ঢাকা, বাংলাদেশ

শুক্রবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪

English

বৃত্তের বাইরে

ন্যায়পরায়ণ আমার মা

প্রকাশিত: ০০:০০, ৮ মে ২০২২; আপডেট: ১৩:৪৫, ২০ জুলাই ২০২২

ন্যায়পরায়ণ আমার মা

ফাতিমা পারভীন: আর দশজনের মতো আমি শহরে জন্ম নিয়ে বেড়ে উঠিনি। উপকূলীয় এলাকায় আমার জন্ম। আমার মা অতি শিক্ষিত ছিলেন না নবম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হতে পেরেছিলেন, আমার নানা ভাইয়ের কারণেই। তারপর একাধিক সন্তানের লালনপালনের মহান দায়িত্ব পালন করেন আমার মা। যদিও আমার মায়ের মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই বিয়ে হয়েছিল। তখনকার সময়ে পণ দিয়ে বিয়ে হ'ত। আমার মায়েরও পণে বিয়ে হয়েছে। তখনকার সময়ে ঐতিহ্যবাহী মুসলিম পরিবারের বিয়েগুলো এমন করে সম্পাদন হতো। মেয়েদের পণ (নগদ অর্থ কিংবা সম্পদ সম্পত্তি) দিয়ে বিয়ে করতে হতো।

আমার মায়ের জ্ঞান ও বিচক্ষণতার সঙ্গে যার পরিচয় হয়নি তাকে বোঝাতে পারবো না আমার মা সম্পর্কে। আর দশ জন মানুষের মতো ততোটা সুযোগ সুবিধা পেয়ে আমি বড় হতে পারিনি। উপকূলীয় অঞ্চলে শিশুরা যেভাবে বেড়ে ওঠে আমিও ঠিক সেভাবেই বড় হয়েছি। হারজিত নিয়ে ভাবি নি কিংবা কখনো কাউকে দোষী সাব্যস্ত করে বেঁচে থাকতে শিখিনি। মেয়েশিশু হয়ে পৃথিবীতে আসার পর এক অন্যরকম উদাসীনতার মধ্যে বড় হতে হয়েছিল আমাকে। আমার প্রতি নেতিবাচকতা, নিষ্ঠুরতা, শঠতা আর প্রতারণা আমাকে খুব বেশি আড়াল করেও রাখতে পারেনি। বরং এসবের আড়ালে আশ্রয় গ্রহণ করে মানুষ হতে চেষ্টা করেছি। চাইলেই জীবনের কিছু বাস্তবতা ও নিয়তির নির্মমতা ইগনোর করা যায়না। শিশুকাল থেকেই ডিপ্রেশনে ভূগতাম। বড় হয়ে আকাশে উড়বো এই চেতনায় উজ্জীবিত ছিলাম। উপকূলীয় এলাকায় অন্যান্য মানুষের মতো ততোটা নিবিড়ভাবে সুযোগ সুবিধা চোখে পড়েনি। বিদ্যুৎ ছিল না, চলাচলের জন্য পাকা রাস্তা কিংবা গাড়ি ছিল না। জেলা, বিভাগ, রাজধানীতে মেতে ছোট একটি  লঞ্চ ছিল। টাকা বাংলাদেশের রাজধানী এতটুকু বুঝতাম কিন্তু যাবার পথ জানতাম না, অর্থাৎ পিছিয়েপড়া নারী জনগোষ্ঠীর একদম পিছনের সারির শেষ মানুষটি ছিলাম আমি ওই কথা ভেবে আজ দুঃসময়গুলোর কথা মনে করে হতবাক হই। আবার নীরব নিভৃতে হাসি পায়। বিষখালি নদী ছিল আমাদের বাড়ির খুব নিকটে, মনে পড়ে একাকী নদীর তীরে বসে কত জল আর ঢেউ দেখেছি। ওই নদী আমাকে অনেক উদার হতে শিখিয়েছে চারপাশের কার্পণ্যতা ও কষ্ট ভুলিয়ে দিয়েছে। নদীর তীরে ঢেউ দেখতাম। ভিজতাম ভাল লাগতো। জমে থাকা বালু দিয়ে হরেক রকম ঘরবাড়ি তৈরি করতাম। বালু দিয়ে তৈরি ঘরগুলো দেখতাম নীরবে। ভালোলাগা ছিল বেশ। নিজের হাতে তৈরি করা ঘরগুলো যখন নদীর ঢেউয়ের পানিতে ভেঙে ফেলত তখন মন খারাপের দেশে চলে যেতাম। তখনই বুঝেছিলাম জীবনটাও ঠিক এমনই। গড়ে আবার ভাঙ্গে। ভাঙ্গে আর সহজে গড়ে ওঠে না। জীবন সত্যিই রহস্যাবৃত।

হয়তো আজও মানুষ হয়ে উঠতে পারিনি তাই বলে যে একদম অমানুষ হয়ে যায়নি তাও খুব বুঝতে পারছি। এসবের পিছনে একজন মানুষ চরমভাবে আমাকে শাসনে ভাষণে রাখতেন। আর তিনি হলেন আমার মা।

মেয়েশিশুদের কালেভাদ্রেই সুখ আসে। আদর যত্ন বলতে একালের মেয়েশিশু যা পায় এরকম নয়। পরিবারে একমাত্র ভাইয়ের খুব কদর দেখে মনে মনে চাইতাম ঘুম থেকে উঠেই যেন ছেলে শিশু হয়ে যাই। প্রতিদিন সকালে নিজেকে খুব অসহায় লাগতো। মনে হতো মা ভাইকে বেশি ভালবাসেন। আমরা অনেক ভাইবোন ছিলাম তাই সবার প্রতি খেয়াল রাখা একজন মানুষের জন্য সম্ভব নয়। এই কথাটা সহজে বুঝতে চাইতাম না। সেদিনের মায়ের প্রতি সেই অভিমান থেকে আজ বেশ বুঝতে পারছি। আর বোঝার একমাত্র কারণ হলো আজ আমিও একজন “মা”।

চারপাশে নিষ্ঠুরতা দেখে যুদ্ধ করতে শিখেছিলাম। আমার ভালো লাগা, সবাইকে সমান ভালোবেসে বেঁচে থাকা,আর আমার সফলতা যাই বলি না কেন সবকিছুই যেন  আমার পাশে বহমান বিষখালী নদীর চারপাশের অনুকূল ও প্রতিকূল দেখেই শেখা। কত বেলা অবেলায় ছুটেছি নদীর তীরে তার হিসেব নেই,এটা ছিল আমার শৈশবের নদী। নদীর পাড়ে একটা মস্ত বড় বটগাছ ছিল। আমরা সব বন্ধুরা মিলে ওই বটগাছটায় বেশ চড়তাম। ছোঁয়া ছোঁয়া খেলতাম। এডাল থেকে ওডালে ছোটাছুটি করতাম। একটা মজার পৃথিবী ছিল। যা আজকালকার ছেলেমেয়েরা একদম পায়না। খোলা আকাশ ও মাঠ ছিল আর ছেলেবেলার এক মহান স্বাধীনতা ছিল। 

বাড়িতে একটা বড়সড় জবাবদিহিতা ছিল। বড়দের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলাম। প্রতিবেশীরা একে অপরের সহায়ক ছিলেন। সন্ধ্যা হলেই নীড়ের পাখিরা ঘরে ফিরতো। আমরাও ফিরতাম। মাগরিবের আযান মানে বাইরের জগৎ বন্ধ নামাজ আদায় করে লেখাপড়া করতে হবে। ওই সময়ে ছেলে আর মেয়ে মস্ত এক বিভেদ ছিল। মার্বেল খেলা, রিং ঘোরানো, দাঁড়িয়াবান্ধা, সাইকেল চালানো এগুলোর অধিকারী ছেলেরা। আমার সেঝ বোন আমাকে নিয়ে পালিয়ে গিয়ে ছেলেদের সাথে মার্বেল খেলতো, সাইকেল চালাতো। আমিও বঞ্চিত হইনি। মনে পড়ে তখন সম্ভবত দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ি একদিন আমরা তিনবোন মিলে গভীর রাতে খেজুর রস চুরি করলাম। আমাদের সাথে ছিলেন আরো কয়েকজন। মানে আমার বড় বোনদের বন্ধুরা। এখনো তাদের নাম ভুলিনি। জেসমিন আপু ও তার ভাই মাসুম ভাইয়া দুজনে মিলে নারিকেল নিয়ে আসেন। লিনা,লুনা ও রুমা আন্টি তিনবোন মিলে পাতিল আর চাউল। আমরা তিন বোন খড়ি ও খেজুর রসের ব্যবস্থা করবো। সবাই মিলে আগের দিন বিকেলবেলা ঠিক করা হলো রাত তিনটায় একত্র হবো। তারা সবাই আমাদের বাসার সামনে এসে টিনের চালে ঢিল মারলেই আমরা বাসা থেকে বের হবো,যেই কথা সেই কাজ। আমি একটু ঘুম কাতুরে ছিলাম কিছুতেই উঠতে পারছিলাম না সেজো বোন আমাকে চিমটি কেটে ঘুম থেকে উঠালো। আমাকে চিমটে কাটার সময় মায়ের ঘুম ভেঙে ছিল কিন্তু আমরা টের পাইনি। মা ছিলেন অত্যন্ত চতুর আর বুদ্ধিমান। তিনিও চুপিচুপি উঠছেন কি করবে গভীর রাতে তার দস্যি মেয়েরা দেখার জন্য। মহাযজ্ঞটি সমাপ্ত করতে উদ্যত হলাম। আমাদের তিন বোনের উপরে দায়িত্ব পড়লো রসের ব্যবস্থা করা। আমাদের বোনদের কাণ্ডটি মা দূর থেকে দেখেছিলেন আর রাগে জ্বলছিলেন। মা ইচ্ছে করলেই আমরা যখন খেজুর-গাছের-রস নামাচ্ছিলাম তখনই ব্যবস্থা নিতে পারতেন কিন্তু আমার মা শেষ না দেখে ছাড়বেন না। পাঁচটি খেজুর-গাছের-রস সংগ্রহ করেছিল দুইবোন, আমি ছিলাম পাহারায়,রস দেখে হেসেছিলাম, হাসার জন্য চড় খেতে হয়েছিল। আনন্দের পরে যা হবার তাই হলো। অভিমানী আমি নালিশের জন্য রওনা হতেই আমাকে টেনে নিয়ে ফিসফিস করে মায়ের শাসনের কথা মনে করিয়ে দেয় অন্য বোন। অনেক কষ্ট করে তিনবোন মিলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের অফিস এর একটি ভাঙ্গা রুমের মধ্যে নিয়ে গেলাম। রসের পরিমাণ দেখে সবার চোখ মাথায়,যেন ডাকাতি করে ফিরেছি। রস পাতিলে রাখতেই ধড়াম করে আমাদের পিঠে কে যেন লাঠি দিয়ে খুব জোরে আঘাত করলেন। প্রথমে কিছু বুঝতেই পারিনি পরে মায়ের কণ্ঠ ও বকুনিতে আমরা তিন বোন ছাড়া সবাই লাপাত্তা। অবশেষে বুঝলাম এতক্ষণে সুশাসন কর্তা জননী আমার শীতের এই রাতে তার দস্যু কন্যাদের দেখার জন্য কত অধ্যাবসায় চালিয়ে ছিলেন। ওই রাতে মা শুধু আমাদের শাসনই করলেন না, সকালে খেজুর রসের মালিকের কাছে রস ফেরতসহ আমাদের ক্ষমা চাওয়ালেন। আমরা সেদিন অনেক লজ্জিত ছিলাম কিন্তু মায়ের সেদিনের আবেদনময়ী বর্ণনা জীবনে কোনোদিনও ভুলতে পারবো না। মা এমন করুণ আবেদনময়ী বর্ণনা করেছিলেন প্রতিবেশী আব্দুর রশিদ চাচার কাছে তা আজো ভুলতে পারিনি। মনে হয়েছিল আমাদের তিনি মানুষ করতে পারেন নি। আমরা পুরোপুরি অমানুষ হয়ে উঠেছি। আমাদের তিন বোনের কাণ্ডটি মায়ের মুখে শুনে চাচা হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলেন কিন্তু আমার মা কিছুতেই সহজ করে বিষয়টি মেনে নিতে পারছিলেন না এমনকি চাচাকে খেজুর রস গ্রহণ করাতে বাধ্য করেছিলেন, আমরা অনেক লজ্জিত হয়ে পড়েছিলাম। মায়ের প্রতি আমাদের গোপনে অভিযোগগুলো বুকের গহীনে প্রতিধ্বনিত হয়েছে বারংবার। দুপুরে  খাবার টেবিলে মা আমাদের নমনীয় হয়েই আদর করে খাবার তুলে দিয়ে বোঝালেন আমরা অনেক অন্যায় করেছি। অন্যের কোনোকিছু না বলে গ্রহণ করা অপরাধ। সেদিনের সেই মায়ের গল্পকথায় আমাদের ঐ সময়ে অনেক কিছু শিক্ষা না দিলেও আজ বুঝতে পারছি, সেদিনের মায়ের শাসন আমাকে কতটা শিক্ষা দিয়েছিল,অন্তরে ‌মানবিকতার হৃদয়বৃত্তি জাগ্রত করেছিলেন। পাপ-পুণ্য ও ন্যায়পরায়ণতার শিক্ষা দিয়েছিলেন সেদিন আমার মা। 

উইমেনআই২৪//ইউ//০৮-০৫-২০২২//১২:৪৩ পিএম//

কোন দূর্নীতিকে প্রশ্রয় দেব না: বিএসএমএমইউ ভিসি

বিএসএমএমইউতে সভা ও জাতীয় সম্মেলন  অনুষ্ঠিত 

 ইন্টার্ন চিকিৎসকরাই একটি হাসপাতালের প্রাণ: স্বাস্থ্যমন্ত্রী

এক চুমুতে আড়াই বছরের জেল!

ঢাবির কলা ও সামাজিক বিজ্ঞান ইউনিটে প্রিয়ন্তি প্রথম

ডিজিটাল সুরক্ষা বিষয়ক প্রশিক্ষণ সম্পন্ন

নারীর নিরাপদ কর্মক্ষেত্র নিশ্চিতে পুরুষদের সম্পৃক্তের আহ্বান

ঢাবির সব ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ

মায়ের উৎসাহে চাকরি ছেড়ে উদ্যোক্তা হয়েছেন শায়লা

চালক ছাড়াই ট্রেন চললো ৭০ কিলোমিটার!

ইসলামী ব্যাংকে বঙ্গবন্ধুর জীবনাদর্শের উপর আলোচনা

বিশ্বে প্রতিদিন ১০০ কোটি টন খাবার নষ্ট হয়: জাতিসংঘ

রাজধানীতে শিশু অপহরণ বেড়েছে: ডিবি প্রধান

কর্মবিরতি প্রত্যাহার ইন্টার্ন চিকিৎসকদের

ঠাকুরগাঁওয়ে রোজাদার ও শিশুদের মাঝে ইফতার বিতরণ