ডুবন্ত জাহাজের উপরে যে দেশ
পৃথিবীর অন্যান্য দেশের স্বীকৃতি মেলেনি তবুও এটি একটি স্বয়ং সম্পন্ন দেশ। বিস্তীর্ণ নীল সমুন্দ্রের সৌন্দর্য ঘেরা দেশ সিল্যান্ড। তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে একটি প্লাটফর্ম। নাম তার সিল্যান্ড। এটি নাকি বিশ্বের সবচেয়ে ছোট দেশ! কী? চমকে উঠলেন? হ্যাঁ, আমরা সবাই হয়তো বিশ্বের সবচেয়ে ছোট দেশ হিসেবে ভ্যাটিকান সিটিকেই চিনি।
স্বীকৃত দেশ হিসেবে ভ্যাটিকান সিটির নামই আসে। এছাড়াও আরো একটি দেশ রয়েছে, যাদেরকে বিশ্বের অন্য দেশগুলো এখনো স্বীকৃতি না দিলেও এরা নিজেদেরকে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ বা মাইক্রোনেশন হিসেবেই দাবি করে।
এক জাহাজ আর কতই বা বড় হতে পারে। সিল্যান্ড গড়ে উঠেছে একটি বিশাল ডুবন্ত জাহাজের উপরে। এটিই বিশ্বের সবচেয়ে ছোট দেশ বলে এখন পর্যন্ত দাবি করা হয়। দেশটির অবস্থান‘প্রিন্সিপ্যালিটি অফ সিল্যান্ড’ সংক্ষেপে সিল্যান্ডের অবস্থান ব্রিটিশ সমুদ্র উপকূল থেকে ছয় মাইল দূরে।
সিল্যান্ডের আইনী বাবস্থা সিল্যান্ড ব্যাটস পরিবার দ্বারা পরিচালিত হয়। এটি কোনো স্বীকৃত সার্বভৌম সত্তা এবং তারা এর বংশগত রাজকীয় শাসক। রায় বাটস নিজেকে ‘প্রিন্স রায়’ এবং তার স্ত্রী ‘প্রিন্সেস জোয়ান’হিসাবে ঘোষণা করেছিলেন সেপ্টেম্বর ০২, ১৯৬৭ সালে। তাদের পুত্র ‘প্রিন্স মাইকেল’ হিসেবে পরিচিত এবং ১৯৯৯ সাল থেকে বেটস পরিবার ‘প্রিন্স রিজেন্ট’হিসাবে পরিচিত।
দেশটির স্থান আন্তর্জাতিক জলসীমায়। আর পৃথিবীর কোনো দেশেরই এই আন্তর্জাতিক জলসীমার মালিকানা নেই। কোনো দেশের নিয়ন্ত্রণ নেই এখানে। এটি ছিল তৎকালীন ইংল্যান্ডের নিয়ন্ত্রিত এলাকার বাইরে। ফলে চাইলেও রয়েল নেভি এখানে কোনো হস্তক্ষেপ করতে পারেনি।
প্রায় ৫০ বছর ধরে টিকে আছে দেশটি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটেন স্থাপন করেছিল সামুদ্রিক দুর্গ। প্রথম দিকে এটিকে ডাকা হতো ‘রাফস টাওয়ার’ নামে। এর কাজ ছিল শত্রু বিমানকে প্রতিহত করা, ইংল্যান্ডের জলসীমায় জার্মান মাইন বসানো পর্যবেক্ষণ করা ও তা সম্পর্কে রিপোর্ট করা। যুদ্ধের সময় এটি ছিল প্রায় ১৫০-৩০০ জন সৈন্যের আবাসস্থান। সেই সঙ্গে এখানে ছিল বিভিন্ন রাডারের যন্ত্রপাতি, দুটি ৬ ইঞ্চি বন্দুক, এবং দুটি ৪০ মি.মি. অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট অটোমেটিক কামান। ১৯৫৬ সালে রয়াল নেভি একে পরিত্যক্ত ঘোষণা করে।
১৯৪২ সালে প্রথমে একটি ফেরির ন্যায় বিশাল ভাসমান সমতল জাহাজ নেয়া হয়। এরপর এর উপরে পাটাতন যুক্ত দুটি কংক্রিটের ফাঁপা টাওয়ার যুক্ত করা হয়, যাতে এর উপরে অন্যান্য কাঠামো তৈরি করা যায়। যুদ্ধশেষে যখন সিল্যান্ডের প্রয়োজন ফুরিয়ে আসে, তখন রয়েল নেভি তাদের সমস্ত সরঞ্জাম নিয়ে এখান থেকে চলে যায়। ফলে এই অবকাঠামোটি পরিত্যক্ত হিসেবে পড়ে থাকে কয়েক বছর।
এরপর ১৯৬৭ সালে এখানে একটি অবৈধ বেতার সম্প্রচারকারী দল ঘাঁটি গাড়ে। তারা এই স্থানটি তাদের হেলিকপ্টারের ল্যান্ডিং প্যাড হিসেবে ব্যবহার শুরু করে এবং এখানে আরামে বসবাস শুরু করে। কিন্তু তাদের এই আরাম বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ঐ বছরেরই সেপ্টেম্বর মাসে আরেক অবৈধ বেতার সম্প্রচারকারী রয় বেটস এখানের আগের অধিবাসীদের উচ্ছেদ করে এই স্থানটি দখল করে নেয়।
দখলকৃত এই কৃত্রিম দ্বীপটি তিনি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন এবং একে ‘প্রিন্সিপ্যালিটি অফ সিল্যান্ড’ নামের এক সার্বভৌম ও স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দেন। তার এই ঘোষণার পেছনে কলকাঠি নাড়েন একজন উকিল, যিনি বেটসকে কীভাবে এটি স্থায়ীভাবে দখল করা যায়, সে বুদ্ধি দেন।
কিন্তু এর পরের বছরই সিল্যান্ডকে মুখোমুখি হতে হয় আরেক বিপদের। একদিন সিল্যান্ডের দিকে একটি ‘ব্রিটিশ ট্রিনিটি হাউজ’ জাহাজ এগিয়ে আসলে রয় বেটস জাহাজটির দিকে সতর্কীকরণ গুলি ছোড়েন। ফলে পরবর্তীতে বেটস ইংল্যান্ডে প্রবেশ করলেই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। রয় ও মাইকেল বেটসের নামে দায়েরকৃত এই মামলা আদালতে উত্থাপন করা হয়। তবে সিল্যান্ড ব্রিটিশ সীমানা ও বিচারব্যবস্থার বাইরে হওয়ায় বেটস পরিবারের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেয়া যাবে না বলে ঘোষণা দেন বিচারক। ফলে সে যাত্রায় বেঁচে যান বেটস।
এরপর কয়েক বছর বেশ শান্তিতেই কেটে যায়। এর মাঝে কিছু বিচ্ছিন্ন গ্রুপ ও চোরাকারবারি দল সিল্যান্ড দখল নেয়ার চেষ্টা করলেও রয় বেটস তাদের প্রতিহত করেন এবং তার এলাকা থেকে তাড়িয়ে দেন। এরপর ১৯৭৫ সালে সিল্যান্ড থেকে রাজ্যের সংবিধান প্রকাশ করা হয়। ধীরে ধীরে কয়েক বছরের মধ্যেই তাদের পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত, ডাক টিকিট, মুদ্রা ও পাসপোর্ট চালু করা হয়। সিল্যান্ডের জাতীয় প্রতীক ও সীলমোহরের নকশা তৈরি করা হয় সিল্যান্ডের জাতীয় নীতিবাক্য “E Mare Libertas” অনুসারে, যার অর্থ, “সমুদ্র হতে, স্বাধীনতা”।
এই স্বাধীনতা ঘোষণার ঠিক ১০ বছর পর ১৯৭৮ সালের আগস্ট মাসে।
//এল//