত ক্ষোভের বহি:প্রকাশ ঘটতে থাকে। এই বিক্ষোভ দ্রুতই গণবিক্ষোভে পরিণত হয়। অবশেষে ৫ আগস্ট সরকার পিছু হটতে বাধ্য হয় এবং শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়।"
লিখিত বক্তব্যে অমিত রঞ্জন দে আরো বলেন, "আন্দোলনের নেতৃত্ব দানকারী, অংশগ্রহণকারী ও আন্দোলনের সুবিধাভোগীদের মধ্যে নানামাত্রিক দ্বন্দ্ব ছিল এবং এখনো আছে। এই আন্দোলনে প্রগতিশীল শক্তি যেমন ছিল তেমনি সাম্প্রদায়িক ভাবাদর্শ ও সাম্রাজ্যবাদের প্রভাবও ছিল। আন্দোলন শেষে সাম্প্রদায়িক ভাবাদর্শ এবং সাম্রাজ্যবাদের প্রভাব বলয় সম্প্রসারিত হচ্ছে। এদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে অসহিষ্ণু বা নিপীড়ক একেকটা পক্ষ আবির্ভূত হচ্ছে। তারাও ক্ষমতাচ্যুত সরকারের ন্যায় মানুষের মতপ্রকাশে বাধা তৈরি করছে, সহিংসতা সৃষ্টি করছে, সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস চালাচ্ছে। এদের দাপটে এবং দেশের ভঙ্গুর আইনশৃঙ্ক্ষলা ব্যবস্থা, নাজুক প্রশাসনিক অবস্থার সুযোগে সামাজিক ফ্যাসিবাদ ও গণতন্ত্র পরিপন্থী শক্তির উল্লম্ফন ঘটেছে।
সেমিনারে বিভিন্ন পর্যায়ে বক্তব্য দেন ছায়ানট-এর সভাপতি ড. সারওয়ার আলী, সিপিবির প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক এম এম আকাশ, ৯০-এর গণঅূভ্যুত্থানের অন্যতম সংগঠক ও ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের নেতা আসলাম খান, যুব ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম নান্নু, ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি মাহির শাহরিয়ার রেজা, চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের সময় রাজধানীর উত্তরায় আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ছাত্র ইউনিয়ন নেতা সালমান রাহাত, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক রায়হান উদ্দিন প্রমুখ। পুরো সেমিনারটি সঞ্চালনা করেন উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সহ-সাধারণ সম্পাদক প্রদীপ ঘোষ।
ইউ