ঢাকা, বাংলাদেশ

বৃহস্পতিবার, ১৩ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪

English

সাহিত্য

অনুগল্প 

যুদ্ধ এবং স্বপ্নপাখাওয়ালা

নাসরীন জাহান

প্রকাশিত: ১৪:২৭, ৩১ অক্টোবর ২০২২

যুদ্ধ এবং স্বপ্নপাখাওয়ালা

যুদ্ধ এবং স্বপ্নপাখাওয়ালা


হ্যালো,,
ধড়ফড় করে জেগে ওঠে রাত্রি। কানের
কাছে ফোনটা লটকে ছিলো, তার ওপাশ
থেকেই ফ্যাসফ্যাসে শব্দটা আসছে। বেডসুইচ জ্বালিয়ে 
চশমা খোঁজে। 

দুঃস্বপ্ন দেখছিল। চারপাশে অন্ধকার প্রচুর বোমা ফুটছে।
সে আর ছোটভাই জড়াজড়ি করে মায়ের লাশের সামনে 
বসে কাঁদছে। 
নাহ! এটা স্বপ্ন ছিলো না, তন্দ্রার আগে আগে এই স্মৃতি 
তাকে এমন আথাড়িপিথাড়ি আঁকড়ে ধরে, বুকের
মধ্যে কড়া শীত নিয়ে একসময় ঘুম আসে। 

ফের জেগে ওঠে,,হ্যা,,লো,,

দ্রত জেগে চশমা পেয়ে যায়।
কন্ঠ শুকিয়ে খানখান, একদল মেলিটারি এসে ভাইকে 
ধাক্কা দিয়ে তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।
বাবা যুদ্ধে গেছে। ডাক্তার মা ওদের দুজন কে খালার
কাছে রেখে ক্যাম্পে আহত যোদ্ধাদের সেবা করছিল।
ওরা দুজনেই দুই ভাইবোন কে স্বাধীনতার এমন শিক্ষা 
দিয়েছি,, যা অহর্নিশ দুটো কিশোর কিশোরীর স্নায়ুতে
প্রবাহিত হত।
রক্তাক্ত অবস্থায় ভাই মৃত্যুতে ঢলে পড়ল। এরপর 
সব চুপ।

যতবার এই দৃশ্য চোখের সামনে আসে এত বছর 
চলে গেছে, এখনো উদ্ভ্রান্ত হয়ে পড়ে সে।
এ নিয়ে বহুবার তাকে বুকে জড়িয়ে অর্নব বলেছে,
তুমি নিজে যদি সুস্থ হতে না চাও,কে তোমার 
হেল্প করবে? আমার খুব কষ্ট হয়,মনে হয়,আমার
প্রেম তোমাকে আসলে স্পর্শই করে না?
আমি তোমার সুখের কোন কারণ হতে পারি না?
তা কেন? রাত্রি অর্নবের ঠোঁটে হাত
চেপে বলে,  যখন সবাই হাল ছাড়ল,,তোমার 
ভালোবাসার প্রেরণাতেই তো আমি স্বাভাবিক হয়েছি।

তবে কী অর্নব ফোন দিয়েছে? নাহ, সে খুব নিয়ম মেনে
চলে, অতরাতে সে ফোন দেবে না।

এইসব ভাবনার চক্র থেকে বেরোতে রিসিভারে কান পাতে,
ওপাশ থেকে যেন অনন্ত বেয়ে আসে কন্ঠ, হ্যালো।
রাত্রি ধীরে ধীরে হিম হয়ে আসে। দ্বিধা কাটাতে ফিসফিস করে 
উচ্চারণ করে, কে?
ওপাশ শব্দহীন।  দেয়ালে দু বছর আগে টাঙ্গানো 
হলুদাভ ক্যালেন্ডার ফ্যানের বাতাসে উড়ছে।
ইলেকট্রিসিটি চলে যায়।
ঘরে বিড়ালের মতো লাফিয়ে পড়ে অন্ধকার। যখন তাকে 
আর্মিরা টেনে নিচ্ছিল, পেছন পেছন ছুটছিল ভাই 
একসময় সে একটা পাটকেল ছুড়ে
দেয় ওদের দিকে এবং চিতকার করে  বলে জয়বাংলা। 

আর্মিরা  হঠাৎ  রাত্রিকে ছেড়ে ভাইকে ঘেরাও করে 
ধরে, । উর্দু ভাষায় জিজ্ঞেস করে কী বললি?
আমার কসম লাগে, আপু ভাগো ফের ,, চিল্লিয়ে 
বলেছিল ভাই। রাত্রি একটা দেয়ালের ওপাশে লুকিয়ে যায়,
তারপর, 
কে?
আপু আমি মিঠাই! আমার গলা চিনতে পারতেছ না?
সমস্ত শরীর ঝাকুনি দিয়ে ওঠে। হঠাৎ রাত্রির মনে 
হয়, যুদ্ধ মায়ের, ভাইয়ের মৃত্যু, বাবার মানসিক বৈকাল্য,
সব ভ্রম,, এইটাই সত্য। যখন জীবনে যুদ্ধ আসে নি।
তুই কই ভাই? অন্ধকারে ঝমঝম করে ওঠে রাত্রির
কন্ঠ। আমার দুইটা পাখনা হইছে তুমি জানো না? খিলখিল 
করে হাসে মিঠাই,আমি সারাক্ষণ তুমার সাথে 
ঘুইরা বেড়াই। দাদারবাড়ি গিয়া বাবারেও দেইখা আসি,
মিঠাই তুই আয়,আমি দরজা খুলতেছি, কতদিন 
তোরে দেখি না।
ডানা ঝাপটানোর শব্দের সাথে বাইরে হঠাৎ ঝড় ওঠে, 
মিঠাই,,তুই ভিজ্যা যাইবি,,আমারে যারা দত্তক নিছে,
ওরা খুব ভালা মানুষ, তুই,,
দত্তক নেয়ার কথা মনে পড়তেই সব ভ্রম ভেঙে যায়।
বাইরে বিদ্যুৎচমক জানালা দিয়ে সাপের জিহবা বের
করছে আর ঢোকাচ্ছে।

মিলিটারি ঘিরে আছে ভাই কে,, যে ভাই বলত 
আমি অপুর মতো স্বার্থপর হমু না,দুর্গা বোন রে
আমি আগলায়া রাখুম। আর দুর্গা তো খুব সাহসী। 
তুমি ভীতু আছ, বেশ আছ।

আবার বল, কী বললি?
ভাই অনড় বলে জয়বাংলা। 
বল পাকিস্তান জিন্দাবাদ। 
জয় বাংলা। 

ঠাঠা গুলির শব্দে ভাই মাটিতে ধপাস পড়ে স্থির হয়ে যায়।  আর 
হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে জীবনের কোন সীমানায় 
সে এসে পৌঁচেছিল, রাত্রির নিজেরই মনে নেই। 
ঝড় থেমে গেলে বাতি এলে অঝোরে কাঁদতে থাকে সে। 
মিঠাই, আমি স্বার্থপরের মতো দৌড় দিলাম, 
তোরে বাঁচানির চেষ্টা করলাম না। 
নিজেরে আমি ঘেন্না করি,, 
ধীরে ধীরে সে ঘরে সাজানো মুখোশগুলোর
দিকে নির্বিকার চোখ হাঁটাতে থাকে।

ফের ফোন বেজে ওঠে। দ্রুত পানি খেয়ে নিজেকে 
ধাতস্থ করে রিসিভার ধরে বলে হ্যালো,
শোন আপু তুমি যদি নিজেরে অপরাধী ভাবো, আর
কোনদিন আমি কথা বলব না। আমি দারুণ আছি,
পাখিদের সাথে,, বন জঙ্গলের সাথে,,,,। 
এ ভ্রম নয় স্বপ্ন নয়, সত্যিই তার জীবনে মিঠাই 
ফিরে এসেছে!

ধীরে ধীরে রাত্রির ভেতর বহুকাল পরে এক অদ্ভুত 
আনন্দের জন্ম হয়,,আহ শান্তি। তুই রোজ আসবি তো?
হুম রাইতে। জানো আমি আম্মার সাথেও দেখা করি।
কী সাহসী আম্মা, না?
আব্বাও, রাত্রির ভেতর ফুঁড়ে শব্দ উঠতে গিয়েও থেমে
যায়,,তুই আম্মার সাথে? বুক উথলে ওঠে,, রাত্রির চেহারার 
বিবর্তন দেখে মুখ ছায়া করে মিঠাই, আজ আর এইসব নিয়া
কথা না,, আমি রোজ রাইতে তুমার সাথে কথা বলতে আসব, 
আর দিনে চলতে গেলে যেখানে নিজের ছায়া দেখবা,বু
ঝবা, আমি তুমার সাথেই চলতাছি।

,তুই সামনে আসবি না ভাই?আমি তোকে দেখব না?
আগের মতোই খিলখিল মিঠাই,ঘরের মধ্যে নিজেকে 
এভাবে বন্দী রাখলে কী দেখবে? বাইরে বাইর হও, 
পথের ওই ধারের যে হিজল  গাছে যে কাঠবিড়ালি লাফায় 
ওর মধ্যে আমি থাকি, এ ছাড়া যে ফড়িং ওড়ে,যে মাছরাঙা, যে,,
আমি ওদের দলেও থাকি। কাল থেকে  ভালো করে 
লক্ষ্য করলে দেখবে কী আকুলভাবে তোমার
দিকে তাকিয়ে আছি,
সত্যি বলছিস মিঠাই?
তিন সত্যি।

আসন্ন ভোর কচি ডাবের ভেতরকার মতো ছায়া
ফেলে পর্দায়,,ডানাঝটপট শব্দ হয়, স্পষ্ট কানপেতে
শোনে রাত্রি।
যখন চারপাশে কাকেরা চিতকার করছে আর টগবগিয়ে 
নামছে  রোদ।
তখন অপার্থিব শান্তির ঘুমে তলিয়ে গেছে রাত্রি।

//জ//