রেজা ঘটক
সে রাতে খুব কালবৈশাখের ঝড়-ঝঞ্ঝা ছিল। সেই ঝড়ের মধ্যে মা অন্য এক ঝড় মোকাবেলা করছিলেন। মায়ের প্রসববেদনা উঠেছিল। মায়ের পাশে ছিলেন বাবার বড় মামী। বাবার এই বড় মামীকে আমরা ডাকতাম কালাবু। বড় হয়ে মায়ের কাছে শুনেছি, এই কালাবু ছিলেন আমার দাইমা।
আমার জন্মের সময় শুধুমাত্র এই কালাবু ছিলেন মায়ের পাশে। আমাদের ঘরের একেবারে মধ্যের রুমটায় তখন মাকে নিয়ে কালাবু অবস্থান করছিলেন। আমাদের ঘরের চারপাশে চারটা বারান্দা ছিলো। মাঝখানের এই ঘর থেকে সব বারান্দায় যাওয়া যেত। কিন্তু আমার জন্মের মুহূর্তে অন্য বারান্দায় যাবার দরজাগুলো কালাবু ভেতর থেকে বন্ধ করে দিয়েছিলেন।
কালাবু কে সহযোগিতা করার জন্য ঘরের দক্ষিণ পাশের বারান্দায়, যেখানে মা-বাবা ঘুমাতেন, সেখানে তখন অবস্থান করছিলেন বাবা, আমার দাদী, সেজো কাকী, ছোট কাকী, জোহরা ফুফু আর আমীর দুদু। ঘরের উত্তর পাশের বারান্দায় অবস্থান করছিল আমার বড় ভাইবোনেরা (দুই ভাই ও তিন বোন) আর ছোট কাকা।
ঘরের পশ্চিম পাশের বারান্দায়, যেটা আমাদের সামনের বারান্দা, সেখানে অবস্থান করছিলেন সোনাখালু, ছোট খালা আর জামির মামা। জামির মামা তখন আমাদের বাড়িতে থাকতেন। আমাদের সকল গৃহস্থ কাজ দেখাশোনা করতেন। মা'র দূর সম্পর্কের ভাই হলো জামির মামা।
কালাবু মাঝে মাঝে শুধু ঘরের দক্ষিণ পাশের দরজা খুলে ওই রুমের সবাইকে মা'র পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে তা জানাচ্ছিলেন। প্রায় দুই আড়াই ঘণ্টা ঝড়-বৃষ্টি হলো। ঝড় যখন প্রায় কমে এসেছিল, মাঝে মাঝে হালকা বৃষ্টির মধ্যে তখন কেবল মেঘের গর্জন শোনা যাচ্ছিল, তখন কালাবু আবার দরজা খুলে জোহরা ফুফুকে ভেতরে নিলেন।
ঠিক তার কয়েক মিনিটের ভেতরেই আমার জন্ম হলো। মেঘের গর্জন ছাপিয়ে আমার কান্নার চিৎকারে গোটা বাড়িতে তখন খুশির বন্যা নেমে এসেছিল। সামনের বারান্দা থেকে ছোটখালা আর দক্ষিণ পাশের বারান্দা থেকে ছোট কাকী তখন জোর করে সেই ঘরে ঢুকেছিলেন আমাকে দেখার জন্য।
আমাদের ঘরের ঠিক উত্তর পাশে সেজো কাকার ঘর। সেই ঘরে ঝড়ের সময় ছিলেন আমার ছোট ফুফু। ছিলেন না বলে বলা যায় ঝড়ের সময় আটকা পড়েছিলেন। নইলে বেগম ফুফুও বাবার সঙ্গে আমাদের দক্ষিণ পাশের বারান্দায় থাকতেন তখন। আমার জন্মের খবর মুহূর্তে সেজো কাকার ঘরে পৌঁছালে বেগম ফুফু বৃষ্টি কাদা মাড়িয়ে হুড়মুড় করে আমাদের ঘরে এসেছিলেন।
আর ছোটখালা ও ছোট কাকীকে হারিয়ে দিয়ে ছোট ফুফুই কালাবু'র কাছ থেকে সবার আগে আমাকে কোলে তুলে নিয়েছিলেন। আর আমার নামটা ছোট ফুফু রাখবেন বলে তখনই আগাম ঘোষণা দিয়েছিলেন। পরদিন সকালে ছোট ফুফু আমার নাম ঘোষণা করলেন।
বাবার হাতের ঘড়ির সময় অনুসারে, আমার জন্ম হয়েছিল সোমবার দিবাগত রাতের প্রথম প্রহরের দেড়টার একটু এদিক সেদিক সময়ে। মানে ৮ বৈশাখ ১৩৭৭ বঙ্গাব্দের মঙ্গলবার। ইংরেজি ১৯৭০ সালের ২১ এপ্রিল তারিখে। আমাদের সব ভাইবোনদের জন্মক্ষণ, দিন, তারিখ বাংলা ও ইংরেজি মাস ও বছর অনুযায়ী বাবা তার নীল ডায়েরিতে লিখে রাখতেন। বাবার সেই নীল ডায়েরির লেখা বড় হয়ে আমি দেখেছি।
বাবার বন্ধু ডা. শিবচন্দ্র হিরা জ্যোতিষচর্চা করতেন। শিব কাকার পরামর্শ মেনেই বাবা আমাদের ভাইবোনদের জন্ম তারিখ লিখে রাখায় উৎসাহিত হয়েছিলেন। তার একটা কারণও ছিল। পরে শিব কাকা জন্মক্ষণ, দিন, তারিখ অনুযায়ী আমাদের কুষ্ঠি গণনা করতেন। পরদিন সকালে বাবা শিব কাকার কাছে গেলেন আমার কুষ্ঠি গণনা করাতে।
শিব কাকা আমার সম্পর্কে প্রথম যে কথাটি তখন বলেছিলেন সেটি হলো, এই ছেলে প্রচন্ড রকমের রাগী ও বদমেজাজী হবে। ভারী দূরন্ত হবে। দুদণ্ড ঘরে থাকতে চাইবে না। দেশ-বিদেশ ঘুরবে। লেখাপড়ায় পটু হবে। তীক্ষ্ণ স্মরণশক্তির অধিকারী হবে। এই ছেলে যত বড় হতে থাকবে, ততই ওর নামে বাড়িতে নানান কিসিমের নালিশ আসতে থাকবে। ওর নামে নালিশ না শোনা ছাড়া তোমার পেটের ভাত হজম হবে না, নানা।
শিব কাকার কুষ্ঠি গণনা শুনে বাবার কপালে চিন্তার ভাঁজ দেখে কাকা তখন বলেছিলেন, দুঃশ্চিন্তার কিছু নাই, নানা। এই ছেলে মাছ ধরায় যেমন পটু হবে। মারামারিতে তেমন পটু হবে। খেলাধুলায়ও পটু হবে। আর স্কুলে যদি যায় তো লেখাপড়ায়ও সাংঘাতিক পটু হবে। সবকিছু নির্ভর করবে তুমি ওকে কোনদিকে নামাবা তার উপর। স্কুলে না গেলে নামকরা ডাকাত সর্দারও হতে পারে হা হা হা হা...
জ্যোতিষশাস্ত্র যা বলে তা হলো, এই ছেলে সাংঘাতিক ডানপিঠে হবে। পারতপক্ষে কারো কথায় পাত্তা দেবে না। নিজের যা ভালো মনে হবে, তাই করবে। ও শান্তির মা, আমাদের আরেক পশলা পান দাও, বলে শিব কাকা আমার কুষ্ঠি গণনায় তখন এভাবেই ইতি টানলেন।
শিব কাকা বাবাকে ডাকতেন নানা। আর বাবা শিব কাকাকে ডাকতেন নাতী। আমরা তাকে শিব কাকা ডাকতাম। বাবাকে শিব কাকার মা ধর্মবাবা ডেকেছিলেন। সেই থেকে শিব কাকার মাকে আমরা বড়দির মত জানতাম। আমরা তাকে ডাকতাম ঠাম্মা। ঠাম্মা যতদিন বেঁচেছিলেন রোজ এক-দু'বার আমাদের বাড়িতে আসতেন।
আমাদের বাড়ির চারপাশে পুকুর ছিল। আমি যখন হামাগুড়ি দেওয়া শিখলাম, তখন প্রায়ই নাকি ক্লোরিং করে করে সেই পুকুরে গিয়ে নামতাম। আমাকে আটকানোর জন্য তখন পুকুর ঘাটে বাঁশ দিয়ে উঁচু করে বেড়া দেওয়া হয়েছিল। আমি সেই বাঁশের বেড়া টপকেও নাকি পুকুরে নেমে যেতাম। পরে হামিদ জামাই আর জামির মামা বিশেষ কায়দায় ঝুনা নারকেল জোড়া দিয়ে আমাকে সাঁতার শেখালেন। ছোটবেলায় যে কারণে আমি হাঁটা শেখার আগেই এভাবে সাঁতার শিখেছিলাম।
বাবার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন মহেন্দ্রনাথ মণ্ডল। যাকে আমরা ডাকতাম দাদু। মহেন্দ্র দাদু রোজ আমাদের বাড়িতে আসতেন। বাবাও রোজ মহেন্দ্র দাদু'র বাড়িতে যেতেন। শিব কাকাদের বাড়ির ঠিক পাশের বাড়ি হলো মহেন্দ্র দাদু'র বাড়ি। সবাই বলতো বৈরাগী বাড়ি। মহেন্দ্র দাদু'র ছোটছেলে প্রকাশ হলো আমার ছোটবেলার বন্ধু। প্রকাশ বয়সে আমার চেয়ে ঠিক সাড়ে চার মাসের ছোট। কিন্তু আমরা ছোটবেলা থেকেই একসঙ্গে একই ক্লাসে পড়তাম। আমাদের পড়াশুনায় হাতেখড়ি হয়েছিল দিনো'র মা'র পাঠশালায়।
মহেন্দ্র দাদু খুব চা পছন্দ করতেন। দাদু আমাদের বাড়িতে আসলেই মাকে দেখতাম চা বানাতে। সেই সুযোগে আমি তখন চুরি করে চিনি খেতাম। দাদু বারান্দায় বসে বাবার সঙ্গে খুব মজার মজার গল্প করতেন। আর দু'জনে ভারী অট্টহাসিতে গোটা বাড়ি একেবারে কাঁপিয়ে দিতেন। কিন্তু সেই হাসির উৎস কী তা তখন আমি একদম বুঝতাম না। দাদু'র চা খাওয়া শেষ হলে প্রায় সময় কাপ নেবার জন্য আমি ওত পেতে থাকতাম। কারণ কাপের নিচে একটু চা আর একটু চিনি জমা হয়ে থাকতো। কাপ নিয়ে ওটা আমি তখন ইচ্ছেমত চেটেপুটে খেতাম।
আমাদের পাঠশালার পাশেই ছিল হরিসভা। দিনো'র মা'র পাঠশালা আর হরিসভার মাঝখানে লাগোয়া ছিল বিপদভঞ্জন দাদু'র বাড়ি। বিপদ দাদু কীর্তন করতেন। তিন মেয়ে আর এক ছেলেকে নিয়ে তার একটা কীর্তনের দল ছিল। দাদু খুব লম্বা ছিলেন। কীর্তনের সময় দাদু খোল বাজাতেন। আর বাড়িতে ছেলেমেয়েদের গানের তালিম দিতেন।
উইমেনআই২৪ডটকম/জে//২২-০৪-২০২২//০২.২৪ এ এম