গারো সংস্কৃতি ও নারীদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক দকবান্দা বা দকসারি
গারো সম্প্রদায়ের মানুষেরা ভারতবর্ষের মোঙ্গলীয় জাতি। গারোরা ভারত বর্ষে প্রবেশ করেছিল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া দিয়ে। এরা প্রথমে পূর্ব ও উত্তর ভারতের পাহাড়ি অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে। বিশেষ করে চীন-ভারতের সীমান্তবর্তী তিব্বত, ভুটান, নেপাল, সিকিম এবং তৎসলগ্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। নেত্রকোনা জেলার দূর্গাপুর উপজেলার বিরিশিরি নৃ-তাত্বিক কালচারাল একাডেমির গবেষণা কর্মকর্তা সৃজন সাংমা বলেন, কালের বিবর্তনে এক সময় বাংলাদেশের পাহাড়ি অঞ্চলের মোঙ্গলীয়রা প্রবেশ করেছিল মায়ানমারের চীন প্রদেশের চীনা পাহাড়ের বন্ধুর পথ পেরিয়ে।
তিনি বলেন, ভারতে প্রবেশকারী মোঙ্গলীয়রা নানা শাখায় বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। ধারণা করা হয় এদের একটি শাখা প্রথমে তিব্বতের তুরা প্রদেশে ও ভুটানের নকলবাড়ি নামক অঞ্চলে বসতি শুরু করে। এই শাখাকেই ভারতবর্ষে গারোদের আদি জনগোষ্ঠী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তিব্বত ও ভুটান থেকে স্থানীয় অধিবাসীদের দ্বারা বিতারিত হয়ে এরা কুচবিহার, আসাম ও রংপুরের রাঙ্গামাটি, গোয়ালপাড়াতে আশ্রয় নেয়।
পরবর্তীতে গোষ্ঠীগত কলহে এদের একটি দল গোয়ালপাড়া ত্যাগ করে জনশূন্য, জঙ্গলাকীর্ণ, বৃষ্টিবহুল দুর্গম গারো পাহাড়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। গারো পাহাড়বাসী বলে এদের তখন নাম হয় গারো। গারোদের ঘরের নাম ‘নকমান্দি’। অতিতে তাদের ঐতিহ্যবাহী ঘর সাধারণত মাটি থেকে ৩/৪ ফুট উচ্চতায় মাচানের উপর নির্মাণ করা হতো। পাটাতন থাকতো কাঠের, বেড়া বাঁশের তৈরি এবং চাল ‘আমফাং’ নামক বনের ছন দিয়ে ঘরের চালার ছাইনি দেয়া হতো। ক্ষেতের ফসল বন্যপ্রাণী ও পাখিদের থেকে রক্ষার জন্য তারা গাছের উপর এক ধরণের ছোট ঘর তৈরি করে থাকে যাকে বলা হয় ‘বরাং’ ঘর ।
গারো নারীদের ঐতিহ্যবাহী পোশাকের নাম দকবান্দা বা দকসারি। কালের বিবর্তনে গারো সম্প্রদায়ের মধ্যেও আধুনিকতার ছোয়াঁ এসেছে। গারো মেয়েরা এখন সালোয়ার কামিজ পড়েন আর নারীরা শাড়ী পরেন। গারো পুরুষেরা পরিধান করে প্যান্ট, শার্ট, লুঙ্গি, ফতুয়া ইত্যাদি যা সাধারণ জাতীয় পোশাকের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।
গারোদের ঐতিহ্যবাহী উৎসব ‘ওয়ানগালা’। ‘ওয়ানগালা’ উৎসবটি সাধারণত পালন হয়ে থাকে অক্টোবর বা নভেম্বর মাসে। এই উৎসবের মধ্যদিয়ে গারোদের চাষ নতুন শস্য উৎসর্গ করেন সূর্য দেবতা সালজং এর নামে।
গারোদের বাদ্যযন্ত্র ও অস্ত্রো সর্ম্পকে নৃ-তাত্বিক কালচারাল একাডেমির গবেষণা কর্মকর্তা সৃজন সাংমা বলেন, রাং পিতল সিসার সংমিশ্রনে তৈরি একটি গুরুত্বপূর্ণ বাদ্যযন্ত্র। এটি একটি গামলা আকৃতির বাদ্যযন্ত্র, এই যন্ত্রটি কাঠি দিয়ে বাজানো হয়। রাং অনেক প্রকারের হয়ে থাকে।
রাং ছোট বড় মাঝারি, চেপ্টা এক সময় গারো সম্প্রদায়ের আদি ধর্ম সাংসারেক অনুসারীরা রাংকে বাদ্যযন্ত্র হিসেবে ব্যবহার ছাড়াও বিশেষ ব্যক্তির মৃত্যুর সময় অনেকগুলো রাং এক সাথে সাজিয়ে তার উপর সোয়ানো হতো।
গারো ভাষায় এটাকে বলা হত ‘রাংচা পুজুয়া’। প্রাচীন গারো সমাজ যার যত বেশি রাং থাকতো তাকেই ধনাঢ্য ব্যক্তি অর্থাৎ মান্নে চাগিবা বলে সম্মান দিত। এজন্যই গারোদের নিকট রাং-এর একটি স্বকীয় মূল্য রয়েছে। বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠান পালন, মৃতদেহ সৎকার, ওয়ানগালা উৎসবে রাং বাজানো একান্ত জরুরি।
গারো জনগোষ্ঠী ইংরেজদের সাথে দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধে পরাজিত হয়েছিলেন, ১৮৭২ সালে। দুইজন গারো বীর যোদ্ধার নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। যুদ্ধারা হলেন, থগান নেংমিনজা ও সোনারাম সাংমা। গারোরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল তীর, ধনুক, বল্লম ও কলার গাছকে ঢাল হিসেবে বানিয়ে নিয়ে।
//জ//