রোকেয়া খানম
মুক্তিযুদ্ধের বছর দুয়েক পর, আমাদের যৌথ পরিবারে দাদীর মৃত্যুর পর আমাদের মা হলেন বাড়ির কর্তী।
দাদীর সাথে বাড়ির সকল বয়োজ্যেষ্ঠরা মাকে ডাকতেন বৌমা। পরবর্তীতে এ সম্মোধনে মাকে অলংকৃত করে পরিবারের কনিষ্ঠ সদস্যরাও।
হাসিমুখে নিজহাতে সংসারের সকল দায়দায়িত্ব নিরবে পালন করতে দেখেছি মাকে।
আচারের মৌসুমে আচার, পিঠার মৌসুমে পিঠা বানানো আর তা তার শ্বশুরবাড়ি, বাবার বাড়ির আত্মীয়স্বজনদের ও পাড়াপড়শিদের মাঝে বিলি বন্টন করে খাওয়ানোতে পরম আনন্দ ছিল তার অন্তরে।
আত্মীয়স্বজনদের বিয়ে, অসুখ,,,, সব সুখ দুখেই মা -বাবাকে খুবই তৎপর থাকতে দেখেছি।
সবার খোঁজ খবর রাখা ছিল মায়ের রুটিন করা কাজ। কারো বাড়িতে বেড়াতে গেলে নিজ হাতে খাবার তৈরি করে নিয়ে যাওয়াটা ছিল তার অন্যতম শখের বিষয়।
পুরান ঢাকায় আমাদের বাড়ির পিছনে ছিল বস্তি। মাঝেমধ্যে সেখানের প্রতি ঘরে ঘরে মা আমাকে নিয়ে যেতেন, ভাব বিনিময়ের পর তাদের শিশু কন্যাদের তার কাছে পড়তে পাঠানোর বিনীত অনুরোধ করতেন। এভাবে শুরু হলো মায়ের বিনা বেতনে নতুন চাকরি!
সপ্তাহে পাঁচ দিন বিকেলে ওরা বাংলা ও অংক পড়তো, একদিন সেলাই শিখতো,,আর ছুটি ছিল একদিন।
মা ওদের স্লেটে লিখাতেন। আদর্শলিপি বই, স্লেট, চক ওদের জন্য তিনিই বরাদ্দ করতেন।
তার টার্গেট ছিল মেয়েদের অন্তত চিঠিটা লেখা শেখানো, আর আয় ব্যয়ের হিসেব শেখানো। বছর শেষে আমাদের পুরানো খাতার পৃষ্ঠা দিয়ে নতুন মলাটে আমাকে দিয়ে ওদের জন্য খাতা সেলাই করাতেন।
এ কাজগুলো মায়ের সাথে করতে আমার দারুণ ভালো লাগতো।
আমি তখন তৃতীয় / চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী। তখন থেকেই শিক্ষকতা পেশাটা মনে হয় অন্তরে গেঁথে গিয়েছিল।
আমার এই কর্মঠ মা তিনবার স্ট্রোকের পর দীর্ঘ ১১ বছর অসুস্থ ছিলেন।
দীর্ঘ অসুস্হতায় বিছানা আর টিভি হলো তার সাথী। টিভি চলতে থাকতো, মা ঘুমাতো।
কেউ ভুলে টিভি বন্ধ করে দিলে, মায়ের ঘুম ভেঙে যেত। এর সাথে তার ক্ষণিক সুখ যুক্ত হলো ছেলে-মেয়ে, নাতি -নাতনি, বউ, জামাতা,,,, কারোর না কারোর হাত ধরে একটু একটু করে বাড়ির গোল বারান্দা জুড়ে হাঁটা। পরিবারের প্রতিটি সদস্য তৎপর থাকতো তাকে খুশি রাখার। কথা জড়িয়ে যেত, তারপরেও কাউকে দেখলেই মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে হাত বাড়িয়ে পাশে বসতে বলতো।
আমরা পাঁচ ভাইবোনই ছোট বেলায় মাকে ভীষণ ভয় পেতাম। বাবা ছিলেন আমাদের বন্ধু। সেই মা-ই অসুস্থ হওয়ার পর একেবার যেন শিশু হয়ে গেলেন!
কী দুষ্টুমি যে তখন করতাম মায়ের সাথে!
পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে গালে চুমু খেতাম, কী যে মিষ্টি মায়ের গাঁয়ের গন্ধ। খুব মিষ্টি একটা হাসি মা তখন দিতেন!
জড়িয়ে শুয়ে থাকতাম আর মাঝে মাঝে কাতুকুতু দিতাম,,,মা খিলখিলিয়ে হেসে উঠতেন!
আমি বরাবরই মায়ের নেওটা ছিলাম। জোড়ে থমক খেয়েছি বলে মনে পড়ে না। একসাথে নামাজ, খাওয়া, রান্নায় সহায়তা করা থেকে শুরু করে বিকেলে ছাদে হাঁটা সহ,,,, মায়ের সকল কাজের সঙ্গী ছিলাম আমি।দুজনে দুজনার সকল সুখ দুখ বন্টন করতাম অকাতরে।
অসুস্হতার পর মায়ের কাছে গেলে কোনো না কোনো বাহানায় আটকে রাখতে চাইতো আমায়, কাছ ছাড়া করতো না।
সংসারের সকল ঝক্কিঝামেলা শেষে যতটুকু সময় সম্ভব ছিল আমরা সবাই তা দেওয়ার চেষ্টা করেছি আমাদের মাকে।
আমাদের কাছে পেলে মা যেন বিশ্ব হাতে পেতেন!
নিজের শৈশব থেকে মায়ের শেষ নিঃশ্বাস নেওয়া অবধি স্মৃতি জড়ানো মূহুর্তগুলো এখনো আমায় হাসায়, কখনো বা কাদায়!
মা -বাবার কাছে কী পাইনি সে হিসেব আমরা কোনো ভাইবোন কখনোই করিনি।
বরং তাদের কাছ থেকে পাওয়া আদর্শ, শিক্ষা এখনো অক্ষরে অক্ষরে পালন করবার চেষ্টা করছি এবং করবো ইনশাআল্লাহ।
নিজে সন্তানের মা হওয়ার পর " মা" শব্দটির মর্ম উপলব্ধি করেছি শিরায় শিরায়!
মন খারাপে আর অসুস্থতায় আমার নিরাপদ আশ্রয় ও বন্ধু ছিল আমার 'মা'!
অকপটে সব সুখ দুখ বন্টন করেছি তার সাথে।
সে জায়গাটা এখন আমার একেবারেই শূন্য!
রোজই মনে পড়ে মায়ের কথা!
তবে আজ যেন একটু বেশিই মন পড়ছে 'মা'কে!
তুমি যেখানেই থাকো না কেন, আমি জানি তোমার দুহাত ভরা দোয়া আছে আমাদের সবার জন্য!
তারপরেও, মাগো!
তোমার কোলটা একটু দরকার ছিল মুখ গুজবার জন্য!
আর তোমার হাতদুটোর দরকার ছিল আমার মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দেবার জন্য!
//জ//