কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
আজ ১২ ই সেপ্টেম্বর। বিভূতিভূষণের ১২৯ তম জন্মবার্ষিকী।বাংলা কথাসাহিত্যের অনবদ্য স্রষ্টা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। যার কলমে রচিত হয়েছে অপরাজিতা, পথের পাঁচালী, আদর্শ হিন্দু হোটেল, ইছামতী’র মত বিস্ময়কর উপন্যাস ও গল্প। যার লেখায় প্রেম, প্রকৃতি এবং আধ্যাত্মচেনায় নিগুঢ় তত্ত্ব বিদ্যমান।
রবীন্দ্রযুগের আগে ও পরে জীবন্ত অবস্থায় বাংলা সাহিত্যে যে ক’জন লেখক প্রবল পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছিলেন এবং সে পাঠকপ্রিয়তা আজও বিদ্যমান আছেন তাদের মধ্যে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ও একজন।
এই বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছেলে তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার পরিচয় থাকার ফলে তিনি প্রায়ই বলতেন 'আমাদের ব্যারাকপুর স্টেশনের একদম কাছে 'আরণ্যক' বাড়িতে এস তাহলে মা-র মুখে বাবার অনেক কথা জানতে পারবে যা চিরকাল মনে থাকবে।' আমারও দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যদি আসি তাঁর মা কল্যাণীদেবী ( যে নামে বিভূতিভূষণ ডাকতেন) স্নেহভরে ও সুন্দর করে অনেক গল্প করবেন। যে মা বিয়ের আগে ম্যাট্রিক পাশ করেন এবং তখনকার 'মাতৃভূমি' পত্রিকায় রমা চট্টোপাধ্যায় নামে লেখালেখি করে খুব প্রশংসা পান এবং 'দেশ' পত্রিকায় যে সংখ্যায় বিভূতিভূষণের লেখা ছিল সেই সংখ্যায় ছিল রমা চট্টোপাধ্যায়েরও লেখা অবশ্য তখন পরস্পর পরিচয় ছিল না কিন্তু আসছি আসছি করে যখন তাঁদের বাড়িতে এলাম তার কদিন আগে প্রয়াত হয়েছেন মা।
তবে তারাদাসদার সঙ্গে দেখা হয়েছে বিভিন্ন জায়গায় এবং বারেবারে - যেমন বারাকপুর-শ্রীপল্লীর বাড়ি, আরণ্যক বাড়ি, সাহিত্য সভায়, মহাকরণের তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তরে, আমার বাড়ি ব্রহ্মপুরে ও অন্যত্র। আমার সৌভাগ্য এই যে তারাদাসদা এবং তাঁর স্ত্রী মিত্রাদির কাছ থেকে বিভূতিভূষণ সম্বন্ধে একটু একটু করে জানা থেকে কখনোই বঞ্চিত হইনি। এছাড়া বিভূতিভূষণ সম্বন্ধে জানতে পারি তাঁর বাড়ির পাশে পুঁটিদির ছেলে জগো (জগন্নাথ) বা শচীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় যিনি চমৎকার তামাক সেজে দিতেন প্রিয় বিভূতি মামাকে, হরিনাভি অঞ্চলের লেখক পাঁচুগোপাল চক্রবর্তী ( 'ফুলের ফাঁসি' তাঁর বিখ্যাত রসরচনা ) যিনি প্রথম লিখতে উৎসাহ দিয়েছিলেন, রিপন কলেজের সহপাঠী ও ৪১ নং মির্জাপুর স্ট্রিটের 'প্যারাডাইস' লজের বোর্ডার ও আজীবন বন্ধু নীরদচন্দ্র চৌধুরীর লেখা, ভাইবৌ যমুনা বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত 'উপলব্যথিত গতি' ইত্যাদি থেকে। তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন পিতার মতোই।
১৯৯৪ সাল সেপ্টেম্বর যখন চলছিল বিভূতিভূষণ জন্ম শতবার্ষিকী, কলকাতা থেকে প্রদীপ ঘোষ ও তাঁর বাণীচক্রের ছাত্র ছাত্রীদের সঙ্গে গিয়েছিলাম বারাকপুরের বাড়ি। যেটি অবিভক্ত ভারতে ছিল যশোর জেলারঅন্তর্গত, এখন উত্তর ২৪ পরগণা জেলার বনগাঁ মহকুমায়। বিভূতিভূষণকে নিয়ে আলেখ্য শুরুর আগে তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় যখন বলেন 'এখানে কানাইলাল জানা-র মতো কবি আছেন", সম্মান ও স্বীকৃতিতে আপ্লুত হই। অনুষ্ঠান শেষে খাওয়া দাওয়া এবং রাতে থাকার ব্যবস্থা করলেন।
তার জন্য হোটেল লাগে নি। প্রতিবেশীরাই তো তাঁর আত্মীয়। আমি অবশ্য থাকি শ্রীপল্লির বাসিন্দা ও কবি সমরেশ মুখোপাধ্যায়ের কাছে। ইতিমধ্যে জন্ম শতবার্ষিকী উপলক্ষে বাড়ির বারান্দায় শিল্পী বিপ্লব মিত্র তৈরি করে দিয়েছেন বিভূতিভূষণের মৃর্তি। বারান্দার যে চেয়ারে বসে লিখতেন বা ধ্যানমগ্ন হয়ে প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করতেন সেটি সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো। ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বড় বড় বৃক্ষ অভিবাদনের ভঙিমায়।একেবারে পুরোনো বাড়িটি এখন আর নেই যেখানে একদা বাস করতেন তারাদাসদার ঠাকুমা। বর্তমান জীর্ণ বাড়িটিকে যেখানে বিভূতিভূষণ ১৯৩৩ সাল থেকে সপরিবার বাস করছিলেন, পশ্চিমবঙ্গের বাম সরকার সংরক্ষণ করতে চায় নতুন সজ্জায় কিন্তু পুত্র তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় চান না ঐতিহ্য ঢেকে নতুন চাকচিক্য। বাস্তুভিটে ছুঁয়ে ফুটে থাকে নাকজোয়াল, ঘেঁটু, কালকাসুন্দে, ওড়কলমি ইত্যাদির মতো দেশজ ফুল। বিভূতিভূষণের জন্মদিনে আশপাশের সব স্কুল ছুটি থাকে। একদল ছাত্র ছাত্রী স্বতস্ফূর্তভাবে তাঁর লেখা ও দিনলিপি থেকে পাঠ ও আবৃত্তি করে চলে গেলে আবার একদল এসে পরিবেশন করে আর একরকম ভাবে। কথাসাহিত্যিকের জন্মমাসে এভাবে চলে কয়েক দিন। আজ আমিও আসছি বারাকপুর, পাঠ করব বিভূতিভূষণের লেখা দিনলিপি 'হে অরণ্য কথা কও' থেকে নির্বাচিত অংশ।
ইতিমধ্যে ইছামতী নদীর ঘাটটিও বিভূতিভূষণের নামে বাঁধান ও ফুল ফলের গাছে সাজানো। ব্রিজও হয়েছে, ব্রিজ পেরোলে পাওয়া যায় 'পথের পাঁচালী' উপন্যাসে বর্ণিত কিছু গ্রাম। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ইছামতী নদীকে বিভূতিভূষণ যেমন চিনতেন তেমনি আমিও কিছুটা চিনি তিন বছরে (১৯৯৯- ২০০২ সাল) যখন কার্য কারণে পোস্টিং ছিলাম বনগাঁয়। এখন ইছামতী পানাভর্তি থাকলেও বিভূতিভূষণের সময় যেমন ফর্সা ছিল তেমনি আমার সময়েও। কারণ ২০০০ সালে ভয়াবহ বন্যার জলে ভেসে যায় সমস্ত কচুরিপানা। সস্ত্রীক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে নৌকোবিহারও করেছি ফর্সা ইছামতীতে। তারাদাসদা কতবার যে গল্প করেছেন: বাবা তাঁর আদরের বাবলুকে কিভাবে গায়ে তেল মাখিয়ে রোদে তাঁতিয়ে পিঠে নিয়ে নিবিড় গাছ গাছালির ছায়ার মধ্য দিয়ে গিয়ে বনসিমতলার ঘাটে স্নান করাতেন ইছামতীর আদুরে জলে!
বিভূতিভূষণের ঠাকুরদা তারিণীচরণ বসিরহাট অঞ্চলের পানিতর গ্রাম থেকে উঠে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন বনগাঁর চালকি-বারাকপুর গ্রামে যার বর্তমান নাম শ্রীপল্লি-বারাকপুর। বিভূতিভূষণ ও বাবা মহানন্দ উভয়েই দুবার করে বিয়ে করে ছিলেন। তফাৎ এই যে মহানন্দের প্রথমা স্ত্রী হেমাঙ্গিনী ছিলেন নিঃসন্তান, তাঁরই অনুরোধে মহানন্দের আবার বিয়ে কাঁচড়াপাড়ার কাছে মুরাতিপুরের গুরুচরণ চট্টোপাধ্যায়ের মেয়ে মৃণালিনী-র সঙ্গে। মুরাতিপুরে মামার বাড়িতেই জন্ম বিভূতিভূষণের । সে গ্রাম এখন নেই। বিএ পড়তে পড়তেই বিভূতিভূষণের প্রথম বিয়ে হয় পূর্ব পুরুষের গ্রাম মুরাতিপুরের কালীভূষণের মেয়ে গৌরী মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কিন্তু বিয়ের আয়ু ছিল অগাস্ট ১৯১৭ থেকে নভেম্বর ১৯১৮।
প্রথম স্ত্রীর স্মরণে অনেক পরে ঘাটশিলায় অশোক গুপ্তের বাড়ি কিনে নাম দেন 'গৌরীকুঞ্জ।' প্রথম বিয়ের দীর্ঘ বাইশ বছর পরে ৩রা ডিসেম্বর ১৯৪০ আবগারি দফতরের ইন্সপেক্টর ও সাহিত্য অনুরাগী ষোড়শীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের মেজ মেয়ে রমা-র সঙ্গে বিয়ে হয়। পাত্রীর বয়স ১৭, পাত্রের বয়স ৪৬। আসলে পাত্রী যে নিজেই লেখিকা এবং বিভূতিভূষণের লেখার ভক্ত। বনগাঁয় বাবার কাছে থাকতে বারাকপুরে গেলেন প্রিয় সাহিত্যিকের অটোগ্রাফ নিতে। তখন লেখক যদিও খুবই বিষন্ন কারণ দুদিন আগে বিধবা বোন জাহ্নবী স্নান করতে গিয়ে মারা যান ইছামতী নদীতে ডুবে। তার মধ্যেই বিভূতিভূষণের ভালো লেগে যায় রমা তথা কল্যাণীকে। তাই পরের বছর বিয়ে।
বোনের মতোই স্নেহের ভাই নুটুবিহারী যাঁকে অতি কষ্টে এখনকার নীলরতন মেডিক্যাল কলেজে ডাক্তারি পড়িয়ে ঘাটশিলা পাঠিয়ে ছিলেন পসারের জন্য, তাঁরও মৃত্যু হয় মর্মান্তিক ভাবে। বিভূতিভূষণের প্রয়াণ ঘটে ১লা নভেম্বর ১৯৫০ কয়েক দিন অসুস্থ থাকার পর। অপবাদ রটে যে ভাই নুটুবিহারী সেভাবে চেষ্টা করেননি। করলে এবং বড় হসপিটালে নিয়ে গেলে এ যাত্রা বেঁচে যেতেন। অপবাদ সহ্য করতে না পেরে দাদা বিভূতিভূষণের মৃত্যুর এক সপ্তাহের মধ্যে সুবর্ণরেখার ধারে গিয়ে কার্বলিক অ্যাসিড খেয়ে আত্মহত্যা করেন ভাই নুটুবিহারী।
বিভূতিভূষণ যখন পাঠশালায় পড়াশুনো করছিলেন সহপাঠী ছিলেন প্রবোধ চট্টোপাধ্যায় যিনি পরে খ্যাত হন সীতারামদাস ওঙ্কারনাথ নামে এবং হাইস্কুলে তাঁর সহপাঠী ছিলেন বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় ।
বিভূতিভূষ বনগাঁ হাইস্কুলে ভর্তি হওয়ায় প্রতিদিন দশ মাইল হেঁটে যেতে হত। পুষ্পিত বনঝোপ, বনস্পতির ছায়া এবং পাখির ডাকের ভেতর দিয়ে রোজ যাতায়াত করার সময়েই প্রকৃতির সঙ্গে তাঁর নিবিড় সংযোগ গড়ে ওঠে।
বিভূতিভূষণ যখন রিপন (সুরেন্দ্রনাথ ) কলেজে আই এ ক্লাসের ছাত্র তখন সেই কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী। ছাত্র বিভূতিভূষণের মেধার পরিচয় পেয়ে রামেন্দ্রসুন্দর তাঁকে ময়দান ক্লাবের স্বেচ্ছাসেবক করে নেন। ময়দান ক্লাব আসলে নিখাদ আড্ডার আসর যেখানে বিকেল হলে পাথরের চাতালে আড্ডা দিতেন আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র, জগদীশ চন্দ্র সি ভি রমন প্রমুখ। আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্রের স্নেহ ও সাহায্য তিনি পেয়েছিলেন বরাবর। তাঁর অন্যান্য বন্ধুরা ছিলেন রাধারমণ মিত্র, দিক্ষণারঞ্জন মিত্র মজুমদার। কিন্তু দুঃখের বিষয় বরাবরের বন্ধু নীরদচন্দ্র চৌধুরী তাঁর 'দাই হ্যান্ড গ্রেট এনার্ক' গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে বিভূতিভূষণ কখনোই নিজেকে ছাড়া অন্য কাউকে গভীর ভাবে ভালবাসতে পারেননি। এই অভিযোগ সহজে খন্ডন করা যায় যখন বিভূতিভূষণের প্রিয় পুঁটিদির ছেলে তথা ভাগনে জগোর কথায় আসা যায়। তিনি বলেছেন ছুটি ছাটাতে যখন বিভূতি মামা বাড়ি আসতেন বনগাঁয় ট্রেন থেকে নেমে নৌকোয় করে ইছামতীর কুঠির মাঠ সংলগ্ন ঘাটে উঠতেন। আমরা শিশুর দল অপেক্ষা করতাম। নৌকো ঘাটে ভিড়লেই ঝাঁপিয়ে পড়ে বাক্স প্যাটরা নিয়ে হৈচৈ করতে করতে বাড়ি ফিরতাম।
দারুণ আনন্দে কাটত কদিন। এক এক করে পাড়ার সবাই তাঁর কাছে আসতেন , গ্রামের প্রত্যেকের খবর নিতেন। কেউ না আসতে পারলে তিনি তাঁদের কাছে যেতেন। কোনো রকম জাত ধর্ম মানতেন না। জেলে বাগদির কাছে বিড়ি চেয়ে খেতেন। গরমের দিনে ন'দিদিদের ছাদে শুতাম। চলত বিভূতিমামার খোশগল্প কিন্তু যেই ফরিদপুর লোকালের ভোঁ বেজে উঠত গোপালনগর স্টেশনে, মামা বলতেন রাত দশটা বেজে গেছে এখন ঘুমোবার সময় ...
//জ//