ঢাকা, বাংলাদেশ

মঙ্গলবার, ২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ এপ্রিল ২০২৪

English

ফেসবুক থেকে

ফেসবুক থেকে বাবাকে খোলা চিঠি

তাসনুভা আনান (রুপান্তরিত নারী), নিউইয়র্ক থেকে

প্রকাশিত: ১১:১১, ৫ আগস্ট ২০২২; আপডেট: ১৪:২৮, ৫ আগস্ট ২০২২

ফেসবুক থেকে বাবাকে খোলা চিঠি

ফেসবুক থেকে বাবাকে খোলা চিঠি

প্রিয় বাবা,
অবাক হচ্ছো তোমায় প্রিয় লিখছি তাই, অবাক হবার কিছু নেই, তুমি সারাজীবন ই প্রিয় ই ছিলে আছো, মাঝে যা ,কিছু জমা হয়েছে ,ভেবে দেখলাম সেটা অভিমান ছাড়া আর কিছুই না।

বিগত একবছর ধরে প্রতিদিন ভাবি তোমায় একটা চিঠি লিখবো, কিন্তু প্রতিদিনই ভাবি আর কেমন যেন কলম থেমে যায়।  আজ আর মন মানলো না , ভাবলাম লিখেই ফেলি।

তুমি কেমন আছো বাবা? 
বাড়ির পেছনে খালের পাড়ে গোল গাছ গুলো আছে? 
গোলফল হয় তাতে? 
আচ্ছা ছাড়ো, নারিকেল গাছে নারিকেল হয়? 

শরীরের মধ্যে ইদানিং রেগুলার ই চলে গবেষণা, ডাক্তার ডাবের পানি খেতে বললেই মনে পড়ে যায়  কত কি!!  

ছাড়ো এসব, আমি সামালে নিতে পারি এই সব আবেগ বেশ। 

আচ্ছা বাবা, জানো তুমি সেই ছোট্টকাল থেকে আমি তোমায় মিস করে করে বড় হয়েছি। 

পড়া না পারলে ছোট আপু যখন  চিরুনী দিয়ে মারতো, আমার ছোট্ট হাতে ফোসকা পড়ে থাকতো, 
আপু কে বলতাম, বাবা আসলে সব বলে দেবো। 
কিন্তু তুমি আসতে আসতে সেই মধ্য রাত। 
ঘুমিয়ে আমি একদম কাদা কাদা। 

কোনোদিন ও তোমাকে বলা হয়নি কিছুই। কোনোদিন ও তোমায় পাওয়া হয়নি আমার। 

তোমার কত টুকু মনে আছে জানিনা, আমার কাছে তুমি মানে খুব সামান্য অল্প কিছু স্মৃতি । 
বাড়ির উঠানের খালের পাড়ে চাটাই বিছিয়ে গরমকালে তুমি গাছের ছায়ায়  ঘুমিয়ে থাকতে, আর আমি তোমার বুকের মধ্যে শুয়ে থাকতাম। 
তোমার বুকের লোমের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়তাম। 
আর মধ্যরাতে হালখাতার সময় তুমি এসে নিয়ে যেতে দোকানে দোকানে।  
সেই মিস্টি নিমকি, আর চিড়ার সাথে দই। 
এই টুকুই মনে আছে। 

তারপর আস্তে আস্তে তারে জামিন পার সিনেমায় দারশিল সাফারির মত ব্লার হতে থাকি। কখন যে এত গুলো সময় শেষ হয়ে গেলো টের ই পেলাম না। 

আচ্ছা বাবা, পুকুরে মাছ হয়? 

বাগানের বড় পেয়ারা গাছ টা আছে , তোমার মনে আছে কখনো বাদুড় বসতে পারতো না পেয়ারা গাছে। সারাদিন আমি ই গাছে থাকতাম , 
তেতুল গাছ টা? 

পুকুর পাড়ে পেয়ারা গাছের সাথে একটা মেহেদি গাছ ও ছিলো ,আছে সেটা। 
ওই গাছ টা আমার অনেক অপমানের সাক্ষী বটে।

পুকুর পাড়ে জাম গাছ টা আছে?

কালো কালো থোকায় থোকায় জাম ধরতো? 
সেই গাছটার ডাল গুলো নরম ছিল, প্রায় ই ভেংগে চুড়ে নিয়ে পুকুরে পড়তাম।

আচ্ছা তুমি কি জানো আমি কেনো গাছে গাছে উঠে বসে থাকতাম? 

তোমার না শুধু ,তোমাদের সবার ধারণা আমি ফল ভালোবাসি তাই গাছে থাকি, 
কিন্তু এর পেছনে অনেক বড় আরো একটা সত্য আছে।

আমি বাইরে বের হলেই পাড়ার ছেলেরা আমাকে খ্যাপাতো, ভীষণ ভাবে, বাজে ভাবে মলাস্ট করতো। 
শরীরের এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে আমার পুরুষ মানুষের হাত নেই বাবা। 
এই হাতের ছোয়া এত বিষাক্ত, এত টাই বিষাক্ত,
আজো আমাকে ঘন্টার পর ঘন্টা পার করতে হয় কাউন্সিলর এর রুমে। 

ভেবেছিলাম তোমায় বলবো, একদিন সব বলে দেবো তোমায়, কিন্তু কিছুই বলা হয়নি। 
তোমায় কোনোদিন ও আমার পাওয়াই হলোনা, বলা টা হবে কোথা থেকে বলো? 

তোমার সেই বুকের উষ্ণতা খুজতে গিয়ে অনেক ঠকেছি আমি বাবা। জীবনে অনেক পুরুষ মানুষ এসেছে। 
দিন শেষে সবার চাহিদা এক ই রকম। 
কেউ আগে চুমু খায়, কেউ পরে । দিন শেষে চাহিদা ওই এক ই জায়গায়, 
এত ঠকেছি জানো, এত দিক ভুলেছি আমি। 
আর ভালো লাগেনা।
মেয়ের বাবা হলে নাকি অনেক কিছু বোঝে তারা, তুমি কেন বুঝলে না? 
নাকি জীবনে আসা মেয়ের বাবাদের মত তোমার ও???? 
থাক, জন্ম দিয়েছ তুমি, তোমায় নিয়ে বেশি কিছু বললে তোমার ভালো ভালো ছেলে মেয়েদের আবার ফোস্কা পড়বে।
তুমি জানো বাবা,
এখানে আমি মেট্রোরেল এ চড়লে হাজারো মানুষ দেখি, তোমার বয়সি কাউকে দেখলে হঠাৎ করেই আমার বুকের মধ্যে কেমন যেন এক্টা দুকদুকানি শুরু হয়, সেই রাত আর ঘুম হয়না আমার। 

আমায় পটানো নাকি অনেক সহজ। আমি নাকি অল্পতেই গলে যাই। বাইরে থেকে শক্ত শক্ত ভাব ধরলে ও আমি নাকি ভিতরে অনেক নরম। 
তাই আমি ঠকি। আর নরম বলেই আমাকে যাবার সময় মানুষ আরো বেশি ক্ষত বিক্ষত করে যায়। 

আচ্ছা বাদ দাও , 
শুনেছি তোমার সম্পত্তি ভাগাভাগি চলছে। আমি জানো আজো এই সম্পদ আর সম্পত্তির ফারাক বুঝিনা। 
তোমার কোনো প্রপার্টি আমি চাইনা। 
কোনোদিন ই চাইনা। 

তোমার আমায় হাজার টা অভিযোগ আমি জানি, দেশের মানুষের মত সেগুলো যদিও আমার কিছু আসে যায় না। 
দেশের মানুষ আর তুমি সবার কথা বলছিনা, তোমরা এক ই কাতারের মানুষ। 
তোমাদের চাহিদা আর যোগানের ভারসাম্য, সম্পর্ক কোনটাই তোমাদের নাগালের মধ্যে নেই। 
তার মধ্যে আমার কাছে গ্রহণ যোগ্য অভিযোগ হলো, 

আমি কেনো বাড়ি যাই না? 
শোন, তোমার আদরের ছোট মেয়ে আমায় বলেছিল আমার মধ্যে কারের যে ঘুমন্ত সত্তাটা আছে তাকে গলা টিপে মেরে ফেলতে পারলে তবেই যেন বাড়ি যাই। আমার জন্য তোমাদের মান সম্মান নষ্ট হয়। তোমাদের ভাই এত বনেদী মান সম্মান নষ্ট করতে চাইনি, তাই নিজের জীবনের রাস্তা নিজেই করে নিয়েছি। 

তোমার আরো একটি প্রশ্ন সেটা আসলে তোমার একার নয়, পুরোদেশবাসীর,

আমি আমেরিকা কি করি? 
বাবা শরীরটা নিয়ে কি কি হচ্ছে সেটা তুমি বা তোমাদের বোঝার শক্তি বা ইচ্ছে কোনোদিন ছিলনা, 
হয়নি, হবে কি না জানিনা কোনোদিন ও। সো আমি কাউকে কৈফিয়ত দিতে বাধ্য নই। 
নাহ তোমাকে ও না। 

তোমার আর আমার মাঝে আস্তে আস্তে করে এই বিস্তর ফারাক, এর কারণ একমাত্র তোমার ধর্মান্ধতা।
তোমাদের অপব্যাখ্যা আর কুসংস্কার।  

ভাবছো পাবলিকলি কেনো লিখছি, ফোনে বা কথা বলে নিলেই হয়? 

তোমার সাথে কথা বলার ইচ্ছে টাই আমার চিরদিনের মত নষ্ট হয়ে গেছে। 
আর জানোই তো কোনো কিছুর উপর থেকে মন উঠে গেলে আমার পক্ষে আর সেটা করা সম্ভব হয়না।

ছোট বেলা থেকেই আমি এমন। একটু  ঘাড় ত্যাড়া আছে। 

সততার শতভাগ আমি তোমার কাছে থেকে শিখেছি।  কিন্তু তোমার মত সেল্ফিশ আমি না। 
দায় আর দায়িত্ব বোধ আমি মায়ের কাছে শিখেছিলাম ,
চেষ্টা করি পালন করতেও। 
বিশ্বাস না হলে রাজ আর মায়ের কাছে জিজ্ঞেস করে দেখো।

সুনীলের কোন কবিতায় যেন পড়েছিলাম রাগ পুষে রাখলে নাকি কষ্ট হয়, তখন বুঝিনি আজ বুঝি তাই আমি ও আর রাগ পুষি না।  
এমনকি ভালো ও বাসিনা। 

ও বাবা তুমি জানো, 
আমি আজ ও কোনো একটা বই পড়তে পারিনা। সেই ২০১৮ সালের সেই ঘটনা আজো আমি বই হাতে নিলে, বইয়ের  লাইনের  মাঝে মাঝে  আমি সেই বিভৎস মুখ দেখি 
আমার দম বন্ধ লাগে, 

ভেবেছিলাম একদিন সব বলে দেবো তোমায়, কিন্তু দেখো না 
কিছুই বলা হয়নি আর। কারণ বলার ইচ্ছে টাই শেষ হয়ে গেলো।  

আমি এখন এই আধুনিক হাডসনের মত ই ,
অস্তিত্ব আছে কিন্তু অনুভূতি নাই।
আমার আর কোনো রাগ নেই। 

দেখোনা কত লোকে আমায় কত কথা বলে,আমি শুধু দেখি আর হাসি, কাউকে কিছু বলিনা।

ভালো থেক, একা না পারলে এবার মাকেও এক্টু ভালো রেখ। 
আর কত বলো? 

ইতি তোমার মান সম্মান নষ্ট করা সন্তান।

তাসনুভা আনানের ফেসবুক থেকে সংগৃহীত

 

ইউ