ছবি সংগৃহীত
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের ৫৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন উপলক্ষে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
মঙ্গলবার (২ মার্চ) মহিলা পরিষদের উদ্যোগে ‘বৈষম্যকে চ্যালেঞ্জ করি, সমতার চেতনা প্রতিষ্ঠা করি’ স্লোগানে সংগঠনটির সুফিয়া কামাল ভবন মিলনায়তনে এ সভা হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনটির সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম। স্বাগত বক্তব্য রাখেন সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু। ঘোষণা পাঠ করেন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সীমা মোসলেম।
আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. নাসিম আক্তার হোসাইন; বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের সাবেক উপাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. শায়লা নাসরিন; বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি এডভোকেট সালমা আলী; গ্লোবাল টেলিভিশনের প্রধান নির্বাহী সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা; বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের পরিচালক শাহনাজ সুমী এবং ঢাকা ইউনিভার্সিটি ডিবেটিং সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক আদনান মুস্তারি।
অনুষ্ঠানের শুরুতে সংগীত পরিবেশন করেন মৃদুলা সমাদ্দার; কবিতা আবৃত্তি করেন আইটি অফিসার দোলন কৃষ্ণ শীল।
ঘোষণায় বলা হয়, নারীর প্রতি বৈষম্য কেবল নারীর ইস্যূ নয়, এটি সামাজিক ইস্যু। ২০২৪ সালে বাংলাদেশের নারী সমাজের অগ্রগতি দৃশ্যমান হলেও নারীর অধিকার ও ক্ষমতায়নের পথে সহিংসতাসহ বিভিন্ন সামাজিক ও পারিবারিক বাধার বিস্তার ঘটেছে। এই পরিস্থিতিতে ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ৫ নম্বর লক্ষ্যমাত্রা জেন্ডার সমতা প্রতিষ্ঠিত করতে হলে নারীকে উন্নয়নের লক্ষ্য হিসেবে দেখার পরিবর্তে উন্নয়নের বাহন হিসেবে দেখার দৃষ্টিভঙ্গিও প্রসার সমাজের স্তরের মধ্যে ঘটাতে হবে।
আলোচক হিসেবে উপস্থিত আদনান মুস্তারি বলেন, ‘বৈষম্যের নানা রুপ বিদ্যমান, সামগ্রিকভাবে নারী আন্দোলনের সফলতা অর্জন করতে হলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীতে যুক্ত করতে হবে। উন্নয়নের ধারায় নতুন চ্যালেঞ্জ হবে জলবায়ু পরিবর্তন। দক্ষিণাঞ্চলের নারীরা স্বাস্থ্যগত ভাবে ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছে লবণাক্ততার জন্য, পানি সংগ্রহের দায়িত্ব থাকায় কিশোরীদের শিক্ষা ব্যাহত হচ্ছে, নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ সামনে আসায় অর্জন ম্লান হয়ে যাচ্ছে।’
শাহনাজ সুমী বলেন, ‘কেবল বাংলাদেশে নয় সারাবিশে^ নারীর প্রতি থাকা বৈষম্য নানা মাত্রা নিয়ে সামনে হাজির হচ্ছে। বৈষম্য দূর করতে সকলকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে।’
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা বলেন, ‘বাংলাদেশে -অসাম্যতার বিরুদ্ধে একটা লড়াই চলছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আজ নারীদের জন্য সংবেদনশীল পরিবেশ নেই। রাষ্ট্র ও সমাজ নারীর প্রাপ্যটুকু দিতে চায়না। সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে নারীকে নতুনভাবে নেতৃত্বের কথা বলা হলেও এখানে বৈষম্য আছে। ‘বৈষম্য যে অপরাধ’ এটা নীতি নির্ধারণী ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব না হলে বৈষম্য যাবেনা।’
অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, ‘যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধে বিভিন্ন আইন থাকলেও তার বাস্তব প্রয়োগ নেই। প্রয়োগ বলবৎ করতে হলে সম্মিলিতভাবে নারী আন্দোলন অব্যাহত রাখতে হবে; নতুন প্রজন্মকে দৃশ্যমান করতে হবে। আইনজীবীদের সময়োপযোগী প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ দিতে হবে।’ প্রযুক্তির বাইরে যেয়েও মহিলা পরিষদকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করার উদ্যোগ গ্রহণ করার আহ্বান জানান তিনি।
ড. নাসিম আক্তার হোসাইন বলেন, ‘নারী কী তার নিজের কথা বলতে পারে-এটা আজ মৌলিক প্রশ্ন, এর সাথে নারীর স্বার্থ, গণতান্ত্রিক, রাজনৈতিক স্বার্থ সংরক্ষিত। এই ডিসর্কোস ভেঙ্গে সমাজকে বিনির্মাণ করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। নারীর মুক্তির জন্য দেয়ালের বাইরে এসে কাজ করতে হবে। নারীর কাজের অর্থনৈতিক মূল্য দিতে হবে।
ড. শায়লা নাসরিন বলেন, ‘নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্য প্রকৃতির আরোপিত নয় বরং সাংস্কৃতিক-এই বিষয়ে স্বচ্ছতা আনা প্রয়োজন। সাংস্কৃতিক মানস পরিবর্তিত না হলে উন্নয়নকে টেকসই করা সম্ভব নয়। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে লৈঙ্গিক পরিচয়ের চেয়ে ব্যক্তির পরিচয়কে গুরুত্ব দিতে হবে। নারী-পুরুষকে সম্পত্তিতে সমান অধিকার দিতে হবে।’
স্বাগত বক্তব্যে সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে সংগঠিত নারীসমাজ এক আত্মপ্রত্যয় নিয়ে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ গড়ে তোলে।’
একবিংশ শতাব্দীতে প্রযুক্তির সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে অসাম্প্রদায়িক ও সমতাপূর্ণ সমাজ গঠনের লক্ষ্যে তরুণদের নারীআন্দোলন এগিয়ে নেয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি আরো বলেন, ‘বৈশ্বিক ও জাতীয় নারী আন্দোলনের মাধ্যমে জাতীয় উন্নয়নের মূল ধারায় নারীকে যুক্ত করতে নারীবান্ধব বিভিন্ন আইন ও নীতিমালা প্রণীত হলেও আইন বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ আছে। জেন্ডার মেইনস্ট্রিমিং হলেও সামাজিক রীতিনীতি, প্রথায় এখনো বৈষম্য আছে: ধর্মভীরুতার নামে পশ্চাৎপদতার দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে নারী আন্দোলনসহ সকল সামাজিক আন্দোলনকে অর্ন্তভূক্তিমূলক করে গড়ে তোলার উপর গুরুত্ব দিতে হবে।’
সভাপতির বক্তব্যে ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, ‘প্রতিষ্ঠার অর্ধশতাব্দী পথ অতিক্রমের পর নতুন নতুন অভিজ্ঞতা নারী আন্দোলনের সামনে এসেছে। আজ জ্ঞান বিজ্ঞানের বিস্তার ঘটেছে,উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে কিন্তু মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। সমাজে আজ আত্মকেন্দ্রিকতা বেশি হচ্ছে, জলবায়ু সংকট বাড়ছে। এর মধ্যে নারীর জীবনে পরিবর্তন হয়েছে। তারা অধিকার সচেতন হয়েছে। নারীর শক্তিতে বিকশিত করতে নারীদের পাশে দাঁড়াতে হবে। নারীর জীবনের মূল সংকট বৈষম্য এই বৈষম্য কোন কোন জায়গায় আছে তা চিহ্নিত করতে হবে। লড়াকু নারীর জীবনে যে সাহস সঞ্চার হয়েছে তাকে সংগঠিত করে নারী আন্দোলনকে অর্ন্তভ’ক্তিমূলক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সমতা, ন্যায়বিচার ও মর্যাদাকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
সভায় বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় ও ঢাকা মহানগর কমিটির নেতৃবৃন্দ, সম্পাদকমন্ডলী, পাড়া কমিটির সদস্য, কর্মকর্তাবৃন্দ এবং প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
সঞ্চালনা করেন সংগঠন সম্পাদক উম্মে সালমা বেগম।
ইউ