
ভূঞাপুরের ৩০ শতাংশই নারী কৃষক
আর্ন্তজাতিক শ্রমিক দিবস, প্রতিবছর পহেলা মে বিশ্বব্যাপি শ্রমিক দিবস হিসাবেই পালিত হয়। অন্যান্য বছরের ন্যায় এবারও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও রাষ্ট্রিয়ভাবে এবং বিভিন্ন সংগঠন, শ্রমিক সংগঠনসহ রাজনৈতিক বিভিন্ন দল দিবসটি পালন করেন, সেমিনার, সমাবেশ করে পালিত করেন।
প্রতি বছরের ন্যায় এবারও দেশের প্রতিটি জেলা উপজেলায় ইউনিয়ণে রাষ্ট্রিয়ভাবে বাংলাদেশে ও আজ সোমবার (১ মে) পালিত হচ্ছে। শ্রমিক দিবসে টাঙ্গাইল জেলার ভূঞাপুর উপজেলার চরের নারী কৃষক ও নারী শ্রমিকেরা কেমন আছেন এ নিয়ে ওমেন আই ২৪ এর সঙ্গে কথা হয় ভূঞাপুর উপজেলার গাবসারা ইইউনিয়ন ও অর্জুণা ইউনিয়ণের নারী কৃষক ও শ্রমিকদের সঙ্গে।
মাদারিয়া চরায় তপ্তদুপুরে তারা ক্ষেতেই কাটছে ভুট্টা খেতেই শুকাচ্ছে। এমনই একজন কৃষক শিল্পী ,দুই সন্তান ও স্বামী নিয়ে ভুট্টা শুকাচ্ছেন কথা হয় তার সঙ্গে। শিল্পী এক সময়ে ঢাকায় গার্মেন্টসে কাজ করতেন। করতেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের রাজনীতি। বললেন এই রাজনীতি করতে গিয়ে জেলেও খেটেছেন তিনি। পরে একসময়ে রাজনীতি ছেড়ে চলে আসেন গ্রামে।
এখন তিনি সফল কৃষক গত বছর একবিঘা জমিতে ভুট্টা চাষ করে একলক্ষ্য টাকা তার আয় হয়েছে। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, সরকার থেকেই ভুট্টাবিজ আর সার দেন, স্থানীয় উপজেলার কৃষি অফিসার ও ইউনিয়ণ পরিষদের চেয়ারম্যান।
তিনি আরো বলেন, স্থানীয় ভাবে ভুট্টা চাষে সেচের ব্যাবস্থা করে দিয়েছেন আমাদের ইউনিয়ণের চেয়ারম্যান সাইদুল ইসলাম তালুকদার। আমাদের শুধু শ্রম আর লেবার খরচ এই এক বিখা জমিতে ১০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে।
শিল্পী জানান, প্রতিদিন একজন পূর্ণ বয়স্ক শ্রমিককে ৬০০ টাকা আর ছোটদের ৩০০ টাকা করে দিতে হয়েছে ভুট্টার খুসা এড়ানো থেকে ভুট্টা খেতের পরিচর্যায়। ফলদা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সাইদুল ইসলাম এর সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, মাদারিয়া চড়ায় এবছর ৩২ বিঘাজমিতে ভুট্টার বাম্পার ফলন হয়েছে।
সম্পর্ণ বিনা খরচে কৃষককে বিজ,সার এবং সেচের সকল সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এর সর্ম্পণ কৃতজ্ঞ বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক সাহেবের।
গাবসারা ইউনিয়নের মেঘারপটল গ্রামের নসিরণ বেওয়া বলেন, ছোট সময়ে বাবা মা মারা গেছেন। অন্যের বাড়ীতে বড় হয়েছি,ঝড়-বৃষ্টি বন্যা,আর দারিদ্রতার সঙ্গে সংগ্রাম করে করে আজ কৃষক হয়েছি।
তিনি এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, প্রতিবেশী চাচার সংসারের বড় হয়েছি, চরের কাইশা আর ঘাস কেটে এবং গরু-ছাগল আর ভেড়ার রাখালের কাজ করে। সকাল হলে কাচাঁমরিচ দিয়ে পান্তাভাত খেয়ে বাহির হইতাম হেই বিহান বেলায় দুইটা আঠার ওটি আর একটুকরা মিঠাই গামছাই বাইন্দা কাইশাবনে ছাগল গরু ছেড়ে দিয়ে চরের মধ্যে ছাতা মাথায়। নসীরণ বলেন, হন্দার (সন্ধ্যার ) আগদিয়া বাইতে আইতাম। এভাবেই একদিন ১৪ বছর বয়সে আরেক রাখালের সঙ্গে বিয়ে হয় আমার। নসীরণ বেওয়া বলেন, একদিন স্বামী করিম শেখ হঠাৎই মারা যায় এক পোলা আর গেদি থুইয়া। এভাবেই কৃষক হয়ে উঠা।
তিনি বলেন, চরে প্রথমে বাদামের চাষ করি চাচার খেতে, এর পরে চাচার মেয়ের সহযোগিতায় একটি গরু গাভী বর্গা নেই। গরুর বাছুর একবছরে বেশ বড় হয়ে যায়। সেই সাড় গরু বকরাঈদে (কোরবানীর) ঈদের আগে ষাড়গরুটি বিক্রি করে কিছু পুজিহয়। সেই পুজিঁ থেকে আজ আমি ছেলে মেয়ে নিয়ে ভালো আছি। এখন শুধু বাদাম চাষই করি না , ভূট্টা ,তিল-তিসিসহ মরিচ চাষ করছি। সেই সঙ্গে প্রতি বছর একটি করে ষাড় গরু পালি বরকাঈদের আগে বিক্রি করি। ছেলেটা ভুঞাপুর পাইলট স্কুলে পড়ে ,মেয়ে আমার ঘরেই প্রাইমারী পর্যন্ত লেখা পড়া করেছে বলে জানালেন।
অপর এক প্রশ্নে নসীরণ বেওয়া বলেন,পালিত চাচা আর তার মেয়ে ছাড়া কারোর কাছে আমাগ যেতে হয়নি। দুইটা হাত দুইটা চোখ দুটিই আমার বড় সম্পদ। আর এই সম্পদ দিয়েছেন আমার আল্লাহ! তার ওপরেই ভরসা করে চলেছি।
সেই সম্পদকে কাজে লাগাইয়া চলছি কারো কাছে সাহায্যের জন্য যাই না। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শ্রমজীবি মানুষসহ শ্রমিক সংগঠন সর্ম্পকে, তিনি বলেন, শ্রম অধিকার আদায়ের দিনটি কি তিনি জানেন না, তিনি জানেন না, এর ইতিহাস।
শ্রমিকদের সম্মানে মে দিবস বা পহেলা মে জাতীয় ছুটির দিন হিসাবে পালিত হয়ে আসছে বিশ্বের প্রায় ৮০টি দেশে। কিন্ত নসীরণ বেওয়া এবং আয়শা খাতুন জানেনই না দিবসটি কি।
হেমনগর ইউনিয়ণের নলিন গ্রামের আয়শা খাতুনের বয়স এখন ৩০। তিনি কাজ করেন প্রতিদিন শ্রমিক হিসাবে ভূট্টা খেতে। শ্রমিক দিবসেও তিনি কাজ করছেন। কারণ একবেলা কাজ না করলে অনাহারে অর্ধাহারে থাকতে হয় তাকে। মে দিবসে কাজ করছেন, এমন প্রশ্নের উত্তরে আয়শা বলেন,যার পেটে ভাত নেই তারঁ কিসের মে দিবস ?
মে দিবস হচ্ছে বড়লোকের বিলাসিতা আর শ্রমিককে উপহাস করা! আট ঘণ্টায় কাজ করলেও সেই ভাবে মালিক কি টাকা দেয়? তিনি আরও বলেন, টেলিভিশনে শ্রমিক দিবসের নামে ভালাবালা কথা কয়, তাদের অফিস খোজঁ করে দেখুন কয়টাকা বেতন দেয়! আঙগোরে কথা বাদ দেন ,কাজ করি সারাদিন সন্দ্যা অইলে ৫০০ টাকা মুজুরী পাই এতেই সন্তোষষ্ট।
এদিকে ভুঞাপুর উপজেলার কৃষিকর্মকর্তা ড. মোহাম্মদ হুমায়ন কবীর বলেন, ভুঞাপুর উপজেলায় শতকরা ৩০শতাংশ নারী কৃষক রয়েছেন,যা বাংলাদেশের ইতিহাসে-ই শুধু নয় বিশ্বের ইতিহাসে একটি উপজেলার দুটি ইউনিয়ণে এতো কৃষক নেই!
প্রতিটি ইউনিয়ণে ভুট্টা ও বাদাম চাষীদের বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও কৃষি মন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক সাহেবের সার্বিক সহযোগিতায় শুধু আমার উপজেলায় নয় সারা দেশেই কৃষকদের ভুট্টাবিজ সরিষাবিজ এবং খেসারি মশুর, মাসকলাই ও সূর্যমুখি তেলের বিজ দিয়েছি, সেই সঙ্গে প্রতি কৃষককে ২০ কেজি করে সারও বিনা পয়সায় দেওয়া হয়েছে বলে জানালেন কৃষিকর্মকর্তা।
চরের নারী কৃষকদের উদ্ভুদ্দ করার লক্ষে ইতিমধ্যে গণমুখী আরো কর্মসুচির জন্য ইতিমধ্যে বাংলাদেশ কৃষিমন্ত্রনালয়সহ কৃষি অধিদপ্তরে নিকট একটি তালিকা প্রস্তুত করছেন তিনি। এক প্রশ্নে কৃষিকর্মকর্তা বলেন, চরে যে সকল ফসল বন্যার পরে এবং পূর্বে যে সকল ফসল উৎপাদন হয়ে থাকে সেই ফসলগুলোর ওপর আমরা স্থানীয়ভাবে ইউনিয়ণ পরিষদের চেয়ারম্যানসহ মেম্বারদের নিয়ে সম্মিলিতভাবে কাজ করবো।
ইস্মার্ট কৃষি উন্নয়ণে নারী কৃষকের পাশাপাশি পুরুষদের বিজসহ চাষের ওপর ট্রেনিংয়ের ও উদ্যোগ গ্রহন করা হয়েছে ভূঞাপুরের চরের কৃষকদের কৃষি ও ভাগ্য উন্নয়ণে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সোনার বাংলাদেশ ইর্স্মাট বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে কৃষকের জমি চাষে সকল ধরণের সহযোগিতায় কাজ করে যাচ্ছি। তিনি বলেন, এবার ফলদা ইউনিয়ণ, অর্জুনা, গাবসারা ইউনিয়ণে ভুট্টাচাষের লক্ষ্য ছিলো ২ হাজার ২০০ হেক্টর। আমাদের কৃষকেরা উৎপাদন করেছেন, ৩হাজার ১০ হেক্টর জমিতে ভুট্টাচাষ করেছেন।
এছাড়া বাদাম চাষ হয়েছে ১৭ হেক্টর জমিতে, আর তরমুজ চাষ হয়েছে ৫ হেক্টর জমিতে। এসব জমির কৃষক নারীই অধিক,তবে তারা তাদের স্বামীও সন্তানের সহযোগীতায় সফল নারী কৃষকবটে। তিনি বলেন, ১ একহাজার ১০০ কৃষককে বিনা পয়সায় সার ও বিজ দেওয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য ১৮৮৬ সালের ১ মে দৈনিক ১২ ঘণ্টার পরিবর্তে ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোতে শ্রমিকরা ফুঁসে উঠেন। হে মার্কেটের কাছে তাদের বিক্ষোভে পুলিশ গুলিবর্ষণ করলে ১০ শ্রমিক নিহত হন। উত্তাল সেই আন্দোলনের মুখে কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের দাবি মেনে দিতে বাধ্য হয় এবং বিশ্বব্যাপী দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের সময় চালু করা হয়। ১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই প্যারিসে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক শ্রমিক সমাবেশে ১ মেকে আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবস হিসাবে ঘোষণা করা হয়। পরের বছর থেকে বিশ্বব্যাপী এ দিনটি পালিত হচ্ছে।
//এল//