
বিএসএমএমইউ ও আইসিডিডিআরবি’র যৌথ গবেষণাসহ চিকিৎসার গাইডলাইন প্রকাশ অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মোঃ শারফুদ্দিন আহমেদসহ অন্যান্যরা:
গুরুতরো কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীরা পরবর্তীতে ডায়াবেটিস, শ্বাসকষ্ট এবং হৃদযন্ত্রের জটিলতার ঝুঁকিতে থাকে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ওআইসিডিডিআরবি’র যৌথ উদ্যোগে সম্পন্ন করা গবেষণার ফলাফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে এ তথ্য জানানো হয়।
এ উপলক্ষে আজ মঙ্গলবার ( ২১ মার্চ) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) এর ডি ব্লকের আইএনএম অডিটোরিয়ামে ‘লং টার্ম সিকুয়েল অফ কোভিড-১৯: অ্যা লংগিটুডিনাল ফলো-আপ স্টাডি ইন ঢাকা, বাংলাদেশ’ শীর্ষক একটি সেমিনারের আয়োজন করা হয়।
ইউএসএআইডি এর অর্থায়নে পরিচালিত গবেষণার ফলাফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে ‘লং কোভিড ক্লিনিক্যাল ম্যানেজমেন্ট গাইডলাইন ফরফিজিশিয়ানস্’ শীর্ষক একটি নির্দেশিকাও উপস্থাপন করা হয়। গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের কোভিড-১৯ আক্রান্ত হবার প্রথম পাঁচ মাসের ফলোআপের ফলাফল সম্প্রতি গবেষণা সাময়িকী দ্য ল্যানসেট রিজিওনাল হেলথ সাউথইস্ট এশিয়ার প্রকাশিত হয়।
গবেষণায় এশিয়ার মধ্যে এটি প্রথম গবেষণা যেখানে দেখা যায়, কোভিডড-১৯ থেকে সেরে ওঠা রোগীরা পরবর্তীতে বিভিন্ন শারীরিক সমস্যায় উচ্চ ঝুঁকিতে থাকে, যাকে পোস্ট-কোভিড-১৯ সিনড্রোম (পিসিএস) বা লং কোভিড হিসেবেও অভিহিত করা হয়।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মোঃ শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, দীর্ঘদিনের কোভিড জটিলতা ও সমাধানের জন্য বিএসএমএমইউর শিক্ষক, চিকিৎসক এবং আইসিডিআর’বির বিজ্ঞানীদের এই যৌথ প্রচেষ্টার প্রশংসা করে তিনি বলেন, করোনা নিয়ে ব্যাপক গবেষণার সুযোগ রয়েছে। যাদের করোনা হয়েছে আবার যাদের করোনা হয়নি তাদের নিয়ে গবেষণা করা যেতে পারে।
উপাচার্য বলেন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে করোনায় মৃত্যুর হার বেশি আবার বাংলাদেশে অনেক কম কেন সেটা নিয়েও গবেষণা হতে পারে। করোনা পারে না এমন কিছু নাই। করোনার কারণে মানুষের স্মৃতি শক্তি লোপ পেয়েছে। চোখের দৃষ্টি শক্তিতে প্রভাব ফেলেছে। হৃদযন্ত্রে প্রভাব ফেলেছে। মানব দেহে বিদ্যমান রোগের তীব্রতা বাড়িয়ে দিয়েছে। মানুষের শারীরিক জটিলতা ও মৃত্যু ঝুঁকি তীব্র করেছে।
তিনি বলেন, এ থেকে উত্তরণের জন্য গবেষণার বিকল্প নাই। গবেষণার মাধ্যমে রোগের যথাযথ চিকিৎসা নিশ্চিত করা যেমন সম্ভব একইভাবে রোগ প্রতিরোধের উপায়ও জানা যাবে। এটা হলে দেশের মানুষ এবং দেশ উভয়েই অর্থনীতি দিক থেকেও লাভবান হবে। রোগ প্রতিরোধে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে। আর এজন্য গবেষণাকে আরো বৃদ্ধি করতে হবে।
বিএসএমএমইউর উপচার্য বলেন, সামগ্রিক গবেষণাখাতের মোট অর্থ বর্তমানে প্রায় ৫০ কোটি টাকা। অতীতে যা দুই বা চার কোটি টাকার বেশি ছিল না।
এসময়ে আইসিডিডিআরবির নির্বাহী পরিচালক ড. তাহমিদ আহমেদ গবেষণার ফলাফলে গুরুতারোপ করে বলেন, কোভিড-১৯ এর দীর্ঘ মেয়াদী ক্ষতিকর প্রভাব এবং তার ধরণ নির্ণয়ে এই গবেষণার ফলাফল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু কেভিড-১৯. আক্রান্ত হয়ে যারা হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছিলেন তারা যদি নিয়মিত ফলোআপ না করেন এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা গ্রহণ না করেন তবে এই গবেষণার সার্থকতা ম্রিয়মান হয়ে যাবে।
অধ্যাপক ডা. সোহেল মাহমুদ আরাফাত গবেষণালব্ধ ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে চিকিৎসকদের জন্য লং কোভিড ক্লিনিক্যাল ম্যানেজমেন্ট গাইডলাইন উপস্থাপন করেন। তিনি উল্লেখ করেন, একটি সুনির্দিষ্ট গাইডলাইনের অনুপস্থিতি প্রায়শই সহজে নির্ণয় করা যায় না এমন কোভিডের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবগুলোর চিকিৎসা এবং পুনর্বাসনে প্রতিবদ্ধকতা সৃষ্টি করে।
তিনি আশা প্রকাশ করেন, প্রস্তাবিত গাইডলাইন চিকিৎসকদের সর্বাধিক সাফল্যের সাথে রোগ সনাক্তকরণ, চিকিৎসা এবং পুনর্বাসনে সহায়তা করবে।
অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ ও লাইন ডাইরেক্টর, সিডিসি) অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল ইসলাম গবেষণাখাতে বরাদ্দ বৃদ্ধির আহ্বান জানান। বক্তব্য রাখেন ইউএসএআইডি এর কর্মকর্তা সামিনা চৌধুরী।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন অধ্যাপক ডা. মো. ফেরদৌস উর রহমান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ডা. সোহেল মাহমুদ আরাফাত, কার্ডিওলজি বিভাগের প্রফেসর ডা. চৌধুরী মেশকাত আহমেদ এবং আইসিডিডিআরবির নিউট্রিশন ও ক্লিনিক্যাল সার্ভি বিভাগের সহযোগী বিজ্ঞানী এবং প্রধান গবেষক ডা ফারজানা আফরোগ গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল গুলো উপস্থাপন করেন। সেমিনারে শিক্ষক, চিকিৎসক, গণমাধ্যমের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
এসময়ে বক্তারা আরও জানান, ২০২০ সালের ১৫ ডিসেম্বর থেকে ২০২১ সালের ৩০ অক্টোবরের মধ্যে ঢাকায় অবস্থিত কোভিড-১৯-মনোনীত দুটি হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া কোভিড-১৯ আক্রান্ত (আরটি-পিসিআর দ্বারা শনাক্তকৃত) ১৮ বছরের বেশি বয়সী ৩৬২ জন ব্যক্তিকে এই গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। অংশগ্রহণকারীদের কোভিড-পরবর্তী জটিলতা নির্ণয় করার জন্য সেরে ওঠার ১ মাস, ৩ মাস এবং ৫ মাস পর ফলোআপ করা হয়। তাদের ¯œায়ুবিক, হৃদযন্ত্র, শ্বাসযন্ত্র এবং মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যাগুলো এই গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত ছিল। গবেষণা দেখা যায়, ৪০ বছরের কম বয়সীদের তুলনায় ৬০ বছরের বেশি বয়সী কোভিড-১৯ মেনে সেরে ওঠা ব্যক্তিদের কার্ডিওভাসকুলার বা হৃদযন্ত্রের জটিলতা (উচ্চ রক্তচাপ দ্রুত হৃদকম্পন, বা পা ফুলে যাওয়া) এবং স্নায়ুবিক (পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথি বা হাত ও পায়ে অসাড়তা, ঝিম ঝিম করা বা ব্যথা, স্বাদ ও গন্ধের অস্বাভাবিকতা) জটিলতা সম্ভবনা দ্বিগুণ। এই রোগের দীর্ঘ মেয়াদী প্রভাবগুলোও নারী পুরুষ ভেদে পৃথক, পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের মধ্যে কোডিড-পরবর্তী জটিলতার প্রকোপ দেড় থেকে চার (১.৫-৪) গুণ পর্যন্ত বেশি দেখা গেছে। হাসপাতালে ভর্তিকৃত এবং নিবিড় পরিচর্যার প্রয়োজন হয়েছিল এমন রোগীদের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদী জটিলতার সম্ভাবনা হাসপাতালে ভর্তি না হওয়া রোগীদের তুলনায় দুই থেকে তিন (২-৩) গুণ পর্যন্ত বেশি পাওয়া গেছে।
//জ//