
ছবি: উইমেনআই২৪ ডটকম
স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে অন্যতম প্রধান অবদান রেখে আসছে মেরিন সেক্টর। প্রতিবছর এই সেক্টর থেকে গড়ে প্রায় ৭৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বৈদেশিক আয় অর্জিত হয় (সূত্র: বাংলাদেশ ব্যাংক)। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে কার্যকর নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের অভাবে এই গুরুত্বপূর্ণ খাত এখন ধ্বংসের মুখে।
বর্তমানে ভিসা সমস্যাসহ নানা প্রশাসনিক জটিলতার কারণে বাংলাদেশি নাবিকদের জন্য বিদেশি জাহাজে কাজ পাওয়ার সুযোগ ক্রমেই সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। শুধুমাত্র ক্যাডেট ও রেটিং পর্যায়েই বর্তমানে অধিকাংশ নতুন সিডিসিপ্রাপ্ত মেরিনার বেকার, এবং আগামী ৫ মাসে এই সংখ্যা বাড়তে বাড়তে বিপুলসংখ্যক ছাড়িয়ে যেতে পারে — যা একটি ভয়াবহ সংকেত।
এই সংকটের মধ্যেই প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের একটি চিঠির মাধ্যমে প্রস্তাব করা হয়েছে, যেন মেরিন টেকনোলজি ইনস্টিটিউট থেকে এসএসসি পাস ডিপ্লোমাধারী শিক্ষার্থীদের অফিসার ক্যাডেট পর্যায়ে সিডিসি (Continuous Discharge Certificate) প্রদান করা হয়।
সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক মানদণ্ড ও দেশের বিদ্যমান বিধিমালার সরাসরি লঙ্ঘন,
ডিপ্লোমা ইন মেরিন টেকনোলজি একটি SSC-ভিত্তিক শিক্ষা কর্মসূচি, যা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী অফিসার ক্যাডেট হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় STCW কোড A-III/1 অনুযায়ী অনুমোদিত প্রশিক্ষণ নয়।
Bangladesh merchant shipping ordinance 1983 অনুযায়ী মার্চেন্ট মেরিন শিক্ষায়তনের অনুমোদন, প্রশিক্ষণ মুল্যায়ন এবং মান নিয়ন্ত্রন এর বিধি ২৬ এর ধারা ৪ অনুযায়ী ডিপ্লোমা ইন মেরিন টেকনোলজির কোর্স নৌ অধিদপ্তর কর্তৃক অনুমিত নয়।
এমনকি প্রধান পরীক্ষক, পরীক্ষক এবং প্রশিক্ষকদের যোগ্যতা এবং অভিজ্ঞতার বিধি ৩৬.১ এর ক, খ, গ, ঘ , ৩৬.২ এবং বিশেষ করে ৩৬.৩ এর বর্ণিত যোগ্যতার মাপকাঠি অনুযায়ী পরিচালিত হয় না।
এ বিষয়ে সরকার কর্তৃক জারি করা “নৌযান অধীক্ষক পরীক্ষার পরিদর্শন পরিচালনার বিধিমালা ২০২১”-এর ৩৬(১)(ক)-(গ) ধারায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে:
“...পরীক্ষককে অবশ্যই বৈদেশিক জাহাজে চিফ ইঞ্জিনিয়ার এবং মাস্টার হিসেবে দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা থাকিতে হইবে এবং অনুমোদিত প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করিতে হইবে।”
— [সূত্র: বাংলাদেশ সরকারি গেজেট, নৌযান বিধিমালা ২০২১, ধারা ৩৬]
অন্যদিকে, International Maritime Organization (IMO)-এর STCW মানদণ্ডে বলা হয়েছে:
“Only those completing officer training programs that fully comply with STCW Code Section A-III/1 and are approved by the administration shall be eligible for certification.”
— IMO STCW Code – www.imo.org
সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ কথা হচ্ছে মেরিন একাডেমি ব্যাতিত অন্যান্য প্রাথীদের জাহাজে যোগদানের পূর্বে কোন অনুমোদিত মেরিটাইম প্রতিষ্ঠান হতে ২৪ মাসের ট্রেনিং করা বাধ্যতামুলক। এই অবস্থায় মাত্র ৬ মাসের ট্রেনিং করে ডিপ্লোমা ইন মেরিন টেকনোলজির ছাত্রদের অফিসার সিডিসি প্রদান এক ধরনের বৈষম্য। কেননা নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের অধিনস্থ কোন প্রতিষ্ঠান না হয়েও সম্পূর্ণভাবে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক নিয়মকে পাশ কাটিয়ে এই ধরনের অপচেষ্টা আমাদের মেরিন সেক্টররের মারাত্মক ক্ষতি সাধন করবে।
এই সিডিসি ইস্যুএর পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে
এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে:
• বাংলাদেশ IMO-এর হোয়াইট লিস্ট থেকে বাদ পড়তে পারে;
• আন্তর্জাতিক ম্যানিং এজেন্সিগুলোর আস্থা হারিয়ে যাবে;
• যোগ্য ক্যাডেটদের প্রতি চরম বৈষম্য হবে;
• এবং সামগ্রিকভাবে দেশের মেরিন খাতের আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা ধ্বংস হবে।
Philippines Maritime Industry Authority এবং India DG Shipping অতীতে অনুরূপ ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে কড়া আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে পড়ে এবং পরবর্তীতে তা বাতিল করতে বাধ্য হয় (সূত্র: Marine Insight)।
৫ দফা যৌক্তিক দাবি
বাংলাদেশের মেরিন পেশাজীবীরা ন্যায্যতা, স্বচ্ছতা ও মান রক্ষার দাবিতে নিচের ৫ দফা দাবি উত্থাপন করেছেন:
১. ডিপ্লোমাধারীদের ক্যাডেট সিডিসি দেওয়ার জন্য প্রবাসী কল্যান মন্ত্রণালয়ের পাঠানো চিঠি কোন ভাবেই বাস্তবায়ন করা যাবে না, এই ব্যাপারে নৌ মন্ত্রণালয়কে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে ।
২. প্রয়োজনের অতিরিক্ত ক্যাডেট ও রেটিংস রিক্রুটমেন্ট বন্ধ করে চাহিদাভিত্তিক কোটা নির্ধারণ করতে হবে। পূর্ববর্তী ব্যাচের শতভাগ অনবোর্ড না হলে নতুন ব্যাচ রিক্রুট বন্ধ করতে হবে এবং তা গেজেট আকারে কার্যকর করতে হবে।
৩. ভিসা সমস্যা সমাধান ও বিদেশি চাকরির বাজারে প্রবেশাধিকার বাড়াতে জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে।
৪. নাবিক প্রশিক্ষণ ও নিয়োগের ক্ষেত্রে সব ধরনের অবৈধ লেনদেন সম্পূর্ণরুপে বন্ধ করতে হবে।
৫. ভেনেজুয়েলাতে বন্দি ক্যাপ্টেন মাহবুবকে অতি দ্রুত মুক্ত করে আনতে হবে।
বাংলাদেশের মেরিন সেক্টর শুধু বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের মাধ্যম নয়, এটি হাজারো দক্ষ তরুণের কর্মসংস্থানের প্রতীক এবং দেশের গৌরবের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড ও ন্যায্যতার প্রশ্নে আপোষ করে, অনুপযুক্ত নীতিনির্ধারণ এবং চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্ত গ্রহণ এই খাতকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
একটি দেশের মর্যাদা ও আস্থা গড়ে ওঠে তার পেশাজীবীদের দক্ষতা, স্বচ্ছতা এবং আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখার সক্ষমতার মাধ্যমে। মেরিন সেক্টরেও এর ব্যতিক্রম নয়। তাই আজ সময় এসেছে, বাস্তবতার নিরিখে এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের আলোকে একটি সঠিক, সুবিন্যস্ত ও দীর্ঘমেয়াদী নীতিমালা গ্রহণ করার।
আমরা সরকার ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরসমূহের প্রতি আহ্বান জানাই— তারা যেন অবিলম্বে প্রস্তাবিত অনিয়ম, বৈষম্যমূলক ও আত্মঘাতী সিদ্ধান্তটি বাতিল করে, ৫ দফা যৌক্তিক দাবি বাস্তবায়নের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে।
এটি শুধুমাত্র আমাদের পেশার স্বার্থে নয়, বরং বাংলাদেশের ভাবমূর্তি, বৈদেশিক আয় ও আন্তর্জাতিক বিশ্বে আমাদের অবস্থান রক্ষার জন্য অপরিহার্য।
পরিশেষে উপদেষ্টা আসিফ নজরুল স্যারের উদ্ধৃতি দিয়ে বলছি , প্রত্যেক নাবিক একেকজন অঘোষিত রাষ্ট্রদূত , তাই রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি রক্ষার্থে উপরিউক্ত দাবীগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন করতে হবে।
ইউ