যুদ্ধ বুড়োর স্বপ্নবাজি
এইতো! এইতো বাড়িটা পেয়ে গেছি!
লোকটার দু,পা ফেটে রক্ত ঝরছে সারা শরীর মৃত্যুর মতো যাতনা। ,অবিন্যস্ত
কাচাপাকা দাড়ি থুতনির সাথে ল্যাপ্টে আছে।
ফের ঝাপসা দৃষ্টি কষে দূরে প্রসারিত করতে করতে চোখে উজ্জ্বলতা খেলে
যায়,হ্যা, এটাই। মাটির বারান্দা ঘেরাও করে আছে নারকেল গাছের সারি।
দেওরির পরে ছোট একটা বাগান,তারওপারে আঁকাজোখা
করা দরজা।
উত্তরের বাতাস লাফাতে লাফাতে আসে। ক্ষেতে গরুর পাল নিয়ে যাচ্ছে এক ছেলে,কিন্তু পেছনের ল্যাংড়া বাছুরটা বারবার পিছিয়ে যাচ্ছে। কাশতে কাশতে বাঁকানো দেহ নিয়ে সে বসে।
লাকড়ি পোরানো গন্ধ বাতাসে কোঁকড়ানো চামড়া ফুঁড়ে চাপচাপ রক্ত মাটির সাথে মিশে
যাচ্ছে। যন্ত্রণায় অধীর সে উপুড় হয়ে মাটি চেপে ধরে ধরে।
নিজেকে চিমটি কাটে,সত্যিই সে এই জীবনে
বাড়ি ফিরতে পেরেছে! কত বছর পর?
সে তার দীর্ঘ যুগের হিসেব মেলাতে হিমশিম খায়।
নিস্তব্ধ রাত ক্রমশ তার মাথার ওপর ঝুলতে থাকে।
এবড়ো খেবড়ো আল, মাঝখানে ডোবা,অবিন্যস্ত হোঁচট খেয়ে বাড়িটার
সামনে এসে অনিশ্চিত বোধে ফিরে যাওয়া,,
বিভ্রমের সময় কতবার এমন হয়েছে!
কেউ কী হেঁ টে আসছে?, তার যুবক হয়ে উঠা সন্তান.,,?
যে সাবলীল পিতা নিজের যৌবনে পেছনে ফেলে
কাউকে কিচ্ছু না বলে যুদ্ধে চলে গিয়েছিল ,
প্রশিক্ষণ নেয়ার পরে রণক্ষেত্রে ঝাপিয়ে পডেছিল,
স্ত্রী র গর্ভে সন্তান রেখে এসেছে,এই চিন্তাকে মাথায় আসতে
দেয় নি,, এরপর গুলি খেয়ে বছর বছর কোথায়
হারিয়েছিল,সে নিজেই কী জানে?
এবড়োথেবড়ো ভিড়ের মধ্যে হাঁটছিল,আচানক পকেটমার,,
এমন একটা হুল্লোড় ওঠার পরে সেকী পিটুনি! তার পকেটে
কেউ ছুটতে গিয়ে রেখে দেয়। কিছু বোঝার আগেই,,,
যে মানুষ যৌবনকে সাথে নিয়ে যুদ্ধে গিয়েছিল,আজ তার সারা অস্তিত্বে ঘুণ।
চামড়ার নিচে যেন কালো কালো যাতনার বিষ ছড়াচ্ছে।হোচট খেয়ে
সামনে তাকায়, ওই তো শিমুল গাছটি,!,,,
এত বছরে কিছুই বদলায় নি দেখে অনেক যাতনায়ও আপ্লূত
হলো। ঘরের সামনে তুলো উড়বে,,কত পানি দিয়েছে
গোড়ায়,আর শিমুলের নেশস ধরে যাওয়া গন্ধ!
আহা! কী দিন ছিল!
সামনে দরজা খোলার শব্দ হল কী?,,,এত ঘোলাটে
দৃষ্টি! কোমরে অসহ্য ব্যথা। কেউ কী হেঁটে আসছে?
সে কিছু বলতে চায়,কিন্তু তার গলা দিয়ে বিচিত্র
আওয়াজ আসছে যে?
বারান্দার সিড়িতে বসে কে ঢুলছে? কিন্তু তার পাশে খাটিয়ায় শাদা রং এ আবৃত কার লাশ?
মাথা ঝিম ধরে তার,, সে নিজের সন্তানের কথা
ভেবে একটা পতাকা নিয়ে এসেছিল,ভেবেছিল,যুদ্ধদিনের
কথাগুলো ছেলেকে বলবে,গেরিলা যুদ্ধের কথা শুনে
বাবাকে ছেলের বীর মনে হবে।তাকে গণধোলাইয়ের
সময় জনতা কী এক ক্রোধে পতাকার ওপর জলন্ত দেশলাই
ছেড়ে দেয়।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই অবস্থা হয়েছে?
এত হাত এত মেরেছে লোকটাকে ভেবেছিল, সেখানেই প্রাণ চলে যাবে।
এখনো অবস্থা ভালো না, তারপরও সেকী স্বপ্নেও ভেবেছে, যে রাস্তা ধরে সে অনন্তের
পথে চলে গিয়েছিল,সেই পথ ধরে ফের ফিরতে পারবে? স্বপ্ন দেখতে পারবে,
স্ত্রী সন্তান নিয়ে এই জীবনে ফের সংসার করতে পারবে?
ওপরে আধখানা চাঁদ ফুটেছে,,আমাকে বাঁচাও
বাঁচাও,,ভেতর থেকে বোবা চিতকার ওঠে। এরপর নেতিয়ে যায়।
শিমুল আর কদমের ছায়া নিজের সাথে একাকার হলে,
যেন শুয়ে শুয়ে সামনে এগোয় লোকটা,, ,কেউ আছেন?
সমস্ত শক্তি দিয়ে চিতকার করে।
একজন মায়াবি তরুণ প্রথম বেরিয়ে আসে,বলে ভিক্ষা হবে না,
যান কাছের হাসপাতালে গিয়া চিকিৎসা লন।
এরপর যেন বায়স্কোপ,, মাঝবয়েসী ফকফকা তার বউ,,পাশে
দাঁড়ানো মানুষটাকে,, চল্লিশোর্ধ্ব লাগে।
লোকটা ফ্যাসফ্যাসে কন্ঠে বলে, লুবনা, আমি আইছি,,
কে? মহিলার কন্ঠ কেঁপে ওঠে,সে একটা মোমবাতি নিয়ে
লোকটার মুখের সামনে তুলে ধরে এরপর রীতিমতো
রীতিমতো কাঁপতে থাকে,তুমি বাঁইচা আছ?তুমার এই দশা
হইছে?বলতে বলতে ধাতস্থ হতে কিছুটা সময় নেয়, এরপর
ফিসফিস করে বলে,আমার অহন বিয়া হইছে,সন্তান হইছে,
ভেতর থেকে বাচ্চার কান্নার শব্দ শোনা যায়। লোকটার বুক
পুড়ে যেতে থাকে। তাকে পেছনের চচল্লিশ জিজ্ঞেস করে,,
এই পাগলটাকে তুমি চেনো?,
লুবনা বলে, আরেন্নাহ! আবোলতাবোল বকতেছিল,
বুড়াটা খুব অসুস্থ। বাদ দেও তো,বাবু কানতাছে,শুননা?
দরজা বন্ধ হয়ে যায়।
লোকটা খড়কুটো আঁকড়ে ধরার মতো মায়াবি তরুণকে
জড়িয়ে ধরতে চান,তোমার নাম যুদ্ধ, না?
আপনি ক্যামনে জানলেন?
লোকটার বুকে শিহরণ বয়ে যায়,লুবনা তাহলে এই
নামটা রেখেছে? সে ধীরে ধীরে কিশোরের চুল ঝাকিয়ে বলে,
কইল একজন, আসলে এইসব নাম বাচ্চা পেডে থাকতেই বাপ
মা কত আল্লাদ কইরা রাখে,,
আপনি কার কথা বলতেছেন? কার বাপ মা?
হাঁপাতে হাঁপাতে লোকটার যৌবনের অসাধারণ সুন্দর কদমের
বাতাস উইড়া যাওয়া যাওয়া সুন্দর দিনগুলো মনে পড়ে,,,
বাবা! বলে মায়াবি যুবক বিমূঢ় বোধ করলে তার হাতটা কষে
ধরে থাকতে নিভে যাওয়া দীপের আগের মুহূর্ত যেন,
বলে তুমি আমারে চিনছ?আহা!জীবন স্বার্থক হইল,,
বাবা তোমারে একটু জড়ায়া ধরি?
আপনার শইল্যে তো অনেক রক্ত,চলেন আপনেরে
হাসপাতালে নিয়া যাই,
না না,তুমি থাহো,আমার লগে,,মায়াবি যুবক অদ্ভুতভাবে
হাসে,বলে আমার বাপে যুদ্ধে যাওনের পরে
পাকবাহিনী আম্মার পেটে লাত্থি দিয়া আমারে মাইরা
ফালাইছে, এরপর থাইকা অপেক্ষায় আছি,
কবে আপনি আসবেন? অবশেষে আইলেন আপনি
আগে সুস্থ হন,পরে,, বলে ভালোকরে দেখে লোকটাকে
আপনার ডাইন হাতটা পাক আর্মি নিয়া গেছে? বাদ দ্যান,
চলেন,আমি রিক্সা ডাহি,,কিন্তু লোকটা তার সন্তানের
মায়ার মধ্যে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে।
সে কিছতেই তার হাত ছাড়ে না,
বহুকাল পরে লোকটা মন থেকে হাসে।
আহ শান্তি! বলতে বলতে সে হাত ধরেই একসময় সে অন্ধকারেই স্থির হয়ে যায়।
এরপর যেন মায়াবি যুবকের লাশ খাটিয়ায় আধোছায়ায় শাদা কাপড়ে
মোড়ানো অবস্থায় মাটির বারান্দায় পড়ে থাকে,,এবং মায়াবী এবং বুড়ো
লোকটা ভিটের মায়ায় খাটিয়ার পাশে বসে ঢুলতে ঢুলতে অনন্ত পাহারায় বসে।
//জ//