ফাইল ছবি
আমার জন্মের সময় আমার ভয়াবহ রকম জন্ডিস হয়। মারা যাবার মত অবস্থা নানু তখন আল্লাহ্র কাছে বললেন আমার বংশে আর বাচ্চা লাগবে না শুধু এই বাচ্চাকে বাঁচায়ে দেও। আল্লাহ্ অত নির্দয় হন নি আমি বেঁচে গেলাম এবং এর পরে অনেক বংশধরও এল। আমার জন্ডিস এটা প্রথম নানুই ধরেন। ডাক্তারকে বলেন, বাচ্চাটাকে হলুদ লাগে। নার্সরা ঠাট্টার ছলে বলে, সুন্দর নাতনি দেখে নানীর এসব কথা। বলাবাহুল্য ছোটবেলায়ে আমার চেহারা কিছুটা উন্নত শ্রেণীর ছিল। এরপরের ঘটনা ভয়ংকর। আমার বিলিরুবিন হুড় হুড় করে বেড়েই চলছে, কমে না। আমাকে রে দিতে ছয় তলা নিয়ে যেতে হয়। নানু নিয়ে যান এরপর আমাকে মা-র কাছে আনে খাওয়াতে। নানুর আবার মনে হয় লিফটে আমার দম বন্ধ হয়ে যাবে তাই প্রতিবার ছয়তলা ভেঙ্গে ভেঙ্গে আসেন। এদিকে মা-র অপারেশনও সাক্সেসফুল হয় নি। মাও অসুস্থ। ফলে এই সব চিন্তায়ে আমার নানুর সব চুল পেকে গেল। হুট করে নানুকে আমি বুড়ো বানিয়ে ফেললাম।
ছোটবেলায়ে কয়েক বছর আমি আর আমার বড়বোন পিরোজপুর ছিলাম। একটা শব্দ ছিল ওটা শুনলে বুঝতাম নানু আসছে। মাঝে মাঝে মিলত, মাঝে মাঝে মিলত না। মিললে দেখতাম মনি খালাকে নিয়ে কালো ফ্রেমের চশমা পরে নানু ঢুকছেন। কী আনন্দ!! আমি আর আপু ব্যাগের পাশে বসতাম। নানু নানা চকলেট বের করে দিতেন। আবার আমরা যখন ঢাকা থেকে পিরোজপুর আসতাম। দুইবোন গলা ছেড়ে কাঁদতাম। নানুর মুখের পান কাগজে মুড়িয়ে আনতাম। আচারের মত জমিয়ে জমিয়ে খেতাম।
ঢাকায়ে এলে বড়মামার বাসায়ে উঠতাম। নানু বিকেলে আমাদের ছয়বোনকে(মামাতো, খালাতো) মাথায়ে তেল দিয়ে দিতেন। কঠিন তেল। জুলফি দিয়ে চুয়ে চুয়ে পরত, এমন টাইট হত বেণী যে চোখে পানি আসার যোগার। দুই বেণী শেষ হয়ে গেলে আমরা আয়নার সামনে গিয়ে জুলফি মুছে তেলটা হাতে মেখে ফেলতাম।
আমার দেখা বুদ্ধিমান দশজন মানুষের মাঝে নানু একজন। একটি খুব ছোট্ট রিসেন্ট উদাহরন দেই। আমেরিকা থেকে নানুকে ফোন দিলাম। নানু ফোন ধরে কিছু শুনছেন না। আমি চিন্তা করব দেখে নানু বললেন, ‘অমি নানা, আমি শুনছি না কিন্তু ভাল আছি। চিন্তা কর না।’ এখন আমার নানুটা ভাল নেই। বড়মামা চলে যাবার পরই নানু অর্ধেক হয়ে গিয়েছেন। দিন দিন খারাপ হচ্ছে। কাল হাসপাতাল থেকে ছাড়া হলেও নানুর অবস্থা ভাল না। ডাক্তারের রিপোর্ট ভাল আসে নি। সবচেয়ে যেটা ভয়ের কথা মা বলল নানুর নীচের দিকে জোড় পাচ্ছেন না। আমার সেই কর্মঠ নানু। শম্পুর হলুদের খাবারের আইটেম দেখে মাকে বললেন, ‘শেফু, ঝোল ঝোল কোন আইটেম নাই কেন?’ বলে ডীপ ফ্রিজ খুলে বরফওলা মুরগী কিভাবে জানি চোখের নিমিষে রেঁধে ফেললেন। সবার দোয়া মাঝে মাঝে খুব কাজে দেয়। দোয়া করছি নানু আবার সুস্থ হয়ে যাবেন। কুট কুট করে বারান্দায়ে রোদ পোয়াতে বসবেন। আমি অহনকে নিয়ে দেশে যাব, নানু কোলে নিয়ে ভাল করে দেখবে। আমার যে দাদা-দাদু-নানা সব বলতেই যে শুধু নানু।
//এল//