কথাসাহিত্যিক নাসরীন জাহান
এক
মগজে ঘাপটি মেরেছে সবুজ। কিন্তু চারপাশে সবুজ নেই বললেই চলে। বসন্ত পেরোনো ঋতুর ঘ্রাণে চলতে চলতে একজনের শরীরের সাথে আরেকজন শরীর ভেতর যেন অদ্ভুত আগুন ধরিয়ে দিচ্ছিল,,বলছিলে,,শোন জান,
আমার নাম কিন্তু মিন্তি,
জানি।
কিন্তু আমি ওইটাই ডাকব,বারবার সারাজীবন,
জান।
ধুর! মাথা খারাপ!
খারাপই, যেন জানোনা কার জন্য খারাপ?,
মরাটে গাছ পাতার অরন্যে আমরাএভাবেই উচ্ছ্বলিত হয়ে হাঁটছিলাম।
বিয়ের দু,দিন আগে পাতাঝরা এক অরণ্যে গেলাম দুজন।
সে চারপাশে তাকিয়ে আলটপকা চুমু খায়। বলে, ইশ, বিয়ের দিনটা দু,দিন এগিয়ে এলে দারুণ হয়।
আমিও ভেতরে গনগনে , কিন্তু বলতে থাকি, অরণ্যটা কেমন ন্যাড়া হয়ে আছে।
আমাদের এই সিজনে আসা ঠিক হয় নি।
সে বলে, ন্যাড়া? কই? আমার তো মনে হচ্ছে, চারপাশে মধু ছড়িয়ে আছে।
তার কথায় আমি বিহবল বোধ করি।
আসলে শুকনো বনের মধ্যেও আমাদের দুজনের প্রেমে সবুজের বিচ্ছুরণ থইথই করছিল।
কি ঠিক হয়নি সব ঠিক হয়েছে।
আমরা আজীবন এমন থাকব।
থাকব,আরও বেশি জুড়ে থাকব।
বলে সে আমার শরীরের সাথে শরীর কে পিষিয়ে দেয় যেন। আমাদের দেহ তরঙ্গ যেন বিদ্যুৎ তৈরি করছিলো। কীভাবে সকাল থেকে সন্ধ্যা অব্দি সেখানে কাটিয়েছিলাম, মুহূর্তগুলো কীভাবে ছুটে গেছিল, কল্পনা করা যায় না।
আসলে পরানে ঠোট চাপা হাসি,বৃক্ষের পেছনে উজ্জ্বল রোদ্দুরেও আমাদের সময় প্রহর প্রহর কিভাবে কেটে সন্ধ্যা নামিয়ে আনে,আমাদের চেতনায় থাকেনা।
সে যখন আমাকে ছেড়ে দিয়ে রিকশা ঘুরিয়ে চলে যায়, আমার কান্না পেতে থাকে,জীবনের সব কথা বলেও
মনে হচ্ছিল,আরও কিছু বলার ছিলো, ওর ঘন হয়ে আসা চোখের দিকে মুখটা টেনে আরও অনেকক্ষণ দেখার ছিলো ফোন করে ফিসফিস কন্ঠে বলি, আমরা বিয়ের পরদিন কিন্তু ঠিক ওখানে আবার যাব।
অবশ্যই।
দুই,
বিয়ের পরদিন বিয়ের ঝামেলাতেই যাওয়া হয় নি।
পাঁচ বছর পর সেই একই অরন্যে বহুবর্ণ রঙএর ঢেউ নেমেছে।
বাতাসের কেশরে কেশরে সবুজ অরণ্যে উপচে পড়া যৌবনের পরাণ মাতাল করা ঘ্রাণ।
বিয়ের পরে হানিমুন ছাড়া আর কোথাও যাওয়া হয়নি। বলতে গেলেই বলত,আমরা নিজঘরেই স্বাধীনভাবে যা করার করতে পারছি,তুমি এত বাইরে বাইরে করো কেন?
যা হোক তাকে ঠেলেঠুলে ছোট্ট বাচ্চা,তার জিনিসপত্রের সাথে সারাদিন অরণ্যে কাটানোর জন্য টিফিন বক্স করে
দুপুরের খাবার এনেছি।
আমার বারবার মনে হত,আমাদের নিভে যাওয়া তরঙ্গ এখানে এলেই আগের মতো প্রাণ ফিরে পাবে।
আজ অবাধ প্রকৃতির উতসবে ঢুকতেই হেমন্ত পেরোনো
শীতালু বাতাস আমাকে আচ্ছন্ন করে দিল।
একটা সুবিধাজনক জায়গা দেখে চাদর পেতে বসলাম।
ও পুচকুর সাথে খেলছে। আমি চারপাশে প্রকৃতির উচ্ছ্বাস দেখে সেই মরাটে প্রকৃতি র কথা যত মনে করছিলাম, বুক হুহু করছিল। সে মনে হয় অন্য কেউ ছিল। আসলে লাইসেন্স পেয়ে যাওয়া সম্পর্কে অভ্যাসের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে শারিরীক সম্পর্ককে বিশেষ করে মেয়েদের কাছে ক্লিশে করে তোলে।
কী বুঝে আমি কিছু ঘাসফুল ছুড়ে দিলাম
ওর মুখের দিকে, ধ্যাৎ! বলে সে মহাবিরক্ত হয়ে হেলান দেয়া অবস্থা থেকে উঠল,এরপর মুখ ঝারতে ঝারতে বলল,বাচ্চা হতে স্বাদ জাগছে নাকি?
আচানক একটা মৃদু অপমানবোধ গিললাম।
আসলে আমাদের কথা ফুরিয়ে গেছে।
আমি যত চারপাশের অপুর্ব প্রকৃতি, উদ্দাম বাতাস ফুলের ঘ্রাণে অভিভূত হতে চাই,ততো একটা অস্বস্তি কাঁটা হয়ে আমাকে বিঁধতে থাকে।
দুপুর কখন আসবে?
এরপকিছুক্ষণ সন্তানের ভবিষ্যৎ, একাউন্টের ফুরিয়ে যাওয়া টাকার গল্প করলাম,এরমধ্যে মাসের বাজারে একটা
ইলিশ কিনলে বেশ হয়, এসব কথার মধ্যে আমরা বেশ প্রাণ পেলাম।
পুচকো ঘুমিয়ে পড়েছে।
এরমধ্যেও পাখির কন্ঠে হঠাৎ আনমনা হয়ে কামহীন ওর হাত ধরতেই সরিয়ে ও সরিয়ে নিলো,কি যে করো ওদিকে কত মানুষ হাঁটছে!
অসহ্য লাগতে থাকে আমার প্রহরগুলো পৃথিবীর মতো দীর্ঘ। আমি আর পারছিলাম না। এখানে আর এক মুহূর্তও না। খাবারগুলো বাড়ি নিয়ে গরম করে খাওয়া যাবে।
আমাকে ওঠার ব্যাপারে তৎপর দেখে,ক্লান্তিতে ঝুঁকে পড়ে সে
হিয়ার আম্মু, উঠবে?
হুম।
আসলেই,কত পিঁপড়া এখানে, আজ চলে যাই, বাসায় গিয়ে
এসির মধ্যে শান্তিমতো খাব।
হুম।
কেমন গরম চারপাশে না? পুচকোকে কোলে নিয়ে
আমরা হাঁটতে থাকি।
ওহ বাঁচলাম। সে বলে, তুমি ঘ্যানঘ্যান করোনি,
আসলে আজকের ওয়েদার সেদিনের মতো ভালো নয়,আমরা আরেকদিন শীতকাল ধরে আসব।
আমার বুক মহাশূন্যতায় হুহু করে, আলগোছে মাথা নাড়ি, হুম!
//জ//